Wednesday, October 6, 2021

মেলেনি -- মৃত্যুঞ্জয় সরকার

 মেলেনি
-------------
 মৃত্যুঞ্জয় সরকার 
-------------------------


 সাদা ধবধবে কুকুর ছানা মেজকর্তা শখ করে নাম রেখেছে কাব্বু। কি রুগ্ন ছিল যখন প্রথম এ বাড়িতে আসে। আদর যত্নে কে বলবেএখন  সেই কাব্বু। নাদুস নুদুস বেশ বড়ও  হয়েছে। কাব্বুর  মনে খুব কষ্ট। চেনটা সবসময় গলায় বাঁধা। ভালো লাগেনা ওর কিছু আজকাল।  
কেমন যেন দাসত্বের শৃঙ্খল। বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়া। ঠাঁই সদর দরজায় বসে  পাহারা দেওয়া। ঝিমুনি আসলেও উপায় নেই,মাঝেমাঝেই ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে হবে। এদিকে আজ আজ কাল চোরের উপদ্রব। এছাড়াও লোকজন ঘরে এলে প্রথমেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে পরিচিত হলে অত ঝুক্কি নেই, অন্যথায় বেগড়বাই হলেই লাঠির বাড়ি। 

 কি যন্ত্রনা কিঁউ কিঁউ করে কেঁদে উঠে কাব্বু, মায়ের করুণ মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের উপর। বুকের ভেতরটা ছটফট করে কেঁপে ওঠে স্পষ্ট দেখতে পাই মায়ের চোখ  ঠিকড়ে বেড়িয়ে আসা বিকৃতমুখ,বোনের থ্যাতলানো দেহ। সময় দুর্গাপুজো।  দশমী।  ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হইহই করে খেলছে। কেউ আতশবাজি ফোটাচ্ছে, ঢাকের তালে তালে নাচানাচি করছে।

রাস্তার ধারে বটগাছের তলায় কাব্বু  বসে আছে। মা বোনকে নিয়ে খাবারের খোঁজে বেড়িয়েছে।  পাশেই বিশু ময়রার খাবারের দোকান। যা বদরাগী মানুষ একটু এদিক-ওদিক হলেই গরম খুন্তির ছ্যাকা। এখনো তার পিঠে  সেই ঝলসানো দাগ লেগে আছে। বাপরে বাপ সে কি ভয়ংকর যন্ত্রণা।  কাব্বু মাকে দেখতে পাচ্ছে,এক  টুকরো পাউরুটি মুখে নিয়ে দোকান থেকে মা পালাচ্ছে। মনের মধ্যে কি আনন্দ অনেকদিন পর পাউরুটি খাবে ভাবাই যায় না! মনের ভিতর কি আনন্দ  মা বোনকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।  দোকানির  চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে আঁচে বসানো কড়াই এর  গরম জল মগে করে নিয়ে বোনের দিকে ছুঁড়ে মারে। বোন কুঁই কুঁই করে কেঁদে ওঠে। একদিকে মুখে খাবার অন্যদিকে রুগ্ন বোনের  যন্ত্রণার ছটফটানি,মা কোনরকমে বোনকে নিয়ে ছুটে রোড পার হতে যায়, ছুটে আসা লড়ির  ধাক্কায় সব শেষ। ছিটকে ছিটিয়ে পড়ে মা বোনের দেহ । সারা রাস্তায় চাপচাপ রক্তের দাগ। গাড়ি ছুটে চলে, কারোর ভ্রক্ষেপ নেই।পাষাণ হয়ে যায় কাব্বুর মন। মেজকর্তার ডাকে সম্বিত ফেরে। মেজো কত্তা বলে, -ভোলার সাথে পার্কে যা, নজর রাখবি, বেগড় বাই হলে তুই তো জানিস.... 
-মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় কাব্বু। 

-----------------------
পার্কে বসে আছে কাব্বু। ভোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলছে। এই একমাত্র ছেলে যাকে কাব্বু  ভরসা করে, বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওর জন্যই এই খোলা বাতাসে বুক ভরে সে শ্বাস নিতে পারে।কিছুক্ষণের জন্য বন্দী দশা থেকে মুক্ত বাঁচার আনন্দে মন নেচে ওঠে।  এই পার্কেই,  ডাব্বুর সাথে তার প্রথম পরিচয়। তারপর গভীর বন্ধুত্ব। 

 ডাব্বুর  কাছে কাব্বু জানতে পারে  জীবনের অন্য ধারাপাত স্বপ্নময় আবেগ বাঁচার লড়াই -এর বীজ মন্ত্র।  চোখে জল এসেছিলো বারবার ডাব্বুর জীবন কথা শুনে । সেও তো ভুক্তভোগী।  কাব্বু  জেনেছে ডাব্বুর  বাবা খুব বদরাগী, নেশাখোর, গাঁয়ের ভাটিখানায় আশেপাশেই  লুচ্চার মত ঘুরঘুর করতো ওর বাবা। মাতাল  লোকদের  ফেলে দেওয়া চাট, মদের শেষ বিন্দু  চেটেপুটে স্বাদ নিতো। 
ঘরে যে  ছেলে বউ আছে ওদিকে কোন নজর ছিল না। আবার ঘরে ফিরে সেকি হম্বিতম্বি, বকাঝকা,  চিৎকার-চেঁচামেচি। মাঝে মাঝে ডাব্বুর মাকে মারধর। মনটা বিষিয়ে যেত ডাব্বুর।  মায়ের করুণ মুখটা দেখলেই কান্না পেত।  ঠিক করে নিয়েছিল এর একটা বিহিত করবে কিন্তু করতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন বাবা উধাও হয়ে যায়।  তন্ন তন্ন করে এ গাঁ  থেকে ওগাঁ   খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু বাবা মেলেনি। এই বোধ হয় একজন সাদ্ধী নারীর  মনের ব্যাকুলতা হাজার অন্যায় সহ্য করেও একমুঠো বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে থাকা। 

 প্রতি সপ্তাহের রবিবার দুই বন্ধুর  দেখা হয়।  কত নতুন নতুন কথা ডাব্বুর  কাছ থেকে কাব্বু জানতে পেড়েছে।  ডাব্বুর প্রতি গভীর আস্থা ধীরে ধীরে জমে ওঠে সেও ডাব্বু হতে চায়। 

 ডাব্বুর কাছে জানতে পারে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সে একটা দল তৈরি করেছে।  সাম্যবাদী কুকুরের দল।  সমাজের বঞ্চনা,  অবহেলার প্রতিবাদে,  এক মঞ্চ তৈরি করেছে। ওদের জীবন নিয়ে কেউ ভাবে না শুধু প্রয়োজন মেটায়।  কিছু কিছু জাত ভাইদের  রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে ট্রেনিং দিয়ে  পুলিশ বিভাগে  কাজে লাগায়। তাও বিনা পরিশ্রমে। 
 কাজ ওদের,নাম বিভাগের। কাজ ওদের রোজগার মালিকের।  কেউ কেউ আবার ঘর, রেস্তোরাঁয়, হোটেলে পাহাড়াদার, কিছু পশুপ্রেমী আছে তাদেরও সংখ্যা কম।  এইতো কদিন আগে হাসপাতাল চত্বরে দুটো নার্স লাঠি মেরে মেরে শেষ করে দেয় ওদের এক জাতভাইকে। 
 বিতর্কের  ঝড় উঠে,  শুনেছে মামলাও শুরু হয়েছে নাকি। 

------------------------------
 বেশ কিছুদিন যাবত ডাব্বুর দেখা নেই। কাব্বুর মন আর আগের মতো ভালো নেই।  উদাস হয়ে  ওঠে।  মন স্বাধীনতাখুঁজে।ওই নিল নিল চোখ দুটোকাকে খুঁজে?  কাব্বু বসে আসে বেঞ্চে,ভোলা খেলছে। পাশের ঝোপ হঠাৎ,  নড়ে উঠলো। বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে কাব্বু দেখে শুকনো মুখ ছল ছল চোখ,  ল্যাংচাতে  ল্যাংচাতে ডাব্বু এগিয়ে আসছে তার দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলে,  একটু খাবার, একটু জল দিবি.... 
- কি হয়েছে তোমার
- আগে একটু দেনা কিছু খেতে, কোনরকমে জেলখানা  থেকে পালিয়ে এসেছি, তারপর তোকে বলছি সব একটু জিড়িয়ে নি।  
- কি হয়েছে বলো? 
 ডুকরে কেঁদে উঠে ডাব্বু 
 এই প্রথম কাব্বু ডাব্বুর চোখে  জল দেখতে পেল। প্রতিবাদী বিশ্বাসী মনে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পেল।  এক ছুটে কাব্বু মালিকের ছেলের ব্যাগ থেকে  খাবার, জলের বোতল,  নিয়ে দৌড়ে আসে ডাব্বুকে কে দেয়।  ডাব্বু গোগ্রাসে খাচ্ছে, কতদিন যেন খেতে পাইনি।  খুব মায়া হচ্ছে কাব্বুর। শুধু চেয়ে আছে বন্ধুর দিকে,  মনে ভাবছে খাবার চুরি করে আনা কোনো পাপ না।কোন ঘৃণা নেই, কোন চৌর্যবৃত্তি নেই, বাধ্যকতা নেই,একটু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মাত্র, এক নতুন বিপ্লব। 
কিছুক্ষণ পর ঢেকুর তুলে ডাব্বু বলে প্রাণ বাঁচালি তুই আজ আমার। এ কথা কোনদিন ভুলবো না আমি। ভেবেছিলাম আর হয়তো তোর সাথে দেখা হবে না আমার। 
- ও কথা বলে না বলতে নেই।  
- সত্যি কথাই তো বলছি রে ভাই। 
- কি হয়েছিল তোমার বলো না শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। 
- বলবো বলতে এসেছি তোর কাছে অনেক কাজ বাকি আছে রে। 
- ঠিক আছে তুমি একটু বিশ্রাম করো তারপর না হয় শুরু করবে। 
- না সময় খুব কম, চারিদিকে ফতোয়া জারি হয়েছে আমাকে দেখলেই এনকাউন্টার,বা বন্দি সব শেষ। 
- কি আবোল তাবোল বকছো কি সাংঘাতিক কথা বলছ? 
- তোকে বলেছিলাম না বাবাকে  আর খুঁজে পাওয়া যাইনি। আমি তো আমাদের লড়াই কায়েম করার জন্য নানা জায়গায়  ঘুরে ঘুরে এককাট্টা করছিলাম আমাদের জাতিদের। 
- হ্যাঁ সেতো জানি
- আস্তে আস্তে সবাই আমার কথা শুনছিল বুঝাতে চেয়েছিলাম সবাইকে আমরা তো বেশিরভাগই উদ্বাস্তু না আছে ঘর, না ঠিকানা,  না পেট ভরার মত কোন রসদ, সব সময় দয়া ভিক্ষা বা চুরি করা,  চুরি করে খাবার জোগাড় করা।  জীবন থেকে মুক্তি পেতে কি কি করতে হবে  তাই বলেছিলাম, সবাইকে বোঝাতে চেয়েছি অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত হয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। 
- আমারও বন্দী দশা  ভালো লাগে না ভাই
= এভাবেই চলছিল বিপ্লবের পাঠ।  হঠাৎ একদিন শহরে এসে পড়ি বাবার সাথে দেখা হয়ে যায় হাসপাতাল চত্বরে বাবা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে পালাচ্ছিল
- কেন
= পরিচয় অস্বীকার করবে বলে। রাগ হল খুব যার জন্য আমার মায়ের এত কষ্ট,  আমার,এত কষ্ট, চোরনী নামে মায়ের অপবাদ, ইচ্ছে হচ্ছিল  ঝাঁপিয়ে বাবার  ঘাড় মটকে  দি।  পারিনি বাবা তো। 
- আমরা তো এখনো সম্পর্কে বিশ্বাসী মানবতার পূজারী
- হাঁ রে  এ তো আমি তোকে শিখিয়েছি, শোন অন্য জাতিভাইদের  মুখে জানতে পারি আমার নাকি আরো কয়েকটা মা, ভাই আছে, বাবা এলাকার দলের সর্দার। 
- কি ভয়ংকর
- হ্যাঁ অন্য মা ভাই বোনদের উপর না বাবার উপর একরাশ ঘৃণা হয়েছিলো।  জিজ্ঞেস করেছিলাম  কেন আমাদের বিসর্জন দিলে? 
- কি বলল তোমার বাবা
- এটাই ধর্ম। ধোঁকা দেওয়ায় কাজ পুরাতন বিসর্জন দিয়ে নতুনত্ব কে আবাহন করতে হয়।  আমি অবাক হয়ে যাই।এইজন্য,এখনকার  নেতার মত চাটুকদারী কথা। মুহূর্তে  ওখান থেকে চলে আসি।  

- তবে যে  বলছিলে  জেলখানা
- সেটাই তোকে বলছি রাস্তায় ঘুরে ঘুরেই আমার জাতির লোকদের অনেক কে আমার স্বপ্নের কথা বলি,  ফ্যাক ফ্যাক করে  হেঁসে সবায়
পালিয়ে যায়। কেউবা বলে ন্যাকামো করো না সুযোগ পেলে খাবার ছিনিয়ে নাও।  সে সময় বুঝলাম...
- কি বুঝলে
- অধিকার, কাইম, সমাজতন্ত্র, প্রয়োগের ক্ষেত্র আলাদা আলাদা। 
- সমাজতন্ত্র কি গো
- ও, তোকে সহজ করে বলি, যে সমাজ ব্যবস্থায় সবাই সমান অধিকার ভোগ করে সেটাই সমাজতন্ত্র
- চলনা, আমরা স্বাধীনতা খুঁজি, সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠি। 
-  মনে তুমুল ঝড় ওঠে,  নিজের মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় হাজার প্রশ্ন, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি বারবার। শহুরে একটা পার্কে বসে আকাশের দিকে চেয়ে জীবনের কথা ভাবছিলাম হঠাৎ কানে এলো কি ভাইয়া করছো কি? তাকিয়ে দেখি
- কি দেখলে? 
- তোর  মত নাদুসনুদুস একটা কুকুর ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসছে।  তোর কথা খুব মনে পড়ে গেল কেঁদে উঠলো মনটা আমার। 
- তাই বুঝি!
- হ্যাঁ রে তোকে খুব মিস করছিলাম। কুকুর ভাই আমাকে বলল, আগে তো তোমায় এদিকে কোনদিন দেখিনি নতুন বুঝি? থাকো কোথায়?"। 
 আমি বললাম গাঁ  থেকে এসেছি।  ও বল্ল, বাউণ্ডুলে  বুঝি? কি মন চাই  না আস্তানা?  আমিও মাথা নাড়ি। ও বললো, "তোমাকে একটা পথ বলতে পারি তবে কি জানো ভাইয়া উপযাচক  হয়ে  কাউকে উপকার করলে পিছনে আঝোরা বাঁশ নিতে হয়। তোমাকে দেখে বেশ সহজ সরল মনে হচ্ছে তাই মায়া হলো তাই আমি.
একটা তোমার ব্যবস্থা করে দিতে পারি নিরম্বু উপবাস থেকে তো কমসেকম বাঁচবে। যদি তোমার ভালো লাগে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। মন চাইলে 
 যখন খুশি চলে যেতে পারো তোমার ইচ্ছে"। ওর কথা শুনে আমার খুব ভালো লেগে গেল চলে গেলাম ওর সাথে ওর মনিবের বাড়ি। 
- তাহলে জেলখানা বলছ কেন? 
= আরে বলছি বলছি।  কি আনন্দ ক'দিন। বাসার নাম দিয়েছে "আনন্দ নিকেতন"। কতো ধরনের কুকুর দেশী-বিদেশী কতো প্রজাতির সবার জন্য আলাদা আলাদা সুন্দর থাকার ব্যবস্থা ঠিক যেন ফাইভ স্টার হোটেল অত্যাধুনিক ব্যবস্থা. রুটিনমাফিক অনুশীলন. সাপ্তাহিক বডি চেকআপ,আরো কত কি। ঠিক যেন  আমার স্বপ্নের রাজ্য। 
- আমাকেও নিয়ে চলো না তোমার সঙ্গে...
= চুপ এসব লোক দেখানো টাকা রোজগারের কারখানা।  একটা রূপান্তর জীবন। নতুন নতুন কুকুর ক্রস করে  নতুন নতুন প্রজাতি চড়া দামে বিক্রি। কাজ শেষে আবার আমাদেও বিক্রি করে দেয়। আবার বিক্রি. এইভাবে হাত ফেরত হতে হতে এক বদ্ধ জুয়াড়ি,  মাতালের কাছে এসে পৌঁছায়।  

- সেকি গো? 
- চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আমার সারা দেহে কালশিটে দাগ  পড়ে গেছে । প্রথম বিক্রির সময় আমি কুকুর বন্ধুকে বলেছিলাম কেন আমাকে ধোঁকা  দিলে? ও হেসে বলেছিল, "বোকা ধোঁকা দেওয়াই আমার পেশা।  আমিও তো ধোঁকা খেয়ে এখানে এসেছি"।  কথাটা বলেই  হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, আমাকে জাপ্টে ধরে ছিল বলে ছিল, "ক্ষমা করে দিও"। আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। 
- মায়া হচ্ছিল খুব তাই না? 
 হবেই তো। এটাই তো জীবনের নতুন পাঠ বর্ণমালা।  একদিন সুযোগ এলো মনির আমাকে খোলা রেখে কোন এক জরুরি মিটিংয়ের চলে গেল। এসে গেল সুযোগ, মুক্তির আনন্দে মন মেতে উঠলো,  দিলাম চম্পাট, দৌড়...দৌড়...  দৌড়.. কত পথ  পেড়িয়ে অজানা অলি গলি পেড়িয়ে, বনবাদর পেড়িয়ে,  রাস্তাঘাট পেড়িয়ে, অনেক কষ্টে এইখানে। দুদিন থেকে এখানে বসে আছি। 
বৃষ্টির জলে ভিজে জবুথবু হয়েছি তবু বিশ্বাস ছিল তুই আসবি। তুই বেঁচে আছিস। 
- তুমি না ওই মন্দির দিকে আজ থেকে থেকো। আমি  তোমায় মাঝে মাঝে দেখতে আসবো। 
- না রে  থাকবো না। 
 তুই কি যাবি আমার সাথে?  আমি নতুন জীবন দেখতে চাই, সত্যি যাবি আমার সাথে? 
- হ্যাঁ গো আমি তোমার সাথে যেতে চাই আমাকে মুক্ত করো মুক্ত করো এই পরাধীন জীবন। আমি স্বাধীনতা চাই...
- চল আমরা যাই ফিরে সেই তপবন আশ্রম। ওখানেই শুরু করি নতুন জীবন, ঋদ্ধ  হই  ঋষিদের মাঝে থেকে।   শুরু করি শুদ্ধতার পাঠ, শুরু করি মঙ্গলাচরণ, শক্ত হয়ে ওঠে তৈরি করি নিজেদের মন মানসিকতার  বিকাশ।  সজীব করে তুলি মানবতা।  জীবনের শিক্ষা নিতে নিতে আশাবাদী হয়ে উঠি খুঁজে নি  সত্য পথের ঠিকানা। 

------------------------------
 অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক।  দুটি হৃদয় বড় কাছাকাছি আজ। একে অপরকে জাপ্টে ধরেছে,  টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ছে.....
চিবুক বেঁয়ে।  চোখে-মুখে বিস্ময়। হাওয়ার স্রোত বইতে শুরু করেছে,  মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে,  একটু পরেই অঝোড়ে  বৃষ্টি নামবে উঠে দাঁড়িয়েছে ডাব্বু কাব্বু, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে নতুন পথের  ঠিকানায়......

অভিজ্ঞতার পাঠশালায় নীরদ দত্ত


        অভিজ্ঞতার পাঠশালায়
                               নীরদ দত্ত
--------------------------------


যে শিশু চায়ের দোকানে
মনিবের চাবুক খেতে খেতে বড় হলো,
যে শিশু স্নেহ-ভালোবাসার মরুভূমিতে
কামারশালার দগ্ধ হাপরের মতো
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আর
অভিজ্ঞতার পাঠশালায় বঞ্চনার অক্ষরে
সাজানো "বর্ণপরিচয়" পড়তে পড়তে বড় হলো
আজ সে সমাজ চেতনায় দার্শনিক ৷
হয়তো তার সরকারি কোনো শংসাপত্র নেই
নেই তথাকথিত বিদ্বজ্জনদের মতো
আত্মকেন্দ্রিক জীবনের আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষা,
সে জানে না তার নিজস্বতাকে
নিলামের দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে
গিরগিটির মতো রঙ বদলাতে,
তাইতো সে আজও রবির রুদ্র দহনে
নগ্ন পায়ে খাদ্যের মিছিলে হাঁটে পথ,
উন্নত শিরে বজ্রমুষ্টিতে
আকাশকে ধরতে চায়
অনুকম্পাকে পদদলিত করে
অভিজ্ঞতার পাঠশালায় পুঞ্জিভূত
সমাজের শোষণ শাসনের নির্মমতাকে ভেঙে
পূবের সূর্যকে আপন করতে চায় ৷
********************************************

ছাত্র যখন শিক্ষক ডঃ সঞ্জীব রায়


ছাত্র যখন শিক্ষক
------------------------
ডঃ সঞ্জীব রায়
------------------------



রাহুল ছেলে হিসেবে বড়ই ভালো। একটাই দোষ, পড়াশোনায় মন নেই। বাবা-মা আর এক বোনকে নিয়ে সংসার। বেশ কষ্টেই চলে।  বাবা হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। নবম শ্রেণীর ছাত্র রাহুল পারলৌকিক ক্রিয়া মিটে যাওয়ার কয়েকদিন পর স্কুলে হাজির হয়।

প্রথম দিনেই দ্বিতীয় ক্লাসটি অনিলবাবুর, ইংরেজি। অত্যন্ত বদরাগী অনিলবাবু কারণে-অকারণে প্রহার করেন। সেদিন তিনি Tense পড়াচ্ছিলেন। রাহুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমার বাবা ৭দিন ধরে জ্বরে ভুগিতেছেন - এর ইংরেজি কী হবে?" পড়া না পারলে রাহুল চুপ করেই থাকে। সেদিন কি হলো, ছলছল চোখে বলে ফেলে "আমার বাবা একমাস আগে গত হয়েছেন।" ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা না বুঝেই হেসে ওঠে৷ রেগে অনিলবাবু পাগলের মত রাহুলকে প্রহার করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে হেডমাস্টারমশাই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে প্রচন্ড কাঁপতে থাকা রাহুলকে একটি ছেলের সঙ্গে বাড়ি পাঠান।

দুদিন পরে অনিলবাবু কি মনে করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিজের নাম গোপন করে রাহুলকে দেখতে যান। দরজার সামনে সাদা কাপড় পরিহিতা এক মহিলা নিজেকে রাহুলের মা বলে পরিচয় দিলেন। কঠিন হৃদয় অনিলবাবুর মূহুর্তের উপলব্ধি, হয়ত রাহুল সত্যি কথাই বলেছিল। জিজ্ঞাসা করেন "রাহুল এখন কেমন আছে ?" উত্তরে মা বলেন, "জ্বর আছে। দুজন সহপাঠী বলেছিল স্কুলের মাস্টারমশাই অনিলবাবু ওকে খুব প্রহার করেছেন। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করলে বলে - মা উনি খুব ভালো। আমি বন্ধুদের সঙ্গেই মারামারি করেছি।" অনিলবাবু আর বসতে চাননি।

বিদায় নেবার মুহূর্তে রাহুলের মা হাতজোড় করে বলেন, "মহাগুরুনিপাত বছর, খুব ভয়ে আছি ওকে নিয়ে। দয়া করে একটু আশীর্বাদ করে দেবেন।" অনিলবাবু তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 


গল্পঃ ফিরে পাওয়া

ফিরে পাওয়া

অর্পিতা মজুমদার

-----------



সোদপুর স্টেশন, বিকেল ৪:৩০টা- জনারণ্য! কোনরকমে ভিড় ঠেলে কল্যাণী সীমান্ত লোকালের মহিলা কামরায় উঠতে পারলো মেধা। হাতে দুটো ভারী ব্যাগ , কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। গন্তব্য ব্যারাকপুর।  মাত্র দুটো স্টেশন ।তাই বেশি ভেতরে গিয়ে তো লাভ নেই। এ সময় ট্রেনে অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড়। কামরায় ঢোকার মুখেই কয়েকজন মহিলা এমন ভাবে দাঁড়িয়ে যে একটুও এগোবার উপায় নেই। একেই তো আজ গুমোট গরম তার ওপর কামরার ভেতরে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এক মধ্যবয়সী মহিলা বলেই ফেললেন" এসময় কেউ দুটো ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠার সাহস দেখায়? " আর একজন তৎক্ষণাৎ সায় দিলেন" নেমে যান! নেমে যান! " এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাই সমীচীন মনে করলো মেধা। 

আজ তাড়াতাড়ি স্কুলে ছুটি হওয়ায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে, রেডিমেড সেন্টারে একটা অফার চলছিল, কেনাকাটা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। 

পরের স্টেশনে একজন অল্পবয়সী সুদর্শন যুবককে ওই কামরার গেটে দেখা গেল। দেখামাত্রই হৈচৈ শুরু হল। " এই ছোকরা! জাননা এটা মহিলা কামরা? " কী স্পর্ধা দেখেছো, আজকালকার ছেলেদের! " ইত্যাদি, ইত্যাদি। কমবেশি সবাই ছেলেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেধা ভাবলো ভালোই হয়েছে, সবার নজর এখন ছেলেটির দিকেই। 

ছেলেটিকে দেখল মেধা। মহিলা কামরায় ওঠা অন্যান্য ছেলেদের মতো তো লাগছে না! প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সুগঠিত মেদহীন শরীর, গায়ের রং বেশ পরিষ্কার, চোখে রোদ চশমা। সব রকম কটুক্তি উপেক্ষা করে, ছেলেটি হাওয়া খেতে খেতে চললো। 

ব্যারাকপুরে ট্রেনটি প্লাটফর্ম বদল করায়, নামার সময় মেধা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে  পড়ার উপক্রম হল, কিন্তু কেউ যেন অতি যত্নে ব্যাগ দুটো সামলে হাত ধরে মেধাকে নামতে সাহায্য করলো। 

" আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাম?  আমায় চিনতে পারেননি আপনি ? আমি তো সোদপুর স্টেশনেই আপনাকে দেখে চিনতে পেরেছি" । ছেলেটি সহাস্যে বললো। রোদ চশমাটা খুলে ফেলেছে ছেলেটি। 

এবারে মনে পড়েছে। ছেলেটির নাম হারুন। ব্যারাকপুর গান্ধী ঘাটে বেলুন বিক্রি করে পড়াশোনা চালাতো। স্কুলে তো বটেই, মেধা নিজের বাড়িতেও দুবছর পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলো  হারুনকে। তবে কিছু দামি বই আর ক্যালকুলেটর ফেরত দেয়নি বলে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিল মেধা। 

" আমি এখন বায়ুসেনা অফিসার ম্যাম। আপনি সেই সময় আমার পাশে না থাকলে আজ হয়তো এ জায়গায় আমি পৌঁছাতে পারতাম না। আজই কলকাতায় এসেছি। আপনার দেওয়া বইগুলো এবং ক্যালকুলেটর কাল আমি স্কুলে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসব ।আমার কাছে ওগুলো যত্ন করে রাখা আছে"। 

আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে মেধা বলার চেষ্টা করল" থাক না সেসব! "

" আমার মতন অনেকে আছে ম্যাম, তাদের ওগুলো প্রয়োজন হবে"। হারুন হাতজোড় করে বলল। মেধা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সব  বিরক্তি এক নিমেষেই খুশিতে পরিণত হয়েছে তার। 

কিছুই তো হারায় নি!  কিছুই হারায় না। সব ফিরে আসে, সুদ সমেত!

নিভু দীপের ধোঁয়া -- গৌতম তরফদার


নিভু দীপের ধোঁয়া
------------------------ 
 গৌতম তরফদার
--------------------------


          বিচ্ছেদের আজ সাত বছর পূর্ণ হলো। সকালেই গৌড় এক্সপ্রেসে মালদা টাউন স্টেশনে নেমে ই-রিক্সায় সোজা বাড়ি পঞ্চমীর সকালে ঋচীক দাসগুপ্ত। মা অধীর অপেক্ষায় ছিল। প্রায় সাত মাস পরে ছেলে বাড়ি এল। বাবা তিন বছর আগেই গত হয়েছেন। বাড়িতে এখন শুধুমাত্র মা আর কাজের মাসি মন্দা। সেও প্রায় ১০ বছর ধরে মায়ের সাথেই আছে এই পরিবারের একজন হয়ে।

         ভালোবাসার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র তিন বছর পুবালি দে'র সাথে। তখন কলেজে পড়ে। দু'জনেই একই শহরে থাকার সুবাদে ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ কখনও রেস্টুরেন্টে, কখনও সিনেমাহলে নতুবা পার্কে। শেষ বছরে তৃতীয় জনের প্রবেশ। শৈবাল কাঞ্জিলাল। রীতিমত ধনী ঘরের দুলাল। ঠাটেবাঁটে, হাবভাবে, প্রাচুর্যের জোয়ারে পুবালি ভেসে গেল। ঋচীক-কে এড়িয়ে যাওয়া শুরু। কিন্তু ঋচীক পুবালির প্রেমে পাগল। অল্পদিনেই অবজ্ঞার চরমরূপ দেখতে পেল ঋচীক। ঠিক সাত বছর আগে এই পঞ্চমীর দিন রথবাড়ি মোড়ে সন্ধ্যায় ঋচীক একাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুর্গাপূজা প্যান্ডেলের লাইটিং দেখছিল। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল সামনে এসে দাঁড়াল। শৈবালের পেছনে পুবালি বসে। নেমে এসেই পুবালি কর্কশভাবে বলল," আজ আমাকে এতবার ফোন করে ডিস্টার্ব করেছ কেন?  তোমার সাথে তো আমার কথা নেই। নিছক বন্ধুত্ব ছিল। তার বেশী কিছু নয়। এরপর আর কোনোদিন আমাকে ডিস্টার্ব করবে না বলে দিলাম।" 

        এরপর শৈবালও নেমে এল। সরাসরি বলল," মজা দেখাবো তোকে। প্রস্তুত থাকিস "। ওরা চলে যেতেই কয়েকটা ছেলে এল। কিছু বোঝার আগেই সজোরে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিল ঋচীকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেল। চারিদিকে শারদীয়া পূজার  জ্বলতে থাকা হাজার দীপের আলো যেন নিভে গিয়ে দু'চোখ ধোঁয়াতে ভরে গেল। 

         সেই শেষ। ঋচীক মাস্টার্স করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। পড়া শেষ হতেই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বি গ্রেডে অফিসার পদে চাকরি। দীঘায় পোস্টিং। মালদা ছাড়লো চাকরি পেয়ে। কয়েকমাস বাদে বাদে বাড়ি আসে। মায়ের আবদার এড়িয়ে আজও বিয়েই করেনি। বিয়ে আর করবে না ভেবেই নিয়েছে। 

       সারা দুপুর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঠিক সন্ধ্যার মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি পূজার প্যান্ডেল গুলো দেখতে শুরু করল। দিশারী সংঘের পূজো প্যান্ডেলের কাছে যেতেই দেখে দর্শনার্থীর ভীষণ ভিড়। হঠাৎ দেখে প্যান্ডেল থেকে সামান্য দূরে একটা বছর তিনেকের ফুটফুটে মেয়ে অঝোরে কাঁদছে।  কয়েকজন তাকে ঘিরে রয়েছে। কাছে গিয়ে জানল সে তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এত ভিড়ে হয়তো হারিয়ে ফেলছে। ঋচীক মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। "কেঁদো না সোনা মেয়ে। তোমার মাকে আমি এক্ষুনি  খুঁজে দিচ্ছি। 

    -- কী নাম তোমার? তোমার মায়ের নাম কী?
    -- আমি পুচকি।  আমার মা পুবালি। 

  চমকে গেল ঋচীক। সেই নয় তো? আবার জিজ্ঞেস করল, " তোমার বাবার নাম কী? " 

   -- আমার বাবা শৈবাল। বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে। 

     ঋচীক দ্রুত ক'জনের সাথে ভিড় ঠেলে প্যান্ডেলে পৌঁছে মাইকে ঘোষণা করিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিন-চারজন মহিলা একসাথে এল। হ্যাঁ, তারমধ্যে পুবালি একজন। কিন্ত একী চেহারা হয়েছে পুবালির! রোগা, গাল বসা, চোখের কোণে কালির প্রলেপ। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। 

       ঋচীক মেয়েকে পুবালির কোলে সঁপে দিল। পুবালির দু'চোখ জলে ভরে গেল। একদৃষ্টে ঋচীকের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। 

       ঋচীক আজ আবার হাজার দীপের আলো নিভে যেতে আর ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখল।


মৌমিতা সরকার


তিন টাকার গল্প
-----------------------
মৌমিতা সরকার
 ----------------------- 


-"তিনটে টাকা দিবি?"
ব্যান্ডেলের তিন নং প্ল্যাটফর্মে ডাউন ট্রেনের জন্য আনমনে অপেক্ষা করার সময় আচমকা সম্বিত ফিরল এই প্রশ্নে। পিছন ঘুরে দেখি একটা বুড়ি, শতচ্ছিন্ন,  মলিন একটা শাড়ি পড়ে ডান হাত টা বাড়িয়ে বসে আছে। ওর দিকে তাকাতেই ফোকলা মাড়ি বার করে নিষ্পাপ একটা হাসি হেসে আবার বলল-
-"দিবি তিনটে টাকা?"

এই স্টেশনে পাগলীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হঠাৎ যদি কোনো পাগলীকে দু হাত বাড়িয়ে কোনো এক অসহায় নিত্যযাত্রীর পিছনে দৌড়তে দেখা যায় ( উদ্দেশ্য কখনও কখনও বলপূর্বক চুম্বনও হতে পারে) তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে যাই হোক, তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম গত তিন চারদিন স্কুলের half yearly পরীক্ষার খাতা দেখার চাপে লোকজনের সাথে কথা বলার তেমন সময় পাইনি। হলই বা একটা পাগলী, খানিকটা গল্প করা যাক।

-"দিবি না? একটা, দুটো, তিনটে টাকা?"
-" হ্যাঁ, দেবো তো। তা তুমি এইরকম ঝড়-জলের দিনে স্টেশনে বসে ভিক্ষা করছ কেন? ঘর বর নেই? না ছেলে বউ দেখে না?"
-" কি বললি? ঘর, বর, ছেলে!! হ্যা হ্যা হ্যা...সব ছিল, সব। কপাল বুঝলি?"
-" না বুঝলাম না। নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিয়েছে?"
-" তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই দেখ আকাশ টা দেখ। ওই আকশের ওপারে নাকি বলে ভগবান আছে। চোখে ছানি পড়েছে তো। আমি আর তাকে দেখতে পাই না। তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, বুঝলি? ওই শা' ভগবান আমায় ঘর বর ছেলে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর ওই তিনটে শব্দ, ওই তিনটে শব্দ তাড়িয়ে মারছে আমায়। যেদিকে যাই।"

বুঝলাম মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বেশ কিছুটা।  ট্রেন আসতে তখনও খানিক দেরি। কিন্তু আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে।

-"আচ্ছা, তোমায় ওরা এমনি এমনি তাড়িয়ে দিলো? ভালোবসেনি কখনও? "
-" হ্যা হ্যা হ্যা.....খুব বেসেছে।  ওইরকম ভালো আর কেউ বাসেনি বুঝলি? বর আমার খুব খেয়াল রাখত। সাত বাড়ি কাজ করে বাড়ি ফিরতাম যখন, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। সে মুখখারাপ করত খুব, কিন্তু রান্না করে দিত। আর রাতের বেলা আদর করত খুব। কিন্তু ওই যে ওলাউঠো ভগবান! সহ্য হল তার? হঠাৎ করে একদিন সে ঘুম থেকে আর উঠল না রে। সে কি ঘুম.... কি ঘুম। আমার কেন এমন ঘুম হয় না? গুনে গুনেও ঘুম হয় না।
এক..দুই...তিন
এক..দুই...তিন।"
-"আর তোমার ছেলে?"
-" আমার ছেলে....আমার ছেলে...."
-" হ্যাঁগো তুমি বললে না? ঘর...বর...ছেলে।"
-" সেদিন রাতে তাকে নিয়ে চলেই গেলো।  ভোটের সময়। খুব অন্ধকার।  সবে সবে ঘুমিয়েছে সে। দরজায় তিনটে টোকা। খুলতেই হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়ল একদল লোক। তারপর কি মার মারল রে আমার ওই বাচ্চা ছেলেটা কে। ওদের বুক কি পাথর দিয়ে গড়া? হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। হাতে ধরে,  পায়ে পড়েও আটকাত পারলাম না। আমার দেবশিশু টা রে, আমার বাপ, আমার কোলজোড়ানো হাসি... 
কালী পুজোর বলির সময় ছাগলটা যে শেষ ডাকটা ডাকে, আমি তখন ছেলের মুখে সেই ডাকটা শুনেছিলাম। তারপর...তারপর..."
-"তারপর?"
-"তারপর ওই তিনটে আওয়াজ। ফট, ফট, ফট। আমার ছেলের আওয়াজ তখন থেমে গেছে। আমি আর ভাবতে পারি না, আর..আর গুনতে পারি না। এক..দুই...তিন...তারপর তো সবকিছু হারিয়ে গেছে।
.........................
দিবি? আমায় তিনটে টাকা?"

ট্রেন টা আসতেই ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।  পাগলীটার ঘোলাটে চোখে এক পৃথিবী কষ্ট। আমার কিছু বলার নেই। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যা ছিল সবটাই বার করলাম। শুনেছি নাকি, কাউকে দিতে গেলে হাতে যা ওঠে তাই দিতে হয়। হাতে উঠলো ওই তিনটে টাকাই। কপাল! ভেবেছিলাম কিছু বেশিই দেবো। টাকাগুলো দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়ল। মুখ বাড়িয়ে দেখি, সে আপন মনে গুনেই যাচ্ছে,
এক....দুই....তিন*********

Tuesday, October 5, 2021

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে 
অনিল চন্দ্র সিকদার
------------------------------ 


গ্রামে মানুষ থাকলে ভূতও থাকবে। মানুষ আছে ভূত নেই, ছেলে বেলায় আমরা ওটা কল্পনা করতে পারতামনা। আমাদের বাড়িটার সামনে পুকুর, দক্ষিণে খাল, খালটা গেছে সেনদের বাড়ির পাশ দিয়ে। মাঝখানের জায়গা টা অন্য কারোর। বড় একটা আম বাগান। পিছনে একটা জামরুল গাছ, আর আমাদের  আম বাগান। আমগাছ গুলি এত বড় যে ঐ গাছ বট গাছের মত। উঠাও  মুস্কিল। 
আমগাছের পাশে ঘন  বেতের জঙ্গল চারিদিকে ঘন অন্ধকার। কাছেও যাওয়া যায়না। গাছে বড় বড় অজস্র কাঁঠ পিঁপড়ে। গায়ে রসুন গোটা তেল মেখে না উঠলে, কারো সাধ্য নেই  গাছে উঠে। 
এহেন ঐ বিশাল গাছটায় এক ভুতের আবাস ছিল। 
অগম্য জায়গা হলেই আমাদের ধারনা হয়, ওখানে 
ভুত থাকে। রাতে আমরা কোনো ভাই বোনেরা  একলা  ঘর থেকে বের হতে সাহস পেতামনা। 

ন-বছরে আমার উপনয়ন হয়। উপবীত হয়ে ও আমাকে ভূতের  ভয় থেকে রক্ষা করতে পারেনি। 
ছোট কাকা বাড়ি না থাকলে আমার কিংবা বড় দারপালা পড়তো ঠাকুরের বৈকালি দেওয়ার। ভূতের ভয় থেকে গৃহদেবতা  ও তখন  মুক্ত  থাকতেন না। ঠাকুর ঘরের পাশে ছিল দুটো বড় তালগাছ। তাল হত না। কোন অশুভ প্রভাব না থাকলে গাছ অন্যান্য হয়না। তাই মনে  হচ্ছে আমাদের কাছাকাছি যিনি থাকেন  ওনি আমাদের ছোটো ঠাকুর দা। তাঁর পৈতা হওয়ার আগেই নাকি তিনি সামনের পুকুর টার জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। তালগাছ দুটো তাঁরই লাগানো। ছোট বয়সেই ছোট ঠাকুর দার গাছ পালার বাতিক ছিল। 
তালগাছ  আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। 

যাই হোক ছোট ঠাকুর দা মারা যাওয়ার পর বড় ঠাকুর দা গয়া ধামে গিয়ে পিন্ড দান ও করেছেন। অথচ তারপরও নাকি বড় ঠাকুর দাঐ তালগাছে ছোট ঠাকুর দাকে কয়েকবার দেখেছেন। বিশাল
দৈত্যের মত চেহারা এক পা তালগাছে আর এক পা আমগাছে দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর আমাদের  বাড়ির দিকে  তাকিয়ে  বাড়ি পাহারা দিতেন। ছোট ঠাকুর দা  ভূতটি বরং আমাদের কোন ক্ষতি করেননি, ভালই করেছেন। বরং  তারই দয়ায় নাকি আমাদের বাড়িতে অপমৃত্যু ও অকাল মৃত্যু ঘটেনি। শিশুদেরকে টৌকায় ধরে না। বাড়িতে শিশু  জন্মালে মরেনি। বাঁচে বড় হয়। সবারই ধারণা ছোটো ঠাকুর দা আছে বলেই বাড়ির সবাই ভাল আছে। ভূত যেমনটা ভাল আবার তেমনটা  খারাপ ও আছে।

Wednesday, September 1, 2021

বোধন

বোধন
শিপ্রা বসাক 


ওপারে কাশফুলের পেছনে সূর্য হাসছে  ,
বাজছে আগমনীর বাজনা  ,
আকাশে বাতাসে আনন্দের হুল্লোড়  ,
মজা-বিলের বুকে এসেছে যৌবনের জোয়ার  ,
আনন্দে খুশি খুশি পদ্মের কুঁড়ি 
গ্রাম শহর আজ একাকার উপচানো আনন্দের বন্যায় 
প্রকৃতি ও মানুষ  মিলেমিশে একাকার 

এপারে হারানের ছোট্ট ঘরে সদ্যফোঁটা পদ্মকুঁড়ি 
লালচে ঠোঁট, জুলুজুলু চোখে দেখছে নতুন পৃথিবী 
নবজাতকের সুতীব্র চীৎকারে ভাসছে হারানের ঘর 
আজলাভরে শিউলি কুড়িয়ে এনেছে হারান  ।
নবজাত কন্যার পায়ে অঞ্জলি দেয়
মাগো,  আমি মন্ত্র জানি না,  হোম জানি না, 
শুধু জানি শিউলির গন্ধ নিয়ে 
আমার ভাঙাঘরে তুই আমার দুর্গা  ,
তোর ছোট্ট ছোট্ট চোখে আমার এক পৃথিবী আলো  ,
ছোট্ট ছোট্ট হাতে বরাভয়  ,
সমস্ত অন্যায়ের উর্দ্ধে উঠুক তোর মুষ্টি, 
অপরাধের অন্ধকারে জ্বলে উঠুক তোর ত্রিনয়ন  ,
তোর দয়ায় যেন প্রাণ পায় অসহায়  ।
তোর হুঙ্কারে কেঁপে উঠুক দুর্বার  ,
স্তব্ধ হোক উৎপীড়কের উদ্দাম নৃত্য, 
পৃথিবী জুড়ে সমস্ত পিতার বুক ভরে উঠুক কন্যাগর্বে  ,
বারবার সংকটমুহূর্তে আবির্ভাব ঘটুক দানবদলনীর
ধ্বংস হোক রক্তবীজের বংশধর 

ঢাক বেজে ওঠে ড্যাং ড্যাডাং, ড্যাং ড্যাডাং, ড্যাং ড্যাডাং 
সঙ্গতে কাসর,  শঙ্খধ্বনিতে মেতে ওঠে 
শরতের আকাশ বাতাস  ----
স্নিগ্ধ হাসিতে বোধন সম্পন্ন হয়, 
চিন্ময়ী মিশে যায় মৃন্ময়ীর আবছায়ায়  ,
মৃন্ময়ী চিন্ময়ীর মায়ায়। 
হারান আনন্দ-অশ্রুতে প্রণাম জানায় 
মৃন্ময়ীর উদ্দেশ্যে, বুকে তার ছোট্ট চিন্ময়ী  ।

Sunday, August 8, 2021

সুমনা মন্ডল

প্রকৃত অন্ত্যমিল
সুমনা মণ্ডল
-----------------------------


বাস্তব থাক রাজপ্রাসাদে
        স্বপ্ন কুঁড়ে ঘরে, 
মুহূর্তেরা থমকে থাকুক
          নষ্ট অবসরে ।
ঘুমের দেশে স্বপ্ন ছুঁয়ে
        তন্দ্রা ফিরুক ঘরে, 
বাদল চিরে বর্ষা নামুক
         ক্লান্ত শহর জুড়ে ।
অলস কলম ভেঙ্গে আড়মোড়া
          করুক চিৎকার, 
স্তব্ধতাকে হনন করুক
           নীরব অন্ধকার ।
ছন্দ ভাঙ্গুক গণ্ডী তার ই
            কাব্য অনাবিল, 
শিহরণ জাগা শব্দ গড়ুক
             প্রকৃত অন্ত্যমিল ।

পবিত্র প্রসাদ গুহ

 প্রসাদ গুহ
পাট ভিজেছে জলে
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●
    পাট ভিজেছে জলে
●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●


বৃষ্টি ঝরে                    আষাঢ় মাসে
            পাটের ক্ষেতে জল
জল নেচেছে              ফেনিল সাদা
              কী মজা তুই বল!
আলের গালে              জলের চুম্বন
            মুখ তুলে আল চায়
গলা জলে                       স্নাত হয়ে
               মেঠো জল খায়।
পাট ভিজেছে                সিক্ত গায়ে
              তৃষ্ণা মেটায় ধড়ে
লম্বা সরু                    এক পায়েতে
            দাঁড়িয়ে শোভা ভরে।
স্নিগ্ধ সবুজ               পাটের ক্ষেতে
              জল টলমল করে
ভেকের ডাকে            ছন্দে বিভোর
            উদাসী আষাঢ় ঝরে।
পাতার গায়ে             জলের লেপন
           রূপোলি ফোঁটায় পড়ে
টপটপিয়ে জল         পড়ছে ক্ষেতে
                মেঠো জল নড়ে।

●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●

পাদক

গলুর পরীক্ষা
পাদক

মাষ্টারমশাই সন্ধ্যে বেলায় পড়াতে এসে দেখেন গলু ঘরের দরজা জানালা  বন্ধ করে চিৎকার করে বই পড়ছে।বছর ষাটের বিমল মাষ্টারমশাই  গলুর পড়ার ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসতেই.... গলু বিনয়ী হয়ে বলে..মাষ্টারমশাই.. মাষ্টারমশাই..,আজ আমার পড়া একদম রেডি।আপনি ধরুন,সব প্রশ্নের উত্তর জলের মতো দিয়ে দেব। একথা কানে যেতেই গলুর মা অতসী দেবী তড়িঘড়ি  পড়ার ঘরে ডুকে বলেন...

না না মাষ্টারমশাই,ওর কথা শুনবেন না, ওকে লিখতে দিন...আজ পড়া না পারলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেবেন।সারা দিনটাই দুষ্টুমি আর দুষ্টুমি... বই নিয়ে বসাতেই পারিনি।বলে বলে আপনি আসার আগে এই বই নিয়ে বসেছে।এমন করে পড়লে কি ক্লাস এইটের পড়া তৈরি হয় মাষ্টারমশাই?আর পড়া না হলে যে করে হোক পড়া করিয়ে ছাড়বেন...এই বলে অতসী দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই গলু মাষ্টারমশাই এর দিকে মুখটা ঝুঁকে বলে...জানেন মাষ্টারমশাই?দিদিমা সেদিন বলছিলেন,আমার ক্লাসে যখন মা পড়তো তখন দিদিমা মাকে খুব বকাবকি করতো।মা একটুও বই পড়তো না।তাই মা পড়া না পারলে মায়ের মাষ্টারমশাইও মাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিতেন..তাই মা আমার উপর হিংসে করে এ সব বলে‌ গেল.. 

মাষ্টারমশাই একটু রেগে চেঁচিয়ে বললেন আচ্ছা ঠিক আছে। খাতা পেন বার কর।গলু ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে খাতা পেন বার করতে করতে বলে.. মাষ্টারমশাই পড়া ধরুন না...সব পড়া জলের মতো বলে দেব...গলুর কথা শেষ হতে না হতেই মাষ্টারমশাই ধমক দিয়ে বলেন,যা বলছি তাই শোন,তোমার ভূগোল পড়া কি তৈরি হয়েছে?লিখতে দিলে পারবে তো?গলু মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যাঁ হয়েছে,লিখতে দিলে পারবো।ঠিক আছে তাহলে ভূগোল পরীক্ষা দাও তো দেখি কেমন তৈরি? পরীক্ষার কথায় গলু চমকে ওঠে।কারণ বিগত দিনে মাষ্টারমশাই যে পরীক্ষা গুলো নিয়েছিলেন তাতে গলুর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে মাষ্টারমশাইয়ের কাছে অনেক কঠিন কঠিন শাস্তি তাকে পেতে হয়েছে।তার উপর মায়ের হাতের চড়।তাই গলু প্রথম থেকে চেষ্টা করছিল মাষ্টারমশাই যাতে পরীক্ষা না নেন।সব চেষ্টা ব্যার্থ হলে গলু মাথাটা নীচু করে বলে, মাষ্টারমশাই, হাতের আঙ্গুলটা খুব ব্যথা,লিখতে পারছিনা,পড়াটা একটু ধরুন না?গলুর মতলব বুঝতে পেরে মাষ্টারমশাই জোরে ধমক দিয়ে বলেন... পুরুষ মানুষ হয়ে এতো ভয় কিসের?রাবণ সীতাকে হরণ করলে সীতাকে তাঁর সতীত্ব প্রমান করতে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।আর তুমি? পুরুষ হয়েও পারবে না কেমন পড়া করেছ তার প্রমান করতে পরীক্ষা দিতে?নাও  কথা না বাড়িয়ে প্রশ্ন লেখ..

অগত্যা গলুকে পরীক্ষা দিতে হল। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর লিখতে লিখতে গলু ভাবছে সীতার অগ্নি পরীক্ষা আর আমার ভূগোল পরীক্ষার মধ্যে মিল কোথায়? মাষ্টারমশাই এমন বললেন কেন? এসব ভাবনা চিন্তা করতে করতে পরীক্ষা শেষ করে মাষ্টারমশাইয়ের কাছে গলু খাতা জমা দেওয়ার সময় বলে..আচ্ছা মাষ্টারমশাই সেই পরীক্ষায় সীতা কতো নম্বর পেয়ে পাশ করেছিলেন? মাষ্টারমশাই একথার উত্তর না দিয়ে খাতা দেখতে শুরু করেন...

মাষ্টারমশাই খাতা দেখতে গিয়ে দেখেন..ভারতে বৃহত্তম রাজ্য চীন,ভারতের বৃহত্তম প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাজস্থান এমন সব প্রশ্নের উত্তর গলু  উল্টোপাল্টা লিখেছে।গলু অতি কষ্টে কুড়ির মধ্যে সাত পেয়েছে। সেই পুরানো শাস্তি, কান ধরে হাফ চেয়ার। কিছু বকাঝকা করে মাষ্টারমশাই অন্যত্র পড়াতে চলে গেলেন। মাষ্টারমশাই চলে যেতেই  পিঠে মায়ের হাতের প্রকান্ড চড়।মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। সেদিন রাতে গলু শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে সীতার অগ্নি পরীক্ষা আর ভূগোল পরীক্ষার মধ্যে মিল কোথায়...?

পরের দিন বিকাল থেকে আকাশে মেঘ। সন্ধ্যে বেলায় ঝড় বৃষ্টি আসলে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে ভেবে অতসী দেবী পড়ার ঘরে হ্যারিকেনটা ধরিয়ে জোর কম করে পড়ার টেবিলের পাশে রেখে দিয়েছে...

শীতের রাত বাইরে খুব ঠান্ডা।গলু খাটে বসে গায়ে চাদর জড়িয়ে শব্দ করে পড়ছে।এমন সময় মাষ্টারমশাই ঘরের  চেয়ারে বসে বললেন..কি গলু পড়ায় যে আজ খুব মন দিয়েছ?মা কি কাল একটু পিটিয়েছেন?গলু একটু মুচকি হেসে বললো..হ্যাঁ মাষ্টারমশাই, পরীক্ষা ভালো হয়নি বলে মেরেছে।এবার ভাবছি আর দুষ্টুমি না করে পড়ায় মন দেব...।তা বেশ বেশ, মন দিয়ে পড়..এই বলে মাষ্টারমশাই গলুকে পড়াগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিতে বললেন।গুলো পড়ছে কিন্তু কোথায় যেন একটু অস্থির হচ্ছে।এমন সময় বিদ্যুত চলে যেতেই... ওরে বাবারে..আমাকে বাঁচাও.. বাঁচাও,বলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে মাষ্টারমশাই মেঝোতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন।চিৎকার শুনে  পাশের ঘরের সব ছুটে এসে দেখলেন মাষ্টারমশাই গলা চেপে ধরে গোঙাছেন,গলু খাটে বসে সেই দিকে তাকিয়ে বসে।বাড়ির সবাই এক স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে মাষ্টারমশাই?কি হয়েছে? উত্তর না পেয়ে গলুর বাবা নিমাই বাবু মাষ্টারমশাইকে তুলে ধরে বসিয়ে দেন।  ঘাড়ে মাথায় চোখে মুখে একটু জল দেন। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় দেখলেন মাষ্টারমশাইয়ের গলায় একটা কালো মতো কি যেন পেঁচিয়ে!।অতসী দেবী হ্যারিকেনের আলোটা কাছে এনে দেখেন মাষ্টারমশাইয়ের গলায় পাকানো কালো দড়ি ঝুলছে,যেটা নিয়ে গলু সকালের‌ দিকে একবার ঘুরছিল।ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে চোখে মুখের জল গায়ে পড়ে জামা কাপড় ভিজে যাওয়ায় ঠান্ডায় মাষ্টারমশাইকে কাঁপতে দেখে নিমাই বাবু একটা চাদর দিয়ে মাষ্টারমশাইকে গায়ে দিতে বলে ঘরের বাইরে চলে গেলেন...

গলু বিলক্ষণ জানে মাষ্টারমশাই বাড়ি থেকে যাওয়ার পর কপালে কি আছে। তবু সাহস মাষ্টারমশাইয়ের কানের কাছে মুখ রেখে গলু বলে,আপনার এতো ভয় কেন?দেখেন না, মা মনসার মাথায় কতো সাপ?তার তো কোন ভয় নেই।আর আপনি পুরুষ মানুষ হয়েও একটা দড়ির এতো ভয় পান?ভয়কে জয় করতে হবে মাষ্টারমশাই তাই আমি আজ পড়ায় মন দিয়েছি...

গলু সত্যি পড়াশুনায় মন দিয়েছিল কিনা সেটা গলুই জানে। কিন্তু এটা জানা গিয়েছিল যে,সে দিনের পর থেকে মাষ্টারমশাই আর গলুর বাড়ির ত্রিসীমানায় আসেননি।

অমিতাভ চক্রবর্তী

বৃষ্টি মুখর রাত
--------------------
অমিতাভ চক্রবর্তী
***************************


ক্রমশ রাত গভীর হচ্ছে আকাশ স্বচ্ছ না হলেও
মুষল ধারাপাত নেই - টিপ টিপ মাঝে মাঝে আবার  স্মিত এক চিলতে হাসির মত পরিবেশের ইষৎ উষ্ণতা আছে!
বিকেলের এক পশলা বৃষ্টির জল জমে
থৈ থৈ করে রেখেছে গাছের টব গুলো!
নিবিড় এই বৃষ্টির শব্দ বুকে অজানা
এক দুঃখ বীজ বপন করছে !
নিয়তির মতোই তুমিও বুকের তলায়
আসন পেতে বসে আছো!
আমার দিন রাত কেড়ে নিয়ে প্রায়
নিঃস্ব করে দিয়েছো!
এ শূন্য ঝুলি থেকে কি দিতে পারি আমি! কি দিতে পারি!
হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল?
কবিদের কি বয়স বাড়ে? না ফুরিয়ে যায়! 
এই বদলা রাতে সমস্ত ভালোলাগা আর
ভালোবাসার স্মৃতি এসে জড়ো হয়!
তোমায় খুব মনে পড়ছে!
জানি না কি চাই?
বহুদিন থেকে গভীর শিকড় গেড়ে একটা অলৌকিক সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে!
শারীরিক সান্নিধ্য ? জানি না!
তবে সান্নিধ্য চাই..
স্পর্শ -এসে ধরছে কেন হাত?
বিকেলে আজ বৃষ্টিতে ভিজলাম
প্রথম বর্ষণের আনন্দে !
পার্কে ছোকরাদের দল ও গড়াগড়ি
খাচ্ছিল ভেজা ঘাসে শুয়ে
একদম অন্য অনুভব!
একাই ভিজছিলাম ! কিন্ত সত্যি কি
একা ছিলাম?
তুমি ছিলে তো পাশে, তোমার হাত
ছুঁয়েছে আমার কণ্ঠ!
"সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হওয়ার পরে
অঙ্গ বিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গে ভরে "
আমার সমস্ত কিছুর মাঝে তুমি ফুলের
রেণুর মত মিশে থেকো কি করে!
তোমায় তেমন করে পেতে কি পারি না আমি?
সত্যি বলতে কি হয়তো তেমন করে
পেতে চাইও না তোমাকে!
কি জানি সশরীরে যদি তুমি কোনদিন আমার সামনে এসে দাঁড়াও কি করবো জানি না!
অমোঘ টানে বার বার ঘুরে ফিরে
তোমার কাছেই আসি!
তোমার ওই ছোট ছোট উৎকণ্ঠা,
দুশ্চিন্তা গুলো আমার পিঠে কেমন যেন
সোহাগী আদরের মত হাত বুলিয়ে যায়!
আমিও বাউলের একতারার তারে হাত বুলিয়ে বলি -
বাতাস সুগন্ধী হও, উষ্ণতা নিরাময় কর
সর্বোব্যাপী ভালোবাসার কার্পেটে ঢাকুক মেঝে!
তোমাকে আমি ফেরাতে পারি না কোন ভাবেই,
অমোঘ নিয়তির মত সুক্ষ বৈদ্যুতিক তারে
যেন জড়িয়ে আছো,
আর আমি বিনীত হয়ে আছি চন্দন বাতাসে,
অলৌকিক আলোর ফুলকি আর বুকে ছেঁকার দাগ নিয়ে  সব অনুভব অস্তিত্ব
কেড়ে নেয় মায়াবতী জাহাজ!
ছিন্ন পাতায় সাজাই তরণী তোমার
অনুভূতি নিয়ে একা একাই করি
খেলা সারাদিন রাত ...

স্বপন গায়েন

পিছু টান
---------------
স্বপন গায়েন
**********************


পিছুটান আছে বলেই মানুষ আজও বেঁচে আছে
কঠিন সময়কে বুকে জড়িয়ে আছে চিরকালের জন্যে
রোদ মাখা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফেরে সব্বাই।

পিছুটান আছে বলেই মানুষ মরতে গিয়েও মরতে পারে না
জীবনের লড়াইটা সঙ্গী করে বার বার ঘরে ফিরে আসে
জলপ্রপাতের শব্দে হৃদয় দুয়ার খুলে যায় পিছুটানের তাগিদে।

পরিবার বড়ই মায়াময় ভালোবাসার সংসার -
স্ত্রী সন্তান কিংবা আত্মীয়দের অমর বন্ধনেই বেঁচে থাকে মানুষ
ভালোবাসার মোহরকুঞ্জে আজও জীবনটা তাই অনেক রঙিন।

আষাঢ়ের মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে অবিরাম ধারায় ...
পিছুটানহীন মানুষ আজও খুঁজে বেড়ায় স্মৃতির পাতার কোলাজ
শৈশবের বারান্দায় উঁকি দেয় ফেলা আসা ধূসর রোদ্দুর।

পাখিদের কলতান শুনে ফিরে তাকায় তার মাটির বাড়ির দিকে
আজও ঝরে যাওয়া বকুলের গন্ধে ভরে ওঠে হৃদয়ের উদ্যান
পিছুটান আছে বলেই মাটির পৃথিবী এতো অপরূপ মায়াময়।

      *******

তুষার কান্তি হীরা

প্রতিবেশী
---------------
তুষার কান্তি হীরা
---------------------------


প্রতিবেশী বড়ো আপন
যদিও হয় পর,
বসত করি মিলে মিশে
পাশাপাশি ঘর।

অন্যের বিপদ নিজের বিপদ
মনে করি তাই,
উদ্ধার করতে মিলে সাথে
সবাই ছুটে যাই।

ঝগড়া-বিবাদ করি আবার
ভুলি সকল রাগ,
দুঃখ-খুশি সবটা করি
সমান সমান ভাগ।

পরামর্শ করে চলি
যেন আপন ভাই,
দুঃখসুখের মাঝে মোরা
খুশি আছি তাই।

জগৎ মাঝে হবো বড়ো
এটা সবার আশ,
সারা জীবন মিলে মিশে
করবো মোরা বাস।

সজল মন্ডল

বিকেল থেকে রাত্রি
—————————
সজল মন্ডল
——————

থমকে থমকে দাঁড়ায়
এক আলগোছা বাতাস
অনুভবে আনে গাছের পাতা
তার এলোচুলে দিয়ে গেলো দোলা
পেলাম আমি সামান্য আভাস৷

সে সব বিকেল বেলার কথা
নদীর ধারে হিজল গাছের ছায়ায়
কাঠঠোকরা ঠুক ঠুক কাঠ কাটে
শব্দ ছুঁয়ে বিকেল বেলার রোদ
কৃপণ নদী বালিতে জল মাখায়৷

তখন সূর্য ডুবু ডুবু ভাব
নিচের আকাশ রং মেখেছে লাল
পাখিদের ঘরে ফেরার তাড়া
শাঁখের শব্দে পাড়া মাতোয়ারা
কি কারনে তার লাল দুটি গাল!

থমকে গেছে হেঁটে যাওয়ার পথ
সন্ধ্যে নামলো ,পাড়া শুনশান
শব্দ ভাসায়  নদীর কলতান
জোনাকিরা আলো বিছায় পাতার ফাঁকে ফাঁকে
তাদের দেখে ঝিঁ ঝিঁরা  গায় গান৷

যত তারা হেমন্তের মাঠে
রাত্রি হলেই নিশি যাপনে আসে
ধানফুলেরা আমোদে ডগমগ
আমি দেখি তাদের দুচোখ ভরে
 তাদের নিঃশ্বাস জমে রাত্রির বাতাসে৷
———————————*——————

গৌতম তরফদার


ডুবসাঁতারে আমি
------------------------
গৌতম তরফদার
------------------------------



অন্তহীন ব্যস্ততার শেষে অল্পস্বল্প বিরতি 
দিনের গুজরান যেন কোনোমতে।
আধঘুমন্ত অনুভূতির খিড়কি খুলে দেখি
রয়েছি আমি ব্যস্ত মনের শূন্য পথে। 

নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখি অর্থহীন কাজে
আপন শখ-আহ্লাদ সব নিখোঁজ।
তুমি-হীন পথের আনাচেকানাচে শূন্যতা 
মনের ব্যস্ত চলাচল রোজ রোজ। 

বর্ষণমুখর আষাঢ়ের ব্যস্ততা বুঝি আমি
ধরণীর অন্তরে শান্তির জল-সিঞ্চন।
ব্যথাতুর মনে কর্মব্যস্ততার অবুঝ প্রলেপ 
এড়াতে চেয়েছি দুর্ভাগ্যের ভ্রুকুঞ্চন। 

বিরহের ক্লান্তি আর মনোমালিন্যের ভ্রান্তি
আমাদের সম্পর্কের নেই মান্যতা। 
রাগ-অভিমানের কাটাছেঁড়ায় অশান্ত মন
তোমায়-আমায় ঘিরেছে শূন্যতা। 

মনের ব্যস্ততা শুধু তোমারই স্মৃতিচারণে
যন্ত্রণার ঝাপটায় ওঠে ঘেমে-নেয়ে।
উল্টো রথ সময়ে ফিরলেও আমি আছি
তোমারই প্রত্যাবর্তনের পথ চেয়ে। 

শূন্যতার মাঝে আমি ব্যর্থ প্রেমিকের সাজে
বুদ্ধুরামের ভাগ্য জানেন অন্তর্যামী। 
অপেক্ষার অনন্ত যাত্রায় উপেক্ষার আঁচড় 
হতাশার সাগরে ডুবসাঁতারে আমি।

কৃত্তিবাস

কল্পনায় চেনা
--------------------
কৃত্তিবাস ওঝা
-----------------------


নদীর বুকটা অন্ধকার
চোখের উঠানে অসংখ্য তারার মাঝে 
একটা শুকতারার ধ্রুপদী অবস্থান
অসীম আকাশের নিস্তব্ধতার কোলাহলে
সব অচেনার মাঝে একটাই চেনা,
পাথরের শুষ্কতা ভাঙে
জলের মৃদু শব্দ,-- ছলাৎ ছলাৎ।

ভাঙা কপালে কে যেন হাত বুলিয়ে দেয়
বিলি কাটে চুলে
নদীর ওপার থেকো 
জোনাকির টিপ টিপ আলো
কথা বলে ইশারায়,
কল্পনার মোনালিসা স্পর্শ চিৎকার
মাঝ দরিয়ায় নৌকা চালায়।

বন্ধ ঘরের ঝুল বারান্দায়
রঙিন পোষাক শুকায়
খালি পেটে বড় বড় হাই তোলে
রাত ঘুমের দিনেরবেলায়।
ঘ্রাণ বাঁশিতে প্রাণের খাতায়
হৃদ-হারমোনিয়ামে গান শোনায়।

মৃত্যুঞ্জয় সরকার

ইচ্ছে তো হয় 
-------------------
মৃত্যুঞ্জয় সরকার 
--------------------------


এ ভাবেই একদিন 
আমিও শেষ হয়ে যাবো 
পরে থাকবে আমার না বলা কিছু কথা 
তুচ্ছ স্মৃতি, যন্ত্রণা,ক্ষুব্ধ মনের প্রতিবাদী আগুন হল্কা। 

আমি ব্যর্থ হয়েছি বারবার 
তুমিও সহ্য করেছো তীব্র দহন 
ইস্তেহারে জং ধরে গেছে,তবু ক্যানভাস কথা বলে 
পুড়ে পুড়ে হয়ে গেছি ক্রান্তিবীর,কঠিন উপন্যাস। 

ঝর্ণা হতে চেয়ে হয়েছি খরস্রোতা নদী 
সুবিচার চেয়ে কলঙ্ক মেখেছি গায়ে, 
তবু হাল ছাড়িনি বুনে গেছি জীবনের বীজ 
ব্যথিত জীবনের ধূসর পাণ্ডুলিপি,দীপ্ত কলরব। 

আত্ম সুখে উপেক্ষিতা তুমি যুগিয়েছো প্রেরণা 
বিরহ  সয়েছো দিয়েছো তেজোদীপ্ত জীবন আমার,  
প্রিয়তমা, এ আমার অঙ্গীকার 
যেতে যেতে রেখে যাবো যুদ্ধ বিজয়ী প্রাণ। 

নতুন সূর্যকণা গড়ে দিবে মন 
দিবে নতুন সাম্যনীতি বিশুদ্ধ জীবন দর্শন, 
তুমি ও নবপত্র এঁকে জগৎ জননী হবে 
দিয়ে যাবে স্নেহ প্রেম প্রীতি নির্ভরতা অঙ্কুরিত প্রাণ।

শ্যামল মিশ্র

গ্রামছবি
--------------
শ্যামল কুমার মিশ্র
------------------------------


বাতায়ন পাশে বসে থাকে খোকন
সকালের নরম রোদ্দুর এসে কত ছবি আঁকে
দূরে শিমূলের পাতার ফাঁকে বসে থাকে ভোরের দোয়েল
শিস্ দিয়ে উড়ে যায় দূরে বহুদূরে...

খোকনের মনে পড়ে ছায়া ঘেরা সেই গ্রাম
ছাইয়ের গাদার পাশ দিয়ে এঁকে এঁকে চলে গেছে পথ
যে পথে গ্রামের মেয়েরা বিকেলে চাপাকলে জল আনতে যায়
রহিম চাচা লাঙ্গল কাঁধে চাষ দিয়ে ফেরে
আদুল গায়ের ছেলের দল মার্বেল পকেটে নিয়ে চলে খোলা মাঠে
কখনো ব্যাটে বলে জোর লড়াই পূব পাড়া পশ্চিম পাড়ার সাথে

সাঁঝবেলা হ্যারিকেন নিয়ে পড়তে চলে কোন এক বালক
দুরু দুরু বুক তার ভয়ে কেঁপে মরে 
অভয় বাণীর মতো ঝরে পড়ে রাণু পিসির কণ্ঠস্বর---'কে যায়? অংশুর পোলা? ভয় নাই খোকা। আমিতো আছি'?

খোকনের ভয় কাটে, ভেবে নেয় 
ঐ দূরে জেগে রয় দুটো চোখ... 
এগিয়ে চলে ঝিঁঝিঁ ডাকা পথে 
ঐ পথে জীবনের প্রথম প্রভাতে দেখা হয় তোমা সনে 
তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে 
পথটা সরে গেছে দূরে অনেক দূরে 
পথের কোন এক বাঁকে তুমি যেন কবে হারিয়ে গেলে...

অপরাহ্ণের শেষবেলায় আজ সব স্বপ্ন মনে হয় 
জলছবি গ্রামগুলো আজ হারিয়ে গেছে 
হারিয়ে গেছে রহিম চাচা রাণু পিসিরা 
বোষ্টমী পিসি আজ আর 'রাই জাগো বলে' সুর তোলে না 
তমিস্রার এক আঁধার আজ গ্রামের কোল জুড়ে  
প্রযুক্তির আলোয় হারিয়ে গেছে সেইসব গ্রামছবি ভালোবাসার অন্তহীন প্রবাহ...

বাতায়ন পাশে বসে ভেবে চলে খোকন 
ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তোলা কলসি ভরা গরুর গাড়ি চলেছে ধীরে ধীরে 
খোকন দৌড়চ্ছে..অন্তহীন সে দৌড় 
ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে সব মুখ, সব ছবি 
ক্লান্ত অবসন্ন খোকন আজও খুঁজে ফেরে 
ছায়া ছায়া সেই গ্রাম, ফেলে আসা মায়ের কোল 
শৈশব কৈশোরের হারানো দিনগুলি... 
হারিয়ে যায় সময়ের অতলান্ত গভীরে...

Saturday, July 10, 2021

সন্ধ্যার মেঘমালা

সন্ধ্যার মেঘমালা


আমার দুঃখগুলো ঢেকে রেখো রাতের আকাশ
হাসিটাকে ছড়িয়ে দিও উদাসী বাতাস 
স্বপ্নগুলোর আঁকিবুকি  ,
হাজার তারার ঝিকিমিকি 
মনের ঘরে সিধ কেটে যাক সোনালী আভাস। 

দাঁড়িয়ে আছি আপন মনে রূদ্ধ ঘরের কোনে 
অলস সময়,  হতাশ জীবন  , উদাস , শূণ্য মনে  ।
যেদিকে তাকাই অসহায় মুখ ,
অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু বুক
এক আকাশ ভাবনা জাগে রাতের সঙ্গোপনে  ।

আমার গোপন কান্না যত বালিশ ভেজায় ,
নোনাজলের ঢেউ তুলে যায় শিরায় শিরায় 
হঠাৎ আসা ঘূর্ণিঝড়ে 
বুকের তটে ঝাপটা মারে 
এক পৃথিবী হাহাকারে  মনকে কাঁদায়  ।

কাঁদায়  -- শুধু কাঁদায়  , আমায় ব্যস্ত করে 
ওঠায় - নামায়,  হাসায় - কাঁদায়  , খেলা করে 
সম্মোহনী মায়ার বশে ,
জীবনজুড়ে রঙ্গে রসে
দোদুল দোলায়  , আপন ভেলায় মগ্ন করে  ।

জীবন যখন পূর্ণ আমার হতাশ্বাসে ,
কানায় কানায় পূর্ণ কলস  , নিয়তি হাসে 
এত বড় নিষ্ঠুরতা ,
শুধুই কালো  , মেদুরতা ,
দিন -রাতের বিবাদ আমার চোখে ভাসে। 

Friday, July 2, 2021

গৌতম তরফদার

নতুন অধ্যায় 
গৌতম তরফদার 

               বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য সংস্থায় লেখালেখির কারণে পাঠক মহলে বিপ্রতীপ তালুকদারের পরিচিতি অনেকটাই বেড়েছে। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। বিপত্নীক।
বছর দুয়েক আগে পাহাড়ের কোলে বেড়াতে গিয়ে আকস্মিক হড়কা বানে স্ত্রী আর আট বছরের একমাত্র কন্যাকে হারিয়েছে। সেই থেকে বিপ্রতীপ পুরোপুরি একা। মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দিদি তার আপন পরিবার নিয়ে আসামের গোয়ালপাড়ায় থাকে। বিপ্রতীপ অফিস আর লেখালেখির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
      
              ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিন বেশকিছু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। বিপ্রতীপের বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর তেমন আগ্রহই নেই। একদিন কেতকী মজুমদার নামের একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। প্রোফাইল পিকচারে একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হুবহু যেন তার হারানো মেয়ের মুখ। স্মৃতির জোয়ারে ভেসে যায় বিপ্রতীপ। আর কিছু দেখতে পায় না প্রোফাইল লক থাকার কারণে। আনমনেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে নেয়। 

             বন্ধুত্ব শুরু। কেতকীর স্বামী রাজশেখর বছর কয়েক আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অভিশপ্ত জলন্ত কামরায় ওরা তিন জনই ছিল কাশ্মীর টুর থেকে ফেরার পথে। কেতকী তার মেয়ে পল্লবীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও ভীষণ রকম জখম হয়। অবশেষে মা-বেটি সুস্থ হয় কিন্তু রাজশেখরকে বাঁচানো যায় নি। স্বামীর পেনশন আর ঘর ভাড়ায় টাকায় মা-বেটির সংসার চলে। 

              বিপ্রতীপের কবিতা আর গল্পের অসম্ভব ভক্ত। লাইন ধরে ধরে বলে দিতে পারে। নিজেও অল্পবিস্তর লেখালেখি করে। সেই সূত্রেই খোঁজ, যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব। ফেসবুক,  ম্যাসেঞ্জার আর হোয়াটস্অ্যাপে নীরব কথা আর অনুভূতির বিনিময়ে দ্রুত ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

             দু'জনেই কোলকাতার বাসিন্দা।  বিপ্রতীপ থাকে বেহালা আর কেতকী দমদমে। সম্পর্কের গভীরতা যত বাড়তে থাকে বিপ্রতীপ দেখা করার জন্য বারংবার অনুরোধ জানাতে থাকে। কিন্তু কেতকী প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। বলে," এভাবেই এগিয়ে চলুক আমাদের সম্পর্ক। দু'জনের জীবনেই চরম দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আজ আমরা পরস্পরকে মানসিক ভাবে পেয়েছি। সামনাসামনি দেখা আর আমার সান্নিধ্যের ছোঁয়া যদি তোমার অপছন্দ হয়, তখন ?  বাস্তবের জটিলতায় যদি আবার তোমাকে হারাই, সইতে পারবো না আমি।" 

           কিন্তু বিপ্রতীপ নাছোড়বান্দা। দেখা করার অভিলাষে মেয়ের দিব্বি দিয়ে বসে। দু'জনেকেই আসতে বলে। কেতকী কথা রাখে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মিলেনিয়াম পার্কে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্রতীপের সামনে দাঁড়ায়। চমকে ওঠে বিপ্রতীপ। কেতকীর ডান গাল জুড়ে বিচ্ছিরি পোড়া দাগ। চামড়া কুঁচকে আছে।
  
        --- "আমি তোমায় অনেকবার বলেছিলাম আমায় দেখতে চেয়ো না। অশরীরী সম্পর্ক থাক দুই হৃদয়ে।" 

        -- " দূর পাগলি! এই জন্যই তুমি এড়িয়ে যাচ্ছিলে? যে হৃদয় জয় করে, সে কি আটকে যাবে নশ্বর শরীরে! তোমাকে আর বেটিকে নিজের করে নিতে চাই।  তুমি রাজি তো ? "

অঞ্জন চক্রবর্তী

পিতৃদিবস
অঞ্জন চক্রবর্তী
============
      অতনু একটি মার্কেন্টাইল ফার্মের কর্ণধার, দম ফেলবার সময় নেই, আরও আরও ওপরে উঠতে হবে, সীমাহীন প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, নিজের কেরিয়ার ছাড়া কিছু বোঝে না l অতনুর বাবা তার সর্বস্ব নিয়োগ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন l ছেলে আজ এক ঈর্ষণীয় জায়গায় পৌঁছেছে l নিজের সংসার করেছে, যেখানে বাবা বেমানান হওয়াতে বাবাকে অতনু রেখে এসেছে দামি বৃদ্ধাশ্রমে l বাবা আপনমনে ভাবেন ফেলে আসা দিনের কথা l পিতৃদিবসের দিন সকালবেলায় অতনু হন্তদন্ত হয়ে হাজির বৃদ্ধাশ্রমে, বাবাকে বললো শিগগিরই গেঞ্জি ছেড়ে ভাল পাঞ্জাবী পর একটা, বৃদ্ধ উদ্বেলিত, ভাবেন হয়তো ছেলের মনের হয়েছে বদল, আবার তাঁর জায়গা হবে সংসারে l বৃদ্ধ পাঞ্জাবী পরে এসে দাঁড়ালেন,  ছেলে বলল এসে আমার পাশে দাঁড়াও ঠিক এইভাবে, বৃদ্ধ দাঁড়ালেন, ছেলে নিজেকে বাবার গলা জড়িয়ে ফটো তুললো, বললো
     বাবা, আমার সময় নেই আসি, মনে মনে বললো এই ফটোটা পোস্ট করবো ফেসবুকে
    আজ পিতৃদিবসের দিনে, কমেন্টে ভেসে যাবে, কেউ জানবেও না, অতনুর বাবা পরে আছে বৃদ্ধাশ্রমে l

সঞ্জীব রায়

পুত্ৰং দেহি 
ডঃ সঞ্জীব রায় 


    তড়িঘড়ি করে মধ্যমগ্রামে চারমাথা মোড়ের দোতলা বাড়িটা জলের দরে বেচে দিলেন সঞ্জয় সেনের ছেলে অনুব্রত। হাতে সময় নেই, দশ দিনের ছুটিতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা। কি দামে বিক্রি হলো সঞ্জয় বাবু সেটাও জানতে পারেননি। সঞ্জয় সেনের আপত্তি ছিল, কিন্তু গিন্নি শুনলে তো। নাতি হয়েছে, তাঁর ফুর্তি ধরে না যে। ছেলে পাসপোর্ট আগেই করে রেখেছিল। সঞ্জয়বাবু জানতেন যে আমেরিকার ভিসা করতে ন্যূনতম দুদিন সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু ছেলে বললো এখন সবই নাকি অনলাইনে হয়ে যায়। তালেবর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আর ইচ্ছা করেনি।

    বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে পাসপোর্ট পরীক্ষা হওয়ার সময় কেমন যেন সন্দেহ হল সঞ্জয়বাবুর। তিনি দেখলেন একপাশে গেটম্যানকে টেনে নিয়ে গিয়ে অনুব্রত তার হাতে একগাদা ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিল। বিমানবন্দরের ভেতরে গেলেন স্বামী-স্ত্রী। একটু উত্তেজনা হচ্ছে। দীর্ঘ বিমানযাত্রা বলে কথা। ঘন্টা কয়েক বাদে ছেলেই জানায় প্লেন লেট আছে। চিন্তার কিছু নেই। ও ভেতরে যাচ্ছে, কিছু কাগজপত্র দেখানো, সই-সাবুদ বাকি।

     মাঝরাত পার হয়ে প্রায় শেষ প্রহর। ঠান্ডা লাগছে। সোয়েটার চাদর গায়ে দিয়ে অভুক্ত রয়েছেন দুজনে। না পাচ্ছেন ছেলের দেখা, না পাচ্ছেন কোনো খবর। হাতে টাকা-পয়সা, পাসপোর্ট, টিকিট কিছুই নেই। এয়ারলাইন্সের এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে এলেন। সব শুনে তিনি তো তাজ্জব। বললেন রাত ১টা ২০ মিনিটে ওয়াশিংটন যাওয়ার প্লেন উড়ে গেছে এবং ছেলে তাতে বোর্ডিং করেছে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধ দম্পতির পাঁজর থেকে।

    তারপরের দীর্ঘ টানাপোড়েন ইতিহাস। বর্তমানে তাঁদের ঠিকানা ঠাকুরপুকুরের এক বৃদ্ধাশ্রম 'অমলকান্তি'। সেখানে একতলার এক স্যাঁতস্যাঁতে ১০/১০ ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন। বিনা পয়সায় আর কিই বা জুটবে? কোন অভিযোগ নেই। ঈশ্বর ধন্য, এটুকু দিয়েছেন।

   একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, সঞ্জয়বাবু পরে জানতে পেরেছিলেন বাড়িটা ৭৮ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।


শ্যামল মিশ্র

রোমন্থন
শ্যামল কুমার মিশ্র

    ঝুলবারান্দায় মুখোমুখি বসে শোভন আর রুমান্না। সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে। বাতাসে অল্প অল্প শীতের আমেজ। সামনের বাগানে শিউলিগুলো ঝরে পড়েছে। সবুজ ডালের আড়ালে কাজল পাখি গান গেয়ে চলেছে। সকালের এই সময়টা বড় ভালো লাগে শোভনের। রুমান্না এসে আলতো করে মাফলারটা জড়িয়ে দিয়ে শুরু করে ফেলে আসা জীবনের নানা কথা। 

   দেখতে দেখতে শোভন আর রুমান্নার দাম্পত্য জীবনের সিলভার জুবলি পেরিয়ে গেছে। রুমা বলে ওঠে---''জীবনটা বড় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল তাই না? মনে পড়ে এই সেদিন যেন আমরা ঘর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মধ্যমগ্রাম বারাসাত এমনকি কলকাতাতেও অনেকে ঘর দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে আমি 'রুমান্না খাতুন' তখনই দূরে সরে গেছে। তাদের 'গোপালে'র কথা মনে হয়েছে''। মৃদু হাসি খেলে যায় শোভনের মুখে। 'আসলে বড় অদ্ভুত এই দেশ।এদেশ বুদ্ধ, মুহাম্মদের দেশ। এদেশ শ্রীচৈতন্যের দেশ যার পরমভক্ত যবন হরিদাস। যিনি একজন মুসলমান। এঁরা তো সেই গোপালেরই ভক্ত। এটা খানিকটা সংস্কারের মতো মিশে রয়েছে। কার্যকারণ ব্যাখ্যা হয়তোএদের কাছেও নেই'।

   বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে রুমার।  আপনমনে সকালের খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে থমকে যায় রুমা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শোভনের। অতিমারিতে মৃত এক হিন্দু যুবককে পোড়াতে নিয়ে চলেছে চার মুসলমান যুবক। প্রতিবেশীরা কেউই আসেনি। রুমান্নার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

    শোভন বলে চলে---'বুঝলে জীবনের  সার সত্যটা কেউই বুঝলো না।  মানুষই সত্য। ধর্ম,জাত সবই মিথ্যা। এগুলো শুধু জীবনের এক একটা আভরণ। দর্পীর অহং। আভরণ খুললেই দেখবে জীবনের শাশ্বত সত্য রূপ'।

    রুমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের নানা ছবি। নতুন সংসারী দুই যুবক যুবতী ঘর খুঁজে ফেরে। জীবনতরী এগিয়ে চলে এমনি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অবশেষে ঘর মেলে।সংসারেরও শুরু হয়।...

   তারপর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পৌঁছে মনে হয় শোভনের জীবনের সবটাই অসুন্দর নয়। গোলাপের সৌন্দর্য নিতে গেলে কাঁটার আঁচড় ও যে খেতে হয়। ততক্ষণে রুমান্না গান ধরেছে--- 'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ'...। 
     গানটা কখন থেমে গেছে মুখোমুখি বসে দুই প্রৌঢ় দম্পতি। পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একমাত্র ছেলের নাম। ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় রুমান্না... 

(শব্দ সংখ্যা:৩১২)

সুতপা ব্যানার্জি

আসমান জমিন
সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)
     ছটু সিং এক সওদাগরী অফিসে দ্বারোয়ানের কাজ করে। বাবা-মা আর নিজের পরিবার নিয়ে একটা খুপরি ভাড়ার বাসায় থাকে। ভাড়াটা একটু কম হবে বলে সবচেয়ে ওপরে চারতলায় ওদের বাস। সিঁড়ি ভেঙেই যাতায়াত। সেদিন অফিস থেকে ফিরে শুনল-"মায়ের শরীরটা গরমে আজ ভীষণ খারাপ হয়েছে।গরমি জ্বর এসে গেছে"-কথা কটা বলে বউ সরলা রান্না ঘরে লেবু জল আনতে গেল। ছেলে বাবুল-"বাবা দুপুরে গরমে ঘরে টেকা যাচ্ছে না, আমরা বাসা বদল করতে পারি না?" ছটু-"এত কম ভাড়ায় কোথায় ঘর পাব বেটা, গরম কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।" ছোট মেয়ে শামলি বাবার হাত ধরে বায়না করে-"তাহলে বাবা আনো না একটা কুলার কিনে, দাদিও আরাম পাবে আর আমরাও একটু ঠান্ডা পাব।" সরলা স্বামীকে লেবু জল দিতে এসে মেয়ের আবদার শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে-" ভাত কী করে জুটবে জানা নেই আবার কুলারের হাওয়া খাচ্ছে, যা ভাগ,নিজের বই খুলে বস।" ছটু-"শামলি কথাটা খারাপ বলে নি, চার-পাঁচ হাজার টাকায় হয়েও যাবে, দেখি অফিসে সাহেবের থেকে লোন পেলে মাসে মাসে কাটিয়ে নেব।" বাবার কথায় বাবুল আর শামলি খুব খুশী হল।

    পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমে বড়বাবুর কাছে গেল-"রায় বাবু আমার চার-পাঁচহাজারটাকা লোন লাগবে,আপনি একটু সাহেবকে বলুন না।" বড়বাবু-"কেন? আমি বলব কেন? তুমি সাহেবকে নিজের কথা নিজে বল।" ছটু কাজটা জটিল হয়ে যাওয়ায় দোনামোনায় পড়ে গেল, তবে বাড়ির পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সাহস সঞ্চয় করে পায়ে পায়ে সাহেবের কেবিনের দরজায় দাঁড়াল। পর্দাটা কাঁপা হাতে সরিয়ে-"একবার ভেতরে আসব স‍্যার?" ফাইলের দিকে চোখ রেখেই অফিসের মালিক ঝুনঝুনওয়ালা-"কী বলবে, দের কিঁউ, জলদি বোলো।" ছটু-"আজ্ঞে স‍্যার বাড়ির প্রয়োজনে আমার পাঁচহাজার টাকা লাগবে। আপনি মাসে মাসে কেটে নেবেন।" ঝুনঝুনওয়ালা-"অফিসের এখন অবস্থা ভাল না, আভি নেহি।" ছটু কাচুমাচু হয়ে-"গরমে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, একটা কুলার কিনতাম স‍্যার।" ঝুনঝুনওয়ালা হাসিতে ফেটে পড়ে
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-" সবলোগ শুনো.. আমাদের ছটুর কুলার কেনার জন‍্য টাকা লাগবে...হা হা হা।" আরো কয়েকজন সেই বিদ্রুপের হাসিতে যোগ দিল। ছটুর চোখ ফেটে জল আসছিল। তা সামলে নিজের কাজের জায়গায় গিয়ে বসল। চাকরি বলে কথা, অপমান গায়ে মাখলে তো হবে না। যদিও মনটা খুব খারাপ হয়ে থাকল। পরদিন অফিস ফেরত পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। দেখল রাস্তার উল্টো দিকে একটা এসি মেসিন বিক্রির দোকানে অফিসের সাহেব দাঁড়িয়ে। ছোটা হাতি করে নতুন বাক্সে ওনার বাড়ির এসি চলল। সাহেব চলে যেতে ছটু দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-"যে এসিটা বিক্রী হল, ওটার দাম কত?" দোকানদার-"কেন আপনি কিনবেন,ষাট হাজার টাকা।" ছটুকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোকানদার বলতে থাকে-" ওনার অনেক বড় ব‍্যবসা। ওনার সব ঘরেই এসি আছে। সবই আমাদের দোকান থেকে কেনা। শুধু পোষা কুকুরের ঘরের এসিটা খারাপ হওয়ায় নতুন একটা কিনে নিয়ে গেলেন।" ছটু দোকান থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ডিউটির পর একটা শপিং মলে বা কোন পেট্রল পাম্পে কাজ করে হলেও নিজের পরিবারের কষ্ট দূর করবে, তার মায়ের কষ্ট দূর করবে। সাহেবের দাক্ষিণ‍্যে নয়, নিজের নগদ টাকায় এই গরমেই কুলার কিনবে।

উমা মুখার্জি


ডাক্তার বাবু
 উমা মুখার্জী

       অনেকদিন আগের ঘটনা। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন ডাক্তার। খুবই সৎ ও দয়ালু ছিলেন। যত দুর্যোগ আর যত রাত - ই হোক, রুগীর বাড়ি থেকে ফোন এলে তিঁনি তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে পড়তেন, রুগী দেখার উদ্দেশ্যে।

      সেদিন ছিলো শ্রাবন মাসের সন্ধ্যা। অবিরাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠাকুরদাদা ভাবলেন, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন। শুয়েও পড়েছিলেন। হঠাৎ, দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। রাত্রি তখন বারোটা। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। একটি লোক সঙ্গে ছাতা, আঁধারে মুখ দেখা যাচ্ছেনা, বলে ডাক্তার বাবু আপনি আসুন, নাহলে বাবু বাঁচবেনা।

      কথায় জানতে পারলেন, শহর থেকে একটু দূরে যেতে হবে। দেরী না করে, লোকটিকে নিয়ে গাড়ি করে চললেন রুগী দেখতে। এতো জল গাড়ি অনেকটা এসে আর স্টার্ট নিচ্ছেনা। লোকটি বলে, চিন্তা করবেন না, ছাতা এনেছি, চলুন, অল্প হাঁটা পথ। অগত্যা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, লোক টি ছাতা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, টর্চ জ্বেলে কিছু বোঝাও যাচ্ছেনা। বিদ্যুতের আলোয় শুধু একবার লোকটির মুখ দেখা গেলো, চোখ দুটি কোটরাগত, গালে মাংস বলে কিছু নেই।

      অল্প হাঁটার পর এলো রুগীর বাড়ি, আগেকার দিনের দোতালা বাড়ি। লোকটি গেট ঠেলে বললো আপনি সোজা চলে যান, প্রদীপ জ্বলছে ঐ ঘরে রুগী, বলেই অদৃশ্য।

     ঠাকুরদাদা এগিয়ে গিয়ে দেখেন খাটে মুখ চাপা দিয়ে একজন শুয়ে, শুধু একটা কোথা থেকে চেয়ার এগিয়ে এলো। রুগীর গলা খনখনে, বলে বসুন আপনি, আগে আমার কথা সব শুনুন, তারপর আমায় দেখবেন।

     কোণের দিকে দেখুন লাল বাক্স, ওতে আমার উইল আছে। আমার আর বাঁচা হবেনা। সময় হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলের ঠিকানা ওতে আছে, ত্যাজ্য পুত্র করেছিলাম। ওটা তাকে পৌঁছে দেবেন শুধু এই অনুরোধ টুকু রাখুন।

     এর পর মুখের চাপা গেল খুলে, আর অন্ধকারে ঠাকুরদার হাত তার হাতে ধরা বরফ শীতল এক কঙ্কাল শুয়ে বিছানায়।

    এক লাফে দৌড়ে ঠাকুরদা গাড়ির কাছে আসেন যখন, গাড়ি নিজেই ঠিক হয়ে গেছে, ঝড়, জল থেমে গেছে। বাড়ি পৌঁছে ভাবছেন কি করে হয়।

     সকাল হতেই আবার যান। দেখেন লাল রঙের বাড়ি, তালা দেওয়া। স্থানীয় লোকেরা আসে ভিড় করে, জানায় ছয় মাস হলো উনি মারা গেছেন।
তালা ভেঙে দেখা গেলো খাট নেই, চেয়ার নেই, তবে ঘরে একটা লাল বাক্স আছে কোণের দিকে, আর তার ভেতরে দলিল ও ছেলের ঠিকানা আর চিঠি।

   ঠাকুরদা সেটি নেন ও লোক মারফত নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন।

   শেষ দিন অবধি এই রহস্যের কিনারা তিঁনি করে উঠতে পারেননি। ভুত কি তবে সত্যি আছে?

সমাপ্ত।।