আসমান জমিন
সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
ছটু সিং এক সওদাগরী অফিসে দ্বারোয়ানের কাজ করে। বাবা-মা আর নিজের পরিবার নিয়ে একটা খুপরি ভাড়ার বাসায় থাকে। ভাড়াটা একটু কম হবে বলে সবচেয়ে ওপরে চারতলায় ওদের বাস। সিঁড়ি ভেঙেই যাতায়াত। সেদিন অফিস থেকে ফিরে শুনল-"মায়ের শরীরটা গরমে আজ ভীষণ খারাপ হয়েছে।গরমি জ্বর এসে গেছে"-কথা কটা বলে বউ সরলা রান্না ঘরে লেবু জল আনতে গেল। ছেলে বাবুল-"বাবা দুপুরে গরমে ঘরে টেকা যাচ্ছে না, আমরা বাসা বদল করতে পারি না?" ছটু-"এত কম ভাড়ায় কোথায় ঘর পাব বেটা, গরম কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।" ছোট মেয়ে শামলি বাবার হাত ধরে বায়না করে-"তাহলে বাবা আনো না একটা কুলার কিনে, দাদিও আরাম পাবে আর আমরাও একটু ঠান্ডা পাব।" সরলা স্বামীকে লেবু জল দিতে এসে মেয়ের আবদার শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে-" ভাত কী করে জুটবে জানা নেই আবার কুলারের হাওয়া খাচ্ছে, যা ভাগ,নিজের বই খুলে বস।" ছটু-"শামলি কথাটা খারাপ বলে নি, চার-পাঁচ হাজার টাকায় হয়েও যাবে, দেখি অফিসে সাহেবের থেকে লোন পেলে মাসে মাসে কাটিয়ে নেব।" বাবার কথায় বাবুল আর শামলি খুব খুশী হল।
পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমে বড়বাবুর কাছে গেল-"রায় বাবু আমার চার-পাঁচহাজারটাকা লোন লাগবে,আপনি একটু সাহেবকে বলুন না।" বড়বাবু-"কেন? আমি বলব কেন? তুমি সাহেবকে নিজের কথা নিজে বল।" ছটু কাজটা জটিল হয়ে যাওয়ায় দোনামোনায় পড়ে গেল, তবে বাড়ির পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সাহস সঞ্চয় করে পায়ে পায়ে সাহেবের কেবিনের দরজায় দাঁড়াল। পর্দাটা কাঁপা হাতে সরিয়ে-"একবার ভেতরে আসব স্যার?" ফাইলের দিকে চোখ রেখেই অফিসের মালিক ঝুনঝুনওয়ালা-"কী বলবে, দের কিঁউ, জলদি বোলো।" ছটু-"আজ্ঞে স্যার বাড়ির প্রয়োজনে আমার পাঁচহাজার টাকা লাগবে। আপনি মাসে মাসে কেটে নেবেন।" ঝুনঝুনওয়ালা-"অফিসের এখন অবস্থা ভাল না, আভি নেহি।" ছটু কাচুমাচু হয়ে-"গরমে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, একটা কুলার কিনতাম স্যার।" ঝুনঝুনওয়ালা হাসিতে ফেটে পড়ে
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-" সবলোগ শুনো.. আমাদের ছটুর কুলার কেনার জন্য টাকা লাগবে...হা হা হা।" আরো কয়েকজন সেই বিদ্রুপের হাসিতে যোগ দিল। ছটুর চোখ ফেটে জল আসছিল। তা সামলে নিজের কাজের জায়গায় গিয়ে বসল। চাকরি বলে কথা, অপমান গায়ে মাখলে তো হবে না। যদিও মনটা খুব খারাপ হয়ে থাকল। পরদিন অফিস ফেরত পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। দেখল রাস্তার উল্টো দিকে একটা এসি মেসিন বিক্রির দোকানে অফিসের সাহেব দাঁড়িয়ে। ছোটা হাতি করে নতুন বাক্সে ওনার বাড়ির এসি চলল। সাহেব চলে যেতে ছটু দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-"যে এসিটা বিক্রী হল, ওটার দাম কত?" দোকানদার-"কেন আপনি কিনবেন,ষাট হাজার টাকা।" ছটুকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোকানদার বলতে থাকে-" ওনার অনেক বড় ব্যবসা। ওনার সব ঘরেই এসি আছে। সবই আমাদের দোকান থেকে কেনা। শুধু পোষা কুকুরের ঘরের এসিটা খারাপ হওয়ায় নতুন একটা কিনে নিয়ে গেলেন।" ছটু দোকান থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ডিউটির পর একটা শপিং মলে বা কোন পেট্রল পাম্পে কাজ করে হলেও নিজের পরিবারের কষ্ট দূর করবে, তার মায়ের কষ্ট দূর করবে। সাহেবের দাক্ষিণ্যে নয়, নিজের নগদ টাকায় এই গরমেই কুলার কিনবে।
No comments:
Post a Comment