Friday, July 2, 2021

শ্যামল মিশ্র

রোমন্থন
শ্যামল কুমার মিশ্র

    ঝুলবারান্দায় মুখোমুখি বসে শোভন আর রুমান্না। সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে। বাতাসে অল্প অল্প শীতের আমেজ। সামনের বাগানে শিউলিগুলো ঝরে পড়েছে। সবুজ ডালের আড়ালে কাজল পাখি গান গেয়ে চলেছে। সকালের এই সময়টা বড় ভালো লাগে শোভনের। রুমান্না এসে আলতো করে মাফলারটা জড়িয়ে দিয়ে শুরু করে ফেলে আসা জীবনের নানা কথা। 

   দেখতে দেখতে শোভন আর রুমান্নার দাম্পত্য জীবনের সিলভার জুবলি পেরিয়ে গেছে। রুমা বলে ওঠে---''জীবনটা বড় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল তাই না? মনে পড়ে এই সেদিন যেন আমরা ঘর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মধ্যমগ্রাম বারাসাত এমনকি কলকাতাতেও অনেকে ঘর দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে আমি 'রুমান্না খাতুন' তখনই দূরে সরে গেছে। তাদের 'গোপালে'র কথা মনে হয়েছে''। মৃদু হাসি খেলে যায় শোভনের মুখে। 'আসলে বড় অদ্ভুত এই দেশ।এদেশ বুদ্ধ, মুহাম্মদের দেশ। এদেশ শ্রীচৈতন্যের দেশ যার পরমভক্ত যবন হরিদাস। যিনি একজন মুসলমান। এঁরা তো সেই গোপালেরই ভক্ত। এটা খানিকটা সংস্কারের মতো মিশে রয়েছে। কার্যকারণ ব্যাখ্যা হয়তোএদের কাছেও নেই'।

   বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে রুমার।  আপনমনে সকালের খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে থমকে যায় রুমা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শোভনের। অতিমারিতে মৃত এক হিন্দু যুবককে পোড়াতে নিয়ে চলেছে চার মুসলমান যুবক। প্রতিবেশীরা কেউই আসেনি। রুমান্নার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

    শোভন বলে চলে---'বুঝলে জীবনের  সার সত্যটা কেউই বুঝলো না।  মানুষই সত্য। ধর্ম,জাত সবই মিথ্যা। এগুলো শুধু জীবনের এক একটা আভরণ। দর্পীর অহং। আভরণ খুললেই দেখবে জীবনের শাশ্বত সত্য রূপ'।

    রুমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের নানা ছবি। নতুন সংসারী দুই যুবক যুবতী ঘর খুঁজে ফেরে। জীবনতরী এগিয়ে চলে এমনি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অবশেষে ঘর মেলে।সংসারেরও শুরু হয়।...

   তারপর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পৌঁছে মনে হয় শোভনের জীবনের সবটাই অসুন্দর নয়। গোলাপের সৌন্দর্য নিতে গেলে কাঁটার আঁচড় ও যে খেতে হয়। ততক্ষণে রুমান্না গান ধরেছে--- 'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ'...। 
     গানটা কখন থেমে গেছে মুখোমুখি বসে দুই প্রৌঢ় দম্পতি। পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একমাত্র ছেলের নাম। ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় রুমান্না... 

(শব্দ সংখ্যা:৩১২)

No comments: