Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Tuesday, May 14, 2024

ছোটগল্প -- সুমন

ছোটগল্প
  সুমন
১৩.০৫.২০২৪
তোমার ছবিতে একটা ছোটগল্পের রসদ খুঁজে পেয়েছি,
যেখানে তোমার আমার জীবনের হিসেবে মিল দেখেছি,
অতঃপর, যেদিন প্রথম সমুখে অকস্মাৎ এসে দাঁড়ালে,
মুখোমুখি, চোখের ইশারায় পবিত্র প্রেমের জোয়ারে ভাসালে।
তোমার দু'চোখে আরেকটা আস্ত পৃথিবীর দিশা পেয়েছি,
উথালি পাথালি প্রেমময়ী উষ্ণতার পারদে হৃদয় মেলেছি,
চাহনি টেনেছে সমুদ্রতটে আছাড়ি বিছারি সাঁতারে উথলি,
নৌকা বিহারে হৃদয়ের অলিন্দে ভুলিয়েছো মান সকলি।
সেদিনই তোমার জীবনের উপাখ্যান আকুলতা নিয়ে শুনেছি,
হৃদয় উজাড়ি উদ্বেলিত মনপ্রাণ তোমাতেই আমি সঁপেছি,
খানিকটা ঋণের বোঝাও হয়তোবা আপনার করে বুঝেছি,
প্রাণপ্রিয়া তোমায় অন্তরের অন্তঃস্থলে পবিত্র আসনে বসিয়েছি। 
তোমারই পরশে উদ্ভ্রান্ত পাগলপারা প্রেমের আগুন জ্বেলেছি,‌
পাহাড়িয়া শীতলতা উপেক্ষা করেই সারারাত আমি জেগেছি,
আঁধারি নিশীথে জোনাকির আলোয় প্রেমের সাহিত্যে ভেসেছি,
লায়লা মজনুর রূপকথার ন্যায়, ছোটগল্পে কলম ধরেছি।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যে যেমনটা ভাবা, তেমনই থামতে শিখেছি,
ডাইরির পাতায় শেষাংশে তথাপি তোমারই কবিতা লিখেছি,
'শেষ-হয়েও-যেন-হইলো-না-শেষ', এমনই যবনিকা টেনেছি,
ক্ষমিও আমারে, ওগো সুচরিতা, ছোটগল্পের গান গেয়েছি,
আগামীর পথে, রেখো মোরে সাথে, তেমনই আস্থা রেখেছি।

Friday, January 5, 2024

শেষবেলার শাহজাহান -- গৌতম তরফদার

 শেষবেলার শাহজাহান
 গৌতম তরফদার
 ০৫.০১.২০২৪
" পাঠশালার খোলামাঠে হেসেখেলে শৈশবসঙ্গী সেখ শাহজাহানের সাথে দিন কাটানো সমর্পণ বসুর ছোটোবেলা - বড়োবেলা একসূত্রে গাঁথা। দু'জনের আজীবন বন্ধুত্বের বন্ধন। পড়াশুনার কারণে একসময় দু'জনের শারীরিক ছাড়াছাড়ি হলেও দু'জন দু'জনের খোঁজখবর রাখে, খুঁটিনাটি জানে-বোঝে। 

            শাহজাহান জমিদারবাড়ির একমাত্র সন্তান। জমিদারতন্ত্র কবেই বিদায় নিয়েছে কিন্তু সেখ পরিবারের ঠাটবাট এখনও কিছুটা হলেও চলমান। শহর থেকে স্নাতক পাঠক্রম শেষ করেই গ্রামে ফিরে গেছে জমিজমা - চাষাবাদের বিপুল কর্মযজ্ঞে। শাহজাহানের অন্তর জুড়ে গ্রামেরই অতি সুন্দরী নিয়ালি খাতুনের বসবাস। তাদের দু'জনের মধ্যে পরিচয় - যোগাযোগ - ভালোবাসারর সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রধান কারিগর বন্ধু সমর্পণই। সম্পর্কের শুরুতেই ভালোবেসে শাহজাহান নিয়ালির নাম রেখেছে বনান্তিকা।

            প্রথমার্ধে শাহজাহানের পরিবারের আপত্তি থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে ধুমধাম করে প্রায় জমিদারি মেজাজেই সাদি হয়ে যায় দু'জনের। সংসারজীবন শুরু.....গভীর মনোযোগে সংসারধর্ম পালন....পরপর তিন পুত্র সন্তানের জন্ম....তাদের বড়ো হয়ে ওঠা..... নিয়ালির ইচ্ছে ও অনুরোধে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নিয়ালি ও শাহজাহানের নামে কেনা জায়গায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা.... শাহজাহানের ইচ্ছেতে বৃদ্ধাশ্রমের নাম রাখা 'বনান্তিকা' ..... প্রথম আবাসিকা নিয়ালির আম্মা নুরজাহান বেওয়া..... এগিয়ে যেতে থাকল  শাহজাহান আর সমর্পণের বন্ধুত্বের বয়স। দুজনের চোখেই এখন বয়সী চশমা।

          দুর্ভাগ্যক্রমে অল্পদিন আগে শাহজাহান তার প্রাণপ্রিয়া বনান্তিকাকে হারিয়েছে এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায়। সেই থেকেই শাহজাহানের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য হারানোর প্রবনতা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ কাঁদে...হঠাৎ হাসে।

        শাহজাহানের তিন ছেলে বড়ো তো হলো কিন্তু মানুষ হলো না। বাড়ি - জমি - জায়গা নিয়ে তিন ভাইয়ের চরম বিবাদ.... ছেলেদের অন্যায় দাবি, জোরজুলুম, অত্যাচার... মারধোর....  কিছুই বাদ গেল না শাহজাহানের উপর দিয়ে । বন্ধু সমর্পণের চেষ্টায় ছেলেদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওরই নিজহাতে গড়া বৃদ্ধাশ্রম, ' বনান্তিকা'য় শাহজাহানের ঠাঁই হলো........।"

         আজ রবীন্দ্র ভবনের স্টেজে শ্রোতা-দর্শকে ঠাসা হলে নিজের সদ্য লেখা গল্প, "শেষবেলার শাহজাহান" বিখ্যাত কথাশিল্পী মহারণ্য বসু যার ছদ্মনাম সমর্পণ 
স্ব-কন্ঠে গল্প পাঠ শেষ করতেই তুমুল করতালিমুখর হয়ে উঠল। 

          মহারণ্য বসু দৃপ্তকন্ঠে  শেষে বলল," যার জীবনের গল্প আপনাদের পড়ে শোনালাম সে আর কেউ নয়, আমারই বাল্যবন্ধু শাহজাহান। ওই যে হুইল চেয়ারে বসে আছে। " বলেই স্টেজের পুর্ব কোণ দেখিয়ে দিল।

          ভাগ্যক্রমে আজ রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী তার অফিসারদের নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে হাজির ছিলেন। তিনি সটান স্টেজে উঠে এলেন। শাহজাহানের হাত ধরে সহমর্মিতা প্রকাশ করে হঠাৎ এক প্রস্তাব দিলেন," আপনি অনুমতি দিলে ও রাজি থাকলে " বনান্তিকা "কে রাজ্যসরকার অধিগ্রহণ করবে। বৃদ্ধাশ্রমের নাম অবশ্যই অপরিবর্তিত থাকবে আর আপনি আমরণ সম্মানীয় আবাসিক হয়েই থাকবেন। "

            আনন্দের অশ্রুজল শাহজাহানের দু'চোখ গড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক সেই মুহুর্তে শাহজাহানের তিন ছেলে যারা লুকিয়ে আব্বার নামের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল গুটিগুটি পায়ে স্টেজে উঠে এসে আব্বার পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইল।


Thursday, January 4, 2024

একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট -- সঞ্জিত কুমার মন্ডল

 একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট
    সঞ্জিত কুমার মন্ডল
         ০৩/০১/২৪
         
        বহু বছর পরে আমাদের গ্রামে কালীপদ যুব সংঘ একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে শীতকালেই। ১৫ দিন আগে থেকেই মাঠ পরিষ্কার,রোলার মেশিন দিয়ে সমান করার কাজ চলছে। গ্রামের লোক তাই দেখতে ভিড় করছে। গুঞ্জন উঠছে কালিপদ যুব সংঘ এত টাকা কোথা থেকে পাচ্ছে! অর্থের উৎস সবার জানা হয়ে গেল। বাঁশ দিয়ে তৈরি মাঠের চারিদিকে আটটি বিশাল বাতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। মাঠের চারিদিকে বিশাল বিশাল হোডিং পোস্টার তাতে লেখা আছে "ফুটবল কাপ-২০২৪, নববর্ষে নব আনন্দে জাগো"। খেলা ৩১শে ডিসেম্বর বিকাল থেকে । ডে নাইট খেলা। ৮ দলের টুর্নামেন্ট। প্রায় ছ'টা জেলা থেকে টিম আসছে। প্রত্যেক টিমে বিদেশি প্লেয়াররা আছে যেমন নাইজেরিয়ানরা আছে। পুরস্কার হিসেবে ফাইনালের বিজয়ী দল দেড় লাখ টাকা পুরস্কার পাবে। রানার্স টিম পাবে এক লাখ টাকা। কোয়ার্টার লেভেলে,সেমিফাইনালে এবং ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরস্কার আছে। বিশাল বড় স্টেজ। আধুনিক লাইটের ব্যবস্থা। জমজমাটি খেলা। প্রথমে ভেবেছিলাম টিকিট কেটে খেলা দেখতে হবে। তারপর শুনলাম বিনা পয়সায়। বিনা পয়সায় এত বড় খেলা দেখা সুবর্ণ সুযোগ। 
         ৩০ শে ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয়ে গেল বক্স বাজানো। সন্ধ্যা থেকেই লাইট পরীক্ষা করা। চারিদিকে আলোয় আলো ঝলমল করে উঠলো আমাদের গ্রাম। খেলার লাইভ ভিডিও দেখানো চলবে,বেশ কিছু পর্দা মাঠ থেকেও অনেক দূরে টানানো আছে। পরদিন গ্রামের লোকেরা দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরেই মাঠের কাছাকাছি জায়গায় যে যার আসন নিয়ে বসে পড়েছে। এখনো দু-তিন ঘন্টা বাকি খেলা শুরু হতে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। মাইকে শুভ নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে। প্রতিটা কথা প্রসঙ্গে ভেসে আসছে "নব আনন্দে জাগো।"বাইরে থেকে ঘোষক,ঘোষিকাদের আনা হয়েছে। তারা তাদের কাজ করে চলেছে। মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ছে। ছাপানো খেলার চার্ট মাঠের চারিদিকে জনগণকে বিতরণ করা হচ্ছে। সূর্যের আরামদায়ক তাপ গায়ে মেখে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনায় মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। জমজমাটী উদ্বোধনী নাচ গান শুরু হলো। গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে দেখল।আনন্দ করতে লাগলো। স্টেজে টেবিলের উপর বিশাল বিশাল ট্রফি, মেডেল সাজানো আছে। বিশিষ্ট ব্যক্তি অতিথিদের স্মারক ও পুষ্প দিয়ে বরণ করা হচ্ছে। হালকা বক্তৃতার পরেই মাঠে নেমে গেল ঝকঝকে জার্সি পরা দুটি টিম। বাঁকুড়া জেলা ও নদীয়া জেলার দুটি টিম। খেলার একটু বাদেই বাঁকুড়া জেলা নদীয়া জেলাকে একটা গোল দিয়ে দিল। দুটো টিমই সুন্দর ছকে খেলছে। দ্বিতীয় অর্ধে নদীয়া গোল শোধ করলো। খেলা উত্তেজনাকর হয়ে উঠলো। অবশেষে গোল শূন্য ট্রাইবেকার। তারপর টসে হেরে গিয়ে বাঁকুড়া পুরস্কার নিয়ে বিদায় নিল।

          দ্বিতীয় খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছিল ঘোষক ঘোষিকাদের বলার ভাষা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। জনগণ "নব আনন্দ জাগো" এই কথা শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল। এক্ষুনি শুরু হবে দ্বিতীয় খেলা সঙ্গে সঙ্গে জনগণের কলরব শোনা গেল। কারণ জনগণ ইতিমধ্যে জেনে গেছে দ্বিতীয় খেলার একটি টিম এখনও এসে পৌঁছায়নি। প্রত্যেক টিমকে টাইম দেওয়া আছে। সেই টাইমেই তাদের খেলতে হবে। এখানে ওয়াকওভার দেওয়ার নিয়ম নেই। এক ঘন্টা থেকে দু ঘন্টা দেরি দেখে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। "নব আনন্দে জাগো" এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ ভেংচি কেটে জোর চিৎকার করে উঠছে। ঘোষক ঘোষিকারা আর পেরে উঠছে না। ক্লাবের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া সত্বেও বাঁধভাঙা জলের মতো জনগণ মাঠে নেমে পড়লো। চারিদিকে ভাঙচুর শুরু করে দিল। রাতের ঝলমলে আলোয় সারা মাঠে জনগণ হইহুল্লোড় করতে লাগলো। স্টেজকে লক্ষ্য করে বোতল ছোড়াছুড়ি শুরু হল। সিভিক পুলিশ অল্প কিছু ছিল কিন্তু তারা মার খেয়ে গা ঢাকা দিল। তারপর পুলিশের গাড়ি। আচমকা পুলিশের লাঠিচার্জ। মাঠ ফাঁকা হল। দর্শকও  শূন্য হলো। তারপর কয়েকটা গাড়ি ঢোকার শব্দ। 

                                 (সমাপ্ত)                        

Sunday, August 6, 2023

খড়কুটো -- বিজয়া মিশ্র

 খড়কুটো
বিজয়া মিশ্র
২৮.০৭.২০২৩
এবার সত্যিই ছেড়ে চলে যেতে হবে চিরদিনের জন্য,এই নিজের হাতে একটু একটু করে গড়া সংসার। অসহায় না হলেও অধিকার তো আছেই।চঞ্চলকে অকালে হারিয়ে নিঃসন্তান মনিদীপা অকূলপাথারে। চঞ্চলের মৃত্যুর পর পরিবারের কারো সাপোর্ট পায়নি সে। না চাইতেই অবাঞ্ছিত আইনি লড়াইয়ে নেমেছিল সে।কিছু কাগজপত্র খুঁজে না পাওয়ায় জমা দিতে  পারেনি সময়মতো।অথচ সে মোটেই অগোছালো নয়।ভুল করে হয়তো কোথাও...। হাল ছেড়ে দিয়েছে।ওরা তার কথা না ভাবলেও মনিদীপা কতভাবে পাশে থেকেছে চিরকাল।অথচ চঞ্চলের অকালে চলে যাওয়ার দায় তার ঘাড়েই...।এখন এই ঘরগুলো খালি ক'রে অতি প্রয়োজনীয় বইপত্র রেখে বাকিগুলো কাগজ ওয়ালার হাতে তুলে দেবে সে।পুরোনো কাগজপাতি,বইপত্রে ঠাসা চিলেকোঠার ঘরে প্রতি রবিবার মণিদীপার অনেকটা সময় কাটে।অফিস ছুটি ,এই দিন সকাল সকাল রান্নার পাঠ চুকিয়ে তিনি চলে যান তেতালার অতিপ্রিয় 
চিলেকোঠায়।চাল ,গম ,জল খেতে পেয়ে একঝাঁক বিভিন্ন  রঙের পায়রা চিলেকোঠা সংলগ্ন ছাদটাকে মুখরিত করে সকাল সন্ধ্যে। অনেকেই মণিদীপার সাড়া পেলে আহ্লাদিত হয়।ধারে কাছে এমনকী হাতের উপর বসে কত কথা বলে।সেইমতো আজ পুরানো কাগজ ,বইপত্র কাগজওয়ালাকে কেজি দরে বিক্রি করে দিচ্ছিল। দাঁড়িপাল্লা থেকে বইগুলো বস্তায় ঢোকানোর সময় কিছু একটা মাটিতে পড়ে যেতেই মনিদিপা চমকে উঠলো।সেই হলুদ খামটা!তন্ন তন্ন ক'রে কতবার যে...। ওই খামেই তো দরকারি কাগজপত্র সঙ্গে লেখা শেষ চিঠিটাও আছে।মামলা মোকদ্দমা , সম্পত্তির ভাগাভাগি হওয়ার সময় খুব দরকারে কিছুতেই পাওয়া যায়নি। এখনও রায় বেরোনো বাকি। কখন যে বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিল পরে কিছুতেই মনে পড়ে নি। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার।মাঝপথে কাগজ ওয়ালাকে বিদায় দিয়ে মণিদীপা দাঁড়লো চঞ্চলের সদাহাস্য ছবির সামনে।অস্ফুটে বলল "হয়তো তুমি চাওনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।তোমার চিহ্নগুলো হারিয়ে চিরততে বঞ্চিত হোক তোমার অধিকার ।" সব হারানোর দিনে সহসা ফিরে পাওয়া এই সম্পদ তাকে শক্তি দিচ্ছে অনেকটা।একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে উকিলবাবুর নম্বর ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো "হ্যালো...।"

Tuesday, July 25, 2023

ভাবনার ভরাডুবি -- গৌতম তরফদার

 ভাবনার ভরাডুবি 
গৌতম তরফদার
 ২২.০৭.২০২৩
          চড়া রোদ্দুর উপেক্ষা করে হন্ হন্ করে হেঁটে চলেছে ঝল্লিকা দত্ত ঘর্মাক্ত শরীরে। মাথায় আগুন জ্বলছে। তিয়াস বিশ্বাসের সাথে তার বছর দুয়েকের সম্পর্ক। নিজের পরিবার, সমাজ...  সবকিছুকে একইরকম অপেক্ষা করেই দক্ষিণ কোলকাতায় একটা ফ্লাট ভাড়া করে 'লিভ টুগেদার' এর তকমা নিয়ে একত্রে আছে। যদিও দু'জনে আলাদা-আলাদা ঘরেই থাকে। দু'জনেই দুই বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে। বিয়ে-থা করার কথা তিয়াস বললেও ঝল্লিকা ঝামেলা ভেবেই বারবার এড়িয়ে গেছে।
গত কয়েকদিন ধরেই দু'জনের মধ্যে মন-কষাকষি, ঝগড়াঝাঁটি অব্যাহত। কোরেলি কর্মকার নামে এক নতুন কর্মচারী তিয়াসের অফিসে জয়েন করেছে। অশান্তি তাকে ঘিরেই।
[  ] ঝল্লিকার কানেকানে কেউ বলেছে যে তিয়াস আর কোরেলিকে মাঝেই মাঝেই অফিস ক্যান্টিনে একসাথে দেখা যাচ্ছে। ব্যস্, ওতেই জ্বলেছে ঝল্লিকা। আগুপিছু খোঁজ নেবার প্রয়োজন মনে করেনি ঝল্লিকা। ঝাঁপিয়ে পড়েছে তিয়াসের উপর। 

            গত যৌথ আক্রমণে কেঁদে ফেলল ঝল্লিকা।  ঘরে ফেরেনি তিয়াস। ফোন বন্ধ। সারারাত ছটফট করেছে ঝল্লিকা। ওর অফিস খুলতেই ছুটে গেছে। তিয়াস অফিসে নেই। ১০ দিনের ছুটি নিয়েছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। খোঁজ নিয়ে জানল গত দু'দিন ধরে কোরেলিও অফিস আসছে না।

            এবার সত্যই ভয় পেল ঝল্লিকা।  তাহলে কী তিয়াস কোরেলির সাথেই.....। আপন অনুভূতি ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিল তিয়াসকে সে কতটা ভালোবাসে!

            তিনদিনের মাথায়, বলা নেই - কওয়া নেই, তিয়াসের আর ঝল্লিকার মা-বাবা একযোগে ওদের ফ্লাটে এসে হাজির। ঝিল্লিকা অবাক! তিয়াসের উদ্যোগে আজ ওদের রেজিস্ট্রি বিয়ে। সকাল এগারোটায় ম্যারেজ রেজিস্টার ফ্লাটেই আসবেন। তিয়াস চটজলদি আয়োজনে ব্যস্ত। আর অন্যদিকে দু'জনের অফিসের কয়েকজন কাছের সহকর্মীগণকে
পূর্ব নির্ধারিত হোটেলে হাজির করানোর দায়িত্ব 
তিয়াসের সেই দূর সম্পর্কের বোন কোরেলির উপরই। তিয়াসের চেষ্টাচরিত্রেই ওখানে ওর চাকরি।

           ঝল্লিকা থ। একদিকে তিয়াসের ভালোবাসা, অন্যদিকে সন্দেহের বোকামি.....  এই যৌথ আক্রমণে কেঁদে ফেলল ঝল্লিকা।
 

Friday, July 21, 2023

পাহাড়ি সৌন্দর্যের টানে -- বিজয়া মিশ্র

 পাহাড়ি সৌন্দর্যের টানে
 বিজয়া মিশ্র
১৫.০৭.২০২৩
হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে ভোর চারটের আগেই ভাড়া গাড়িতে উঠে বসলাম সপরিবারে।গন্তব্য টাইগার হিল।গত দুদিন অনেক চেষ্টা করেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলেনি। রিসর্ট থেকে বেরোনোর আগেই গরম চা সার্ভ করেছে হোটেল।তাতে কী, মনে হচ্ছে সবসময় এক কাপ হলে ভালো হয়। গাড়ি সামান্য এগিয়েই দাঁড়াচ্ছে কেন জানতে চাইলে ড্রাইভার জানালো রাস্তা জ্যাম। আধঘন্টার রাস্তা প্রায় দেড়ঘন্টা লাগলো। অবশেষে গন্তব্যস্থলের কিছুটা আগেই নেমে হেঁটে যেতে বললেন ড্রাইভার।অগত্যা চড়াই পথে এগোতেই হল। গতরাতে একই হোটেলে কলকাতার অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।ওনারাও আজ একই পথের যাত্রী।বহুকষ্টে স্পটে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য।সূর্যোদয় কোথায়! দিগন্তরেখা মেঘে ঢাকা। দু একবার লালচে আভা দেখে সবাই উল্লসিত কেউ কেউ বলল "ওই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা।"ঘন মেঘের মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে একচিলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিচ্ছে সত্যিই।ক্রমশ বেলা বাড়তেই হতাশ দর্শকেরা পিছু হটলো।সূর্য চকচকে চোখে হাসছে,কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা লুকোচুরি খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।আমরা ফেরার পথ ধরলাম পাহাড়ের আঁকা বাঁকা ঘিঞ্জি পথে।ফেরার পথে বিভিন্ন মনেষ্ট্রিতে কাটালাম কিছুটা সময়।অবশেষে বাতাসিয়া লুপ। এখান থেকে সুদূরের দৃশ্য দেখার জন্য দূরবীক্ষণের ব্যবস্থা প্রচুর। বাচ্চারা বেশ আনন্দ পেল।সেইসঙ্গে টয় ট্রেনের ধীরলয়ে চলা ভারি সুন্দর।
সারা সকাল খুব আনন্দে কাটিয়ে আমরা ছুটলাম ম্যালে।সহসা বৃষ্টি এলো। অনেক দূরের পাহাড়গুলোও লুকিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে। একটু মেঘ সরলেই পাহাড়ের সারিবদ্ধ আহ্বান ভারি মনোরম।পরেরদিনই ফেরার গাড়ী।রাতেই খবর পেলাম বৃষ্টিতে ধস নেমেছে পাহাড়ে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাদের গাড়ি আসবে রিসর্টের গেটে। সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে সাতপাঁচ না ভেবেই বেরোতে হল।যদি যাওয়া না যায় হোটেলেই ফিরবো আবার সেইমতো কথা হল। ঘুম স্টেশন পৌঁছেই চায়ের জন্য দাঁড়ালাম।আজ ঝকঝকে আকাশ । চায়ের অর্ডার দিয়েই আমরা হতবাক।এ কী দেখছি! কাঞ্চনজঙ্ঘা! অপরূপা সুন্দরী রূপোলী মুকুটে সুশোভিতা,হাসিতে মুক্তো ঝরিয়ে হাতছানি দিয়ে এভাবেই বুঝি পাগল করে অনাদি অনন্তকাল ধ'রে মুগ্ধ ,সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষকে। অনেক ভালোলাগা,অনেকটা তৃপ্তি সঙ্গে নিয়ে ফিরেছি আমরা। আনন্দের আবহে ভুলেই গিয়েছিলাম পাহাড়ের ধসের খবরটা। ফেরার পথের দুদিকে তখন সোনালী রোদে ঝিকমিক করা পাড়াড়ের সারি, পাহাড়ি ঝর্ণার নেমে আসার মধুর ধ্বণিতে আপ্লুত হয়ে দেখছিলাম সকলে। আমাদের ড্রাইভার কত নামও বলছিল । পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘন বনের ছায়ায় নাম না জানা পাখিরা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল।ওই সময়ের মধ্যেই সুরক্ষাবাহিনী অবশ্য গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা কিছুটা পরিস্কার করে দুশ্চিন্তা দূর ক'রে দিয়েছিল। নিরাপদে পৌঁছে আমাদের স্মৃতিরোমন্থনে আচমকা ধাক্কা। মিডিয়ার দৌলতে  সমস্ত ভালোলাগার আবেশে নিমেষে হোঁচট খেল। আমাদের সঙ্গে যে পরিবারটির রিসর্টে আলাপ হয়েছিল ,যাঁরা টাইগার হিলে ওঠার দুরূহ কষ্টে  বেশ কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গী ছিলেন তাঁরা আজ টয় ট্রেনে ভ্রমনকালে পরিবারের কর্তা শোভনবাবু টয়ট্রেনের গেটে হাত ছেড়ে দাঁড়িয়েছিলেন ।  বাতাসিয়া লুপে বাঁক নিচ্ছিল টয়ট্রেন।তখনই আচমকা পড়ে গিয়েছেন তিনি।মাথায় মারাত্মক চোট পেয়ে কোমায় চলে গেছেন। ওখানেই আপাতত চিকিৎসা চলছে প্লেনে কলকাতায় আনার চেষ্টা চলছে।অত্যাধিক রক্তক্ষরণের জন্য চিকিৎসকেরা কোন আশা দিতে পারছেন না। এমন অভাবনীয় একটা খবরে আমরা সকলেই অপ্রস্তুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।চোখের সামনে আনন্দে ঝলমল করা বাতাসিয়া লুপের ছবি ভেসে উঠছে সঙ্গে বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা যন্ত্রনা...।

Thursday, June 15, 2023

এবং রূপকথা -- সিরাজুল ইসলাম ঢালী

এবং রূপকথা 
           --- সিরাজুল ইসলাম ঢালী
তারিখ : ১১.০৬.২৩
           হীরের টুকরো ছেলে ! ডাক নাম হীরে । ভালো নাম পলাশ পাল চৌধুরী ।  মিষ্টার এবং মিসেস্ পাল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে । এ বছরে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠল । পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র । পড়াশুনা আর হাজার রঙিন স্বপ্নের মাঝে হীরের এক বিশাল ঘটনা ঘটে গেল । পূজার ছুটিতে হীরে বাড়িতেই ছিল । বাড়ি বসিরহাট । তখন গোধূলি বেলা, রবিবার । বাড়ি থেকে তিরিশ চল্লিশ মিটার দূরে একটা সবেদা গাছ । গাছটায় উঠে খেলাচ্ছলে গান করতে করতেই ডালপালার উপরে হীরে শুয়ে পড়েছে । কখন চোখে নিদ্রা এসে পড়েছিল, তাও তার অজানা । তারপরে ? হঠাৎ এক শ্বেতশুভ্র ছোট্ট পাখি হীরের কাছে উড়ে এসে বসল । ডানায় লেখা, এসো আমার ডানার উপরে বসো । ঘুম চোখে হীরে বসেই পড়ল । তৎক্ষণাৎ পাখি উড়ে চলতে শুরু করল । সন্ধ্যা হয়ে গেল । কোথাও হীরেকে পাওয়া যাচ্ছে না । বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই কান্নাকাটি শুরু করল । এক দিকে খোঁজাখুঁজি চলছে, অন্য দিকে একদল মানুষ থানার দিকে ছুটল...। 
            হীরে আর পাখি হাজার কোটি মাইল উড়ে চলল । তার পরে মনোরম ভূস্বর্গে হীরে এসে নামতেই দেবদেবীরা ছুটে এলেন । সবাই মিলে হীরেকে রাজমুকুট পরিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা রূপে স্বীকার করে নিলেন । রাজাধিরাজ হীরে বিয়ে করে রাজরানী এবং পরে রাজপুত্র সহ রাজকন্যা লাভ করলেন । রাজপ্রাসাদে কোনো  অভাব নেই, শুধুই আনন্দ আর আনন্দ । রাজভোগ থেকে নাচ গান অঢেল ! ভালোবাসার শেষ নেই ! রাজাধিরাজ হীরে ভালোবেসেই হাজার হাজার দেশ জয় করলেন । ভালোবেসেই কোটি কোটি হৃদয় ও প্রকৃতি জয় করে ধনধান‍্যেপুষ্পে আর অর্থের প্রাচুর্যে তিনি রাজত্ব করতে লাগলেন । স্বর্গ মর্ত‍্য পাতাল ধন‍্য, ধন‍্য সমস্ত প্রজাবর্গ ।           
             অবশেষে রাত্রি বেলা পুলিশ সহ সবাই আলো নিয়ে জোরদার অনুসন্ধান শুরু করলেন । মায়ের চোখের জলে সব ভিজে গেল । মা যখন কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন,
... কোথায় ? কোথায় আমার হীরের টুকরো, হীরে...? মায়ের গলার শব্দে হীরের ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখন গাছ থেকে নেমে হীরে সোজা ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল । শেষ হল স্বপ্ন, শুরু হল বাস্তব... ।

Tuesday, May 16, 2023

নারী হতে সাবধান -- মৃনাল কান্তি রায়


নারী হতে সাবধান
মৃণাল কান্তি রায় 
অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে ঘূর্ণি। পাড়াময় ঘুরে বেড়ালোই যার কাজ।এ গাছে সে গাছে চড়া আর ফলগাছের ফল পাড়া যার নিত্য দিনের কাজ। এ ছাড়াও বর্শী নিয়ে এ পুকুর ও দীঘি আর এ খাল সে খালে মাছ ধরা- যাও তার সখ তালিকায়। কখন যে সে তরুনী থেকে যুবতী হয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। মায়ের শত বকা- ঝকাকে উপেক্ষা করে সে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। এজন্য গ্রামের সবাই তাকে নাম দিয়েছে ঘূর্ণি। উঠতি বয়সি ছেলে ছোকরারা তার ঐশরিয়ার মত রূপ দেখে প্রেমে পাগলপারা হয়ে ভাব জমানোর জন্য কাছে ঘেঁষতে চায় কিন্তু ঘূর্ণি কাউকেই পাত্তা দেয় না একদম। কেবল সে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে স্বর্ণকে মন থেকে পছন্দ করে।পছন্দ করার কারণ হোলো স্বর্ণ দেখতে ঠিক সোনার রঙের গৌড় বর্ণীয়। পছন্দ করার অপর কারণ হোলো স্বর্ণের একটি মাত্র স্লোগান 'নারী হইতে সাবধান' নয়তো কেড়ে নেবে জান'। 
একদিন স্বর্ণ গ্রামের এক পুকুরে সাঁতার কাটছে। বেশি গরম পড়েছে ঠিক তাই। সেই পথ ধরে ধেই ধেই করে যাচ্ছিল ঘূর্ণি। সে দেখতে পেল পুকুরে সাঁতার কাটছে স্বর্ণ যাকে সে মন থেকে পছন্দ করে কিন্তু স্বর্ণ পাত্তা দেয়না তাকে। সে এও জানে নারী বিশেষ করে যুবতী নারী তার চোখের শুল।কারণ তার এই ধারণা যে সব স্লিম ছেলেরা কোন যুবতী নারীকে বিয়ে করে পরবর্তীতে তারাই স্লিমত্ব হারায়। আর সে কারণেই ঘূর্ণির বদ্ধমূল ধারণা স্বর্ণ ছাড়া সাত গ্রামে আর ভাল ছেলে নেই। তার মানে স্বর্ণ নিখাদ ছেলে এবং সে শুধু তার সাথেই ভাব করবে এবং জীবনসঙ্গী করে চিরকাল নিখাদ জনকে পাশে রাখবে। পুকুরে সে স্বর্ণকে একের পর এক আড়াল থেকে ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে-ই! স্বর্ণের চারপাশে বৃষ্টির মত ঢিল পড়ছে আর এতে করে স্বর্ণ প্রথমে ভাবছে বৃষ্টি হচ্ছে- যার জল পুকুর থেকে ছিটকে তার গায়ে পড়ছে। তার এ ভাবা যে ভুল তা সে নিমিষেই বুঝতে পারল।কারণ সে দেখতে পেয়েছে ঘূর্ণির ঢিল ছোঁড়ার দৃশ্য। এ জন্য সে পুকুর থেকেই বলে উঠল," নারী থেকে সাবধান। নারী জ্বালাময়ী ভীষণ যন্ত্রণা আর পীড়াদায়ক। ভাইসব কেউ কোন নারীর ধারে কাছেও ঘেঁষবেন না।ঘেষলেই স্লিমত্ব আর ধরে রাখতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি! " সে যতই এমন সব কথা বলছে আর যে জন্য বলছে ফল দাঁড়াচ্ছে ঠিক উল্টোটা। একক প্রেমের প্রেম নদী কানায় কানায় যেন পূর্ণ হচ্ছে।কারণ ভাল মেয়েরা কখনো তাদের মনের জনের বাইরে আর কাউকেই সহ্য করতে পারেনা। এদিক থেকে স্বর্ণই যে পারফেক্ট হবে এ ঘূর্ণি বুঝে নিয়েছে। তাই বলছে," সজনেটায় একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না! " গাছপালাকে উদ্দেশ্য করে বলছে," তোমরাই বল,আমি কি দেখতে কম সুন্দর নাকি। তোমরা যদি প্রকৃতি হও তবে আমিওতো প্রকৃতি,তাইনা? " গাছপালা যেন সায় দিয়ে বলে চলছে," ঘূর্ণি!  তুমি পিছু ছেড়োনা। একদিন না একদিন তুমি মনের মানুষকে পাশে পাবে।নিরাশ হয়োনা কেমন?" এরপর ঘূর্ণি বলছে," আমার নামও ঘূর্ণি!  ঘূর্ণির মত ঘুরাব যদ্দিন আমার কথায় সায় না পাব। দেখি কে তাতে বাগড়া দিতে আসে। তাকে ঠিকই আমি দেখে নেব। " এই শুনে স্বর্ণ বলছে," যা যা যেদিকে যাবি সেদিকে যা! আমার পিছু লাগা কেন হ্যা!" এবারে ঘূর্ণি বলছে," কেন যে ঘুরঘুর করছি তা বুঝতে হোলে আলাদা একটা মন থাকা চাই-যা তোর নেই! আর মেয়েদের কথা বলছিস? আরে আমি কি আর পাঁচটা মেয়ের মত এই ভাবিস।না রে না আমি তেমন মেয়ে নইরে!  আরে কার কাছে কি বলছি! তোরতো আবার স্লোগান নারী হইতে সাবধান! তা তুই নারীর মর্ম কি বুঝবি রে বুদ্দু!  একবার মেনেই নে দেখবি অনেক মজা অনেক আনন্দ!" এই শুনে স্বর্ণ বলছে," ওওও এই কথা!  আমার স্লিমত্ব নষ্ট হোক এই তুই চাস। আরে তুই কি করে বন্ধু হবি,তুইতো দেখছি পাক্কা শত্রু! " এবারে ঘূর্ণি তার ওড়নার একধার দুলিয়ে দুলিয়ে চলে যাচ্ছে আর বলছে," টাটকা আছিরে বুদ্দু! তুই ছাড়া এ মনে আর কারোর স্থান নাই! তোকে আমার চাই-ই চাই! আজ চলে যাচ্ছি তবে পিছু ছাড়ছি না। "ঘূর্ণি স্বর্ণের চোখের অদৃশ্য হোলে স্বর্ণ পুকুর থেকে উঠে তার বাড়ি চলে গেল। 
এর কিছুদিন পরে একটি মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে ঘূর্ণি যাচ্ছে ওই দূরে পদ্ম পাতার দীঘিতে জল নিয়ে আসতে। সে ঘাট থেকে জল ভরে বাড়ির দিকে ফিরছিল।হঠাৎ সে দেখতে পেল বিপরীত দিক থেকে আসছে তার পছন্দের স্বর্ণ। এবারে সে ভান ধরল। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে আর কলসির জল মাটি ভিজিয়ে দিয়েছে। তার মাঝে বেহুশ অবস্থায় ঘূর্ণি!  এবারে প্রথমত অতস্তত করে বলছে," মানুষের উপকার করা মানুষের ধর্ম কিন্তু আমার স্লোগান নারী হইতে সাবধান তার কি হবে। এত করে ডাকছি,সারা দিচ্ছেনা। কেউ যদি দেখে ফেলে তখন কি হবে। পাছে যদি মরে গিয়ে থাকে তবে তো জ্যান্ত না মৃত ঘূর্ণি আমায় জেলের ভাত খাওয়াবে।আর জেলখানায় শুনেছি পঁচা আর বাশি খাবার খেতে হয়! বিবেক! আমি এখন কী করতে পারি?" বিবেক ধমকিয়ে উঠে বলল," তুই এখনো কোলে তুলে নিসনি! আরে তুই কী পুরুষ?  এত্তসব আজেবাজে চিন্তা করে চলেছিস। নে শিগ্গির কোলে তুলে নে! ঘূর্ণিকে ওর বাড়িতে সসম্মানে পৌঁছে দিয়ে আয়!" এবারে স্বর্ণ বলছে," আরে যাচ্ছি যাচ্ছি মারী হইতে সাবধান আর বিপদে পড়লে উপকারী হয়ে সমাধান!" এই বলে স্বর্ণ ঘূর্ণিকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে ঘূর্ণিদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ ঘূর্ণি একলাফে নিচে নেমে বলছে," কি! কিছু মজা পেলে? আমিতো বেশ পেলুম!" এবারে স্বর্ণ রাগে কটমট করে বলল," হতচ্ছাড়ি পাজি কোথা কার!  ফের তুই মরে গেলেও তোর কাছে ঘেষব না! আমার স্লিমত্ব নষ্ট করে দিতে চাস! তুই মানুষ না।আস্ত একটা জন্তু জানোয়ার! আমার এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আর উনি দাঁত বের করে হাহা হিহি করছে! " এবারে ঘূর্ণি নিজের দু'কান নিজেই মলে মলে বলছে," রাগ করিসনা।আর এমনটি কখখনো হবেনা রে! তুই মন খারাপ করিসনা!" এই বলে ঘূর্ণি তাদের বাড়িতে আর স্বর্ণ তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। 

এর কিছুদিন বাদে ঘূর্ণি আবার পদ্মপাতার দীঘিতে জল আনতে গেল। মায়ের বকুনি খেয়ে তার জল আনতে যাওয়া কিন্তু তার শরীরটা এদিন একদম ভালো যাচ্ছিল না। তাই জল নিয়ে ফেরার পথে কাঁখের কলসি কাঁখ থেকে রাস্তার মাঝে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল এবং কলসি ভাঙার ওপরে ঘূর্ণি ঘুল্লা খেয়ে পড়ে গেল।আর তাতে করে মাথাটা কিঞ্চিৎ কেটে গেল! রক্ত কপালে টিপের ন্যায় জমাট বেঁধে আছে। পুরোপুরি অচৈতন্য সে। এদিনও স্বর্ণ একই পথে আসছিল এবং ঘূর্ণিকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বলল," ফের ভেলকি! আবার লাল টিপ দিয়েছে কপালে! কি সখ রে বাপু! আজ কি আর ভুল করি! পড়ে থাক আজন্মকাল তাও আমি তোকে স্পর্শ করছি না। নারী হইতে সাবধান!" এই বলে স্বর্ণ হন হন করে সেখান থেকে চলে গেল।এবারে ওই পথেই এক বুড়ো ভদ্রলোক আর তার ছেলে- যে কিনা ঘূর্ণিকে পছন্দ করে কিন্তু ঘূর্ণি যাকে পাত্তা দেয় না তারা ঘূর্ণিকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে তড়িৎ তাকে তুলে নিয়ে নিকটস্থ একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেল। ক্লিনিক কর্মকর্তা ঘূর্ণির মাথায় ব্যাণ্ডেজ করে দিয়ে বললেন," চিন্তার কোন কারণ নেই।এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘূর্ণি ভালো হয়ে উঠবে।" ভদ্রলোক ঘূর্ণিকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন। 
এর ক'দিন পরে স্বর্ণি পাশের একটি টিস্টলে বসে দুধ ছাড়া রঙ চা পান করছিল।এমন সময় দোকানীর কাছে জানতে পেল ঘূর্ণির মাথা কেটে গেছে।কেউ একজন তাকে চিকিৎসা করিয়ে তার বাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।এই শুনে স্বর্ণের মনে ভাবনার উদ্রেক হোলো। সে ভাবলো মস্ত বড় অন্যায় সে করেছে।পীড়িতকে সেবাদান মানবধর্মে পড়ে- যা সে না করে পুরোপুরি পীড়িতকে ইগনোর করে গেছে- যাতে করে তার পাপ হয়েছে। তাই সে দ্রুত ঘূর্ণির বাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে একসময় পৌঁছে গেল গন্তব্যে। গিয়ে দেখল চঞ্চলা ঘূর্ণি আনমনা হয়ে বসে আছে।এবারে স্বর্ণ ঘূর্ণির হাতদুটো আপন ক্রোড়ে নিয়ে বলল," ঘূর্ণি!  তুই আমাকে মাফ করে দে।আমি মস্ত একটা অপরাধ করেছি।ভেবেছিলাম তুইতো ভেলকি ধরিস আমাকে দেখলেই। তাই ভাবছিলাম তুই ভেলকি ধরেছিস। আমাকে মাফ করে দে। " এই শুনে ঘূর্ণি বলছে," তার আগে বল, হাত কি আমি তোর ধরেছি না তুও যেচে আমার হাত ধরেছিস। তোকে আমি মাফ করতে পারি যদি তুই আমার মন ধরতে পারিস নয়তো এ কসুরের কোন মাফ আমার অভিধানে জানা নাই।" এই শুনে স্বর্ণ বলছে," হাত যখন ধরতে পেরেছি তখন তোর মনও ঠিক ধরতে পারব। তবুও অর্জিত পাপ খণ্ডাতে চাই। " এই শুনে ঘূর্ণি বলল," তবেতো কথাই নাই তুই পাপ মুক্ত হলি। এবারে তোর স্লোগান পাল্টাবি এক পুরুষ এক নারী মিলেমিশে সংসার গড়ি!" এরুপর? ----------! থাকনা কিছুটা আকাঙ্ক্ষা। 

Wednesday, October 6, 2021

রূপার মা -- ধীরেন গোস্বামী

রূপার মা
ধীরেন গোস্বামী
--------------------------


রানুর মায়ের সাথে রূপার মায়ের খুব ভাব
রানু আর রূপা একই স্কুলে একই ক্লাসে দুজনে পড়ে
তাই স্কুলে যাতায়াত করে মায়েদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে
কিন্তু আজ কদিন হলো রূপার মা রূপাকে নিয়ে 
আর স্কুলে আসছে না দেখে
রানুর মা খুব চিন্তায় পড়ে যায়, 
তাই রবিবার দিন রানু কে সঙ্গে নিয়ে রানুর মা রূপাদের ঘরে খোঁজ খবর নিতে আসেন 
রূপার মা রানুর মাকে দেখে বললো আর বোলো না ভাই 
যা ঝড় গেলো, 
রানুর মা বললো কি রকম ?
রূপার মা বললো বসো বসো আগে চা করি
চা খেতে খেতে সব কথা হবে
রানুর হাতে একটা বাটিতে কতকটা চাঁছি দিয়ে বললো এটা তুই খা এটা ঘরের দুধের চাঁছিরে
খুব সুন্দর খেতে দারুণ স্বাদ,
রানুর মা বললো বা ঘরে গরুও আছে দেখছি 
রূপার মা বললো চা করে নিয়ে আসি
এসেই সব বলছি 
কিন্তু এই কথা ভাই আর পাঁচ কান
করা চলবে না
নইলে আমি সমস্যায় পড়ে যাব
বলেই চা বানাতে চলে গেল,
চা নিয়ে এসে বললো এই চা খাও
ঘরের খাঁটি দুধের চা
রানুর মা বললো এবার কথা টা কি বলুন শুনি,
রূপার মা বললো বলছি বলছি চা টা খাও
গল্প আরম্ভ করলো
আর বোলো না ভাই তোমাকে তো আগেই
বলে ছিলাম যে আমার স্বামী ছোট থেকেই 
স্টেশনের পাশে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে কাজ করে ডাক্তার বাবু খুব ভালো মনের মানুষ গো
আমার স্বামী কে খুউব ভালো বাসে
বলেই এক চুমুক চা খেলো
রানুর মা ও এক চুমুক চা খেয়ে বললো তার পর কাজ এখন করছে তো ?
রূপার মা বললো বলছি চায়ের কাপ টা শেষ করে পাশে নামিয়ে রেখে বললো জানো তো আমার স্বামীর মনটা খুব দয়ালু 
এই যে আমার ঘরে এতো দুধ হয় ও বলে সবাই কে খাওয়াও প্রতিদিন ডাক্তার বাবুর জন্য চেম্বারে যাওয়ার সময় এই দুধ দিয়ে কিছু না কিছু খাবার করে নিয়ে যাবেই ডাক্তার বাবুর জন্য
রানুর মা অধৈর্য হয়ে বললো এতো দিন স্কুল কামাই হলো রূপা স্কুলে যাচ্ছে না 
এর সঙ্গে তো স্কুল কামাই এর কোন যোগ নেই
রূপার মা বললো, আছে গো আছে বিরাট এক্সিটেণ্ড ওই উপর ওয়ালা মানে ভগবানের করুনা
আর ডাক্তার বাবুর পাকা হাত যশ
আমার স্বামী ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যাওয়ার সময় দেখতে পায় লাইন উপরে একটা বড়ো দুধেল গাই চরে বেড়াচ্ছে, এদিকে রেড সিগন্যাল হয়ে আছে
ওর তো দয়ার শরীর আর কি বলবো ভাই যেই গাই টার লেঁজ টা ধরে তাড়াতে গেল ওমনি আনাড়ি লোক দেখে গাই টা জোরে মারল
এক চাঁটি ব্যস্, 
রানুর মা বললো তারপর ?
রূপার মা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো তারপর, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন,
রানুর মা বললো, দিয়ে কি হলো, 
আর কি বলবো ভাই লাইনের উপরেই দড়াম করে পড়ে গেল
রানুর মা বললো যাক কোনো বিপদ হয় নাই তো ?
রূপার মা বললো, বিপদ বলে বিপদ এক্সপ্রেস ট্রেন ঝাঁ করে পার হয়ে চলে গেলো
রানুর মা বললো, ও মাগো দাদার কিছু হয় নাই তো 
রূপার মা বললো হয়ে ছিলো ট্রেন টা চলে যেতেই প্রচুর ভিড় হয়ে ছিলো
রানুর মা বললো ভিড় হোক
দাদার কিছু হয় নাই তো, 
রূপার মা বললো না তেমন কিছু হয় নাই
শুধু গাই টার সামনের দিক টা
আর আমার স্বামীর কোমর পর্যন্ত গুড়ো করে
দিয়ে চলে গেলো-
-ডাক্তার বাবু ভাগ্যিস ওই সময় ওই খানে পৌছে যায় আমার স্বামীকে চিনতে পেরে স্বামী কে আর ওই গাভী টিকে তুলে নিয়ে গিয়ে অপারেশন টেবিলে রেখে গাভীর পিছনটা আর আমার স্বামীর সামনেটা জুড়ে দেন ডাক্তার বাবু 
রানুর মা বললো তারপর
রূপার মা বললো 
কি সুন্দর সেলাই করেছে গো
কিচ্ছু বোঝার উপায় নাই 
এখন সম্পূর্ণ সুস্থ প্রতিদিন কাজে ও যায়
সকালে বিকেলে মিলে পাঁচ ছয় সের দুধ ও দেয় 
রানুর মা বললো বাবাঃ তোমার কি ভাগ্য গো দিদি 
আমার স্বামীটা তো কুড়ের বাদশা,
রূপার মা বললো চাইলে তুমি প্রতিদিন দুধ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারো
এমন সময় রূপা ও রূপার বাবা বাজার করে বাড়ি ডুকতেই
রানু র মা বললো, কি দাদা কেমন আছেন আপনি 
এখন আর পায়ের কোন অসুবিধা নেই তো
পায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো আপনার ধুতিটা একটু উপর দিকে তুলুন তো দাদা 
আমি আপনার পা দুটো একবার দেখবো,
রূপার বাবা অবাক হয়ে বললো তার মানে,
রূপার মা হো হো করে হেসে উঠলো, বললো তুমি ভাই স্কুলে অনেক হাসি মজার গল্প শোনাও
তাই আজ তোমাকে ঘরে একা পেয়ে
ফাঁকা সময়ে 
একটা ছোট্ট নমুনা দিলাম মাত্র দেখলে তো
বানিয়ে গল্প বলতে আমি ও জানি।

ছাত্র যখন শিক্ষক ডঃ সঞ্জীব রায়


ছাত্র যখন শিক্ষক
------------------------
ডঃ সঞ্জীব রায়
------------------------



রাহুল ছেলে হিসেবে বড়ই ভালো। একটাই দোষ, পড়াশোনায় মন নেই। বাবা-মা আর এক বোনকে নিয়ে সংসার। বেশ কষ্টেই চলে।  বাবা হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। নবম শ্রেণীর ছাত্র রাহুল পারলৌকিক ক্রিয়া মিটে যাওয়ার কয়েকদিন পর স্কুলে হাজির হয়।

প্রথম দিনেই দ্বিতীয় ক্লাসটি অনিলবাবুর, ইংরেজি। অত্যন্ত বদরাগী অনিলবাবু কারণে-অকারণে প্রহার করেন। সেদিন তিনি Tense পড়াচ্ছিলেন। রাহুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমার বাবা ৭দিন ধরে জ্বরে ভুগিতেছেন - এর ইংরেজি কী হবে?" পড়া না পারলে রাহুল চুপ করেই থাকে। সেদিন কি হলো, ছলছল চোখে বলে ফেলে "আমার বাবা একমাস আগে গত হয়েছেন।" ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা না বুঝেই হেসে ওঠে৷ রেগে অনিলবাবু পাগলের মত রাহুলকে প্রহার করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে হেডমাস্টারমশাই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে প্রচন্ড কাঁপতে থাকা রাহুলকে একটি ছেলের সঙ্গে বাড়ি পাঠান।

দুদিন পরে অনিলবাবু কি মনে করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিজের নাম গোপন করে রাহুলকে দেখতে যান। দরজার সামনে সাদা কাপড় পরিহিতা এক মহিলা নিজেকে রাহুলের মা বলে পরিচয় দিলেন। কঠিন হৃদয় অনিলবাবুর মূহুর্তের উপলব্ধি, হয়ত রাহুল সত্যি কথাই বলেছিল। জিজ্ঞাসা করেন "রাহুল এখন কেমন আছে ?" উত্তরে মা বলেন, "জ্বর আছে। দুজন সহপাঠী বলেছিল স্কুলের মাস্টারমশাই অনিলবাবু ওকে খুব প্রহার করেছেন। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করলে বলে - মা উনি খুব ভালো। আমি বন্ধুদের সঙ্গেই মারামারি করেছি।" অনিলবাবু আর বসতে চাননি।

বিদায় নেবার মুহূর্তে রাহুলের মা হাতজোড় করে বলেন, "মহাগুরুনিপাত বছর, খুব ভয়ে আছি ওকে নিয়ে। দয়া করে একটু আশীর্বাদ করে দেবেন।" অনিলবাবু তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 


মৌমিতা সরকার


তিন টাকার গল্প
-----------------------
মৌমিতা সরকার
 ----------------------- 


-"তিনটে টাকা দিবি?"
ব্যান্ডেলের তিন নং প্ল্যাটফর্মে ডাউন ট্রেনের জন্য আনমনে অপেক্ষা করার সময় আচমকা সম্বিত ফিরল এই প্রশ্নে। পিছন ঘুরে দেখি একটা বুড়ি, শতচ্ছিন্ন,  মলিন একটা শাড়ি পড়ে ডান হাত টা বাড়িয়ে বসে আছে। ওর দিকে তাকাতেই ফোকলা মাড়ি বার করে নিষ্পাপ একটা হাসি হেসে আবার বলল-
-"দিবি তিনটে টাকা?"

এই স্টেশনে পাগলীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হঠাৎ যদি কোনো পাগলীকে দু হাত বাড়িয়ে কোনো এক অসহায় নিত্যযাত্রীর পিছনে দৌড়তে দেখা যায় ( উদ্দেশ্য কখনও কখনও বলপূর্বক চুম্বনও হতে পারে) তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে যাই হোক, তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম গত তিন চারদিন স্কুলের half yearly পরীক্ষার খাতা দেখার চাপে লোকজনের সাথে কথা বলার তেমন সময় পাইনি। হলই বা একটা পাগলী, খানিকটা গল্প করা যাক।

-"দিবি না? একটা, দুটো, তিনটে টাকা?"
-" হ্যাঁ, দেবো তো। তা তুমি এইরকম ঝড়-জলের দিনে স্টেশনে বসে ভিক্ষা করছ কেন? ঘর বর নেই? না ছেলে বউ দেখে না?"
-" কি বললি? ঘর, বর, ছেলে!! হ্যা হ্যা হ্যা...সব ছিল, সব। কপাল বুঝলি?"
-" না বুঝলাম না। নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিয়েছে?"
-" তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই দেখ আকাশ টা দেখ। ওই আকশের ওপারে নাকি বলে ভগবান আছে। চোখে ছানি পড়েছে তো। আমি আর তাকে দেখতে পাই না। তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, বুঝলি? ওই শা' ভগবান আমায় ঘর বর ছেলে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর ওই তিনটে শব্দ, ওই তিনটে শব্দ তাড়িয়ে মারছে আমায়। যেদিকে যাই।"

বুঝলাম মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বেশ কিছুটা।  ট্রেন আসতে তখনও খানিক দেরি। কিন্তু আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে।

-"আচ্ছা, তোমায় ওরা এমনি এমনি তাড়িয়ে দিলো? ভালোবসেনি কখনও? "
-" হ্যা হ্যা হ্যা.....খুব বেসেছে।  ওইরকম ভালো আর কেউ বাসেনি বুঝলি? বর আমার খুব খেয়াল রাখত। সাত বাড়ি কাজ করে বাড়ি ফিরতাম যখন, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। সে মুখখারাপ করত খুব, কিন্তু রান্না করে দিত। আর রাতের বেলা আদর করত খুব। কিন্তু ওই যে ওলাউঠো ভগবান! সহ্য হল তার? হঠাৎ করে একদিন সে ঘুম থেকে আর উঠল না রে। সে কি ঘুম.... কি ঘুম। আমার কেন এমন ঘুম হয় না? গুনে গুনেও ঘুম হয় না।
এক..দুই...তিন
এক..দুই...তিন।"
-"আর তোমার ছেলে?"
-" আমার ছেলে....আমার ছেলে...."
-" হ্যাঁগো তুমি বললে না? ঘর...বর...ছেলে।"
-" সেদিন রাতে তাকে নিয়ে চলেই গেলো।  ভোটের সময়। খুব অন্ধকার।  সবে সবে ঘুমিয়েছে সে। দরজায় তিনটে টোকা। খুলতেই হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়ল একদল লোক। তারপর কি মার মারল রে আমার ওই বাচ্চা ছেলেটা কে। ওদের বুক কি পাথর দিয়ে গড়া? হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। হাতে ধরে,  পায়ে পড়েও আটকাত পারলাম না। আমার দেবশিশু টা রে, আমার বাপ, আমার কোলজোড়ানো হাসি... 
কালী পুজোর বলির সময় ছাগলটা যে শেষ ডাকটা ডাকে, আমি তখন ছেলের মুখে সেই ডাকটা শুনেছিলাম। তারপর...তারপর..."
-"তারপর?"
-"তারপর ওই তিনটে আওয়াজ। ফট, ফট, ফট। আমার ছেলের আওয়াজ তখন থেমে গেছে। আমি আর ভাবতে পারি না, আর..আর গুনতে পারি না। এক..দুই...তিন...তারপর তো সবকিছু হারিয়ে গেছে।
.........................
দিবি? আমায় তিনটে টাকা?"

ট্রেন টা আসতেই ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।  পাগলীটার ঘোলাটে চোখে এক পৃথিবী কষ্ট। আমার কিছু বলার নেই। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যা ছিল সবটাই বার করলাম। শুনেছি নাকি, কাউকে দিতে গেলে হাতে যা ওঠে তাই দিতে হয়। হাতে উঠলো ওই তিনটে টাকাই। কপাল! ভেবেছিলাম কিছু বেশিই দেবো। টাকাগুলো দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়ল। মুখ বাড়িয়ে দেখি, সে আপন মনে গুনেই যাচ্ছে,
এক....দুই....তিন*********

Tuesday, October 5, 2021

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে 
অনিল চন্দ্র সিকদার
------------------------------ 


গ্রামে মানুষ থাকলে ভূতও থাকবে। মানুষ আছে ভূত নেই, ছেলে বেলায় আমরা ওটা কল্পনা করতে পারতামনা। আমাদের বাড়িটার সামনে পুকুর, দক্ষিণে খাল, খালটা গেছে সেনদের বাড়ির পাশ দিয়ে। মাঝখানের জায়গা টা অন্য কারোর। বড় একটা আম বাগান। পিছনে একটা জামরুল গাছ, আর আমাদের  আম বাগান। আমগাছ গুলি এত বড় যে ঐ গাছ বট গাছের মত। উঠাও  মুস্কিল। 
আমগাছের পাশে ঘন  বেতের জঙ্গল চারিদিকে ঘন অন্ধকার। কাছেও যাওয়া যায়না। গাছে বড় বড় অজস্র কাঁঠ পিঁপড়ে। গায়ে রসুন গোটা তেল মেখে না উঠলে, কারো সাধ্য নেই  গাছে উঠে। 
এহেন ঐ বিশাল গাছটায় এক ভুতের আবাস ছিল। 
অগম্য জায়গা হলেই আমাদের ধারনা হয়, ওখানে 
ভুত থাকে। রাতে আমরা কোনো ভাই বোনেরা  একলা  ঘর থেকে বের হতে সাহস পেতামনা। 

ন-বছরে আমার উপনয়ন হয়। উপবীত হয়ে ও আমাকে ভূতের  ভয় থেকে রক্ষা করতে পারেনি। 
ছোট কাকা বাড়ি না থাকলে আমার কিংবা বড় দারপালা পড়তো ঠাকুরের বৈকালি দেওয়ার। ভূতের ভয় থেকে গৃহদেবতা  ও তখন  মুক্ত  থাকতেন না। ঠাকুর ঘরের পাশে ছিল দুটো বড় তালগাছ। তাল হত না। কোন অশুভ প্রভাব না থাকলে গাছ অন্যান্য হয়না। তাই মনে  হচ্ছে আমাদের কাছাকাছি যিনি থাকেন  ওনি আমাদের ছোটো ঠাকুর দা। তাঁর পৈতা হওয়ার আগেই নাকি তিনি সামনের পুকুর টার জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। তালগাছ দুটো তাঁরই লাগানো। ছোট বয়সেই ছোট ঠাকুর দার গাছ পালার বাতিক ছিল। 
তালগাছ  আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। 

যাই হোক ছোট ঠাকুর দা মারা যাওয়ার পর বড় ঠাকুর দা গয়া ধামে গিয়ে পিন্ড দান ও করেছেন। অথচ তারপরও নাকি বড় ঠাকুর দাঐ তালগাছে ছোট ঠাকুর দাকে কয়েকবার দেখেছেন। বিশাল
দৈত্যের মত চেহারা এক পা তালগাছে আর এক পা আমগাছে দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর আমাদের  বাড়ির দিকে  তাকিয়ে  বাড়ি পাহারা দিতেন। ছোট ঠাকুর দা  ভূতটি বরং আমাদের কোন ক্ষতি করেননি, ভালই করেছেন। বরং  তারই দয়ায় নাকি আমাদের বাড়িতে অপমৃত্যু ও অকাল মৃত্যু ঘটেনি। শিশুদেরকে টৌকায় ধরে না। বাড়িতে শিশু  জন্মালে মরেনি। বাঁচে বড় হয়। সবারই ধারণা ছোটো ঠাকুর দা আছে বলেই বাড়ির সবাই ভাল আছে। ভূত যেমনটা ভাল আবার তেমনটা  খারাপ ও আছে।

Friday, July 2, 2021

গৌতম তরফদার

নতুন অধ্যায় 
গৌতম তরফদার 

               বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য সংস্থায় লেখালেখির কারণে পাঠক মহলে বিপ্রতীপ তালুকদারের পরিচিতি অনেকটাই বেড়েছে। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। বিপত্নীক।
বছর দুয়েক আগে পাহাড়ের কোলে বেড়াতে গিয়ে আকস্মিক হড়কা বানে স্ত্রী আর আট বছরের একমাত্র কন্যাকে হারিয়েছে। সেই থেকে বিপ্রতীপ পুরোপুরি একা। মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দিদি তার আপন পরিবার নিয়ে আসামের গোয়ালপাড়ায় থাকে। বিপ্রতীপ অফিস আর লেখালেখির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
      
              ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিন বেশকিছু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। বিপ্রতীপের বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর তেমন আগ্রহই নেই। একদিন কেতকী মজুমদার নামের একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। প্রোফাইল পিকচারে একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হুবহু যেন তার হারানো মেয়ের মুখ। স্মৃতির জোয়ারে ভেসে যায় বিপ্রতীপ। আর কিছু দেখতে পায় না প্রোফাইল লক থাকার কারণে। আনমনেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে নেয়। 

             বন্ধুত্ব শুরু। কেতকীর স্বামী রাজশেখর বছর কয়েক আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অভিশপ্ত জলন্ত কামরায় ওরা তিন জনই ছিল কাশ্মীর টুর থেকে ফেরার পথে। কেতকী তার মেয়ে পল্লবীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও ভীষণ রকম জখম হয়। অবশেষে মা-বেটি সুস্থ হয় কিন্তু রাজশেখরকে বাঁচানো যায় নি। স্বামীর পেনশন আর ঘর ভাড়ায় টাকায় মা-বেটির সংসার চলে। 

              বিপ্রতীপের কবিতা আর গল্পের অসম্ভব ভক্ত। লাইন ধরে ধরে বলে দিতে পারে। নিজেও অল্পবিস্তর লেখালেখি করে। সেই সূত্রেই খোঁজ, যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব। ফেসবুক,  ম্যাসেঞ্জার আর হোয়াটস্অ্যাপে নীরব কথা আর অনুভূতির বিনিময়ে দ্রুত ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

             দু'জনেই কোলকাতার বাসিন্দা।  বিপ্রতীপ থাকে বেহালা আর কেতকী দমদমে। সম্পর্কের গভীরতা যত বাড়তে থাকে বিপ্রতীপ দেখা করার জন্য বারংবার অনুরোধ জানাতে থাকে। কিন্তু কেতকী প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। বলে," এভাবেই এগিয়ে চলুক আমাদের সম্পর্ক। দু'জনের জীবনেই চরম দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আজ আমরা পরস্পরকে মানসিক ভাবে পেয়েছি। সামনাসামনি দেখা আর আমার সান্নিধ্যের ছোঁয়া যদি তোমার অপছন্দ হয়, তখন ?  বাস্তবের জটিলতায় যদি আবার তোমাকে হারাই, সইতে পারবো না আমি।" 

           কিন্তু বিপ্রতীপ নাছোড়বান্দা। দেখা করার অভিলাষে মেয়ের দিব্বি দিয়ে বসে। দু'জনেকেই আসতে বলে। কেতকী কথা রাখে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মিলেনিয়াম পার্কে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্রতীপের সামনে দাঁড়ায়। চমকে ওঠে বিপ্রতীপ। কেতকীর ডান গাল জুড়ে বিচ্ছিরি পোড়া দাগ। চামড়া কুঁচকে আছে।
  
        --- "আমি তোমায় অনেকবার বলেছিলাম আমায় দেখতে চেয়ো না। অশরীরী সম্পর্ক থাক দুই হৃদয়ে।" 

        -- " দূর পাগলি! এই জন্যই তুমি এড়িয়ে যাচ্ছিলে? যে হৃদয় জয় করে, সে কি আটকে যাবে নশ্বর শরীরে! তোমাকে আর বেটিকে নিজের করে নিতে চাই।  তুমি রাজি তো ? "

অঞ্জন চক্রবর্তী

পিতৃদিবস
অঞ্জন চক্রবর্তী
============
      অতনু একটি মার্কেন্টাইল ফার্মের কর্ণধার, দম ফেলবার সময় নেই, আরও আরও ওপরে উঠতে হবে, সীমাহীন প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, নিজের কেরিয়ার ছাড়া কিছু বোঝে না l অতনুর বাবা তার সর্বস্ব নিয়োগ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন l ছেলে আজ এক ঈর্ষণীয় জায়গায় পৌঁছেছে l নিজের সংসার করেছে, যেখানে বাবা বেমানান হওয়াতে বাবাকে অতনু রেখে এসেছে দামি বৃদ্ধাশ্রমে l বাবা আপনমনে ভাবেন ফেলে আসা দিনের কথা l পিতৃদিবসের দিন সকালবেলায় অতনু হন্তদন্ত হয়ে হাজির বৃদ্ধাশ্রমে, বাবাকে বললো শিগগিরই গেঞ্জি ছেড়ে ভাল পাঞ্জাবী পর একটা, বৃদ্ধ উদ্বেলিত, ভাবেন হয়তো ছেলের মনের হয়েছে বদল, আবার তাঁর জায়গা হবে সংসারে l বৃদ্ধ পাঞ্জাবী পরে এসে দাঁড়ালেন,  ছেলে বলল এসে আমার পাশে দাঁড়াও ঠিক এইভাবে, বৃদ্ধ দাঁড়ালেন, ছেলে নিজেকে বাবার গলা জড়িয়ে ফটো তুললো, বললো
     বাবা, আমার সময় নেই আসি, মনে মনে বললো এই ফটোটা পোস্ট করবো ফেসবুকে
    আজ পিতৃদিবসের দিনে, কমেন্টে ভেসে যাবে, কেউ জানবেও না, অতনুর বাবা পরে আছে বৃদ্ধাশ্রমে l

সঞ্জীব রায়

পুত্ৰং দেহি 
ডঃ সঞ্জীব রায় 


    তড়িঘড়ি করে মধ্যমগ্রামে চারমাথা মোড়ের দোতলা বাড়িটা জলের দরে বেচে দিলেন সঞ্জয় সেনের ছেলে অনুব্রত। হাতে সময় নেই, দশ দিনের ছুটিতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা। কি দামে বিক্রি হলো সঞ্জয় বাবু সেটাও জানতে পারেননি। সঞ্জয় সেনের আপত্তি ছিল, কিন্তু গিন্নি শুনলে তো। নাতি হয়েছে, তাঁর ফুর্তি ধরে না যে। ছেলে পাসপোর্ট আগেই করে রেখেছিল। সঞ্জয়বাবু জানতেন যে আমেরিকার ভিসা করতে ন্যূনতম দুদিন সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু ছেলে বললো এখন সবই নাকি অনলাইনে হয়ে যায়। তালেবর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আর ইচ্ছা করেনি।

    বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে পাসপোর্ট পরীক্ষা হওয়ার সময় কেমন যেন সন্দেহ হল সঞ্জয়বাবুর। তিনি দেখলেন একপাশে গেটম্যানকে টেনে নিয়ে গিয়ে অনুব্রত তার হাতে একগাদা ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিল। বিমানবন্দরের ভেতরে গেলেন স্বামী-স্ত্রী। একটু উত্তেজনা হচ্ছে। দীর্ঘ বিমানযাত্রা বলে কথা। ঘন্টা কয়েক বাদে ছেলেই জানায় প্লেন লেট আছে। চিন্তার কিছু নেই। ও ভেতরে যাচ্ছে, কিছু কাগজপত্র দেখানো, সই-সাবুদ বাকি।

     মাঝরাত পার হয়ে প্রায় শেষ প্রহর। ঠান্ডা লাগছে। সোয়েটার চাদর গায়ে দিয়ে অভুক্ত রয়েছেন দুজনে। না পাচ্ছেন ছেলের দেখা, না পাচ্ছেন কোনো খবর। হাতে টাকা-পয়সা, পাসপোর্ট, টিকিট কিছুই নেই। এয়ারলাইন্সের এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে এলেন। সব শুনে তিনি তো তাজ্জব। বললেন রাত ১টা ২০ মিনিটে ওয়াশিংটন যাওয়ার প্লেন উড়ে গেছে এবং ছেলে তাতে বোর্ডিং করেছে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধ দম্পতির পাঁজর থেকে।

    তারপরের দীর্ঘ টানাপোড়েন ইতিহাস। বর্তমানে তাঁদের ঠিকানা ঠাকুরপুকুরের এক বৃদ্ধাশ্রম 'অমলকান্তি'। সেখানে একতলার এক স্যাঁতস্যাঁতে ১০/১০ ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন। বিনা পয়সায় আর কিই বা জুটবে? কোন অভিযোগ নেই। ঈশ্বর ধন্য, এটুকু দিয়েছেন।

   একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, সঞ্জয়বাবু পরে জানতে পেরেছিলেন বাড়িটা ৭৮ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।


শ্যামল মিশ্র

রোমন্থন
শ্যামল কুমার মিশ্র

    ঝুলবারান্দায় মুখোমুখি বসে শোভন আর রুমান্না। সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে। বাতাসে অল্প অল্প শীতের আমেজ। সামনের বাগানে শিউলিগুলো ঝরে পড়েছে। সবুজ ডালের আড়ালে কাজল পাখি গান গেয়ে চলেছে। সকালের এই সময়টা বড় ভালো লাগে শোভনের। রুমান্না এসে আলতো করে মাফলারটা জড়িয়ে দিয়ে শুরু করে ফেলে আসা জীবনের নানা কথা। 

   দেখতে দেখতে শোভন আর রুমান্নার দাম্পত্য জীবনের সিলভার জুবলি পেরিয়ে গেছে। রুমা বলে ওঠে---''জীবনটা বড় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল তাই না? মনে পড়ে এই সেদিন যেন আমরা ঘর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মধ্যমগ্রাম বারাসাত এমনকি কলকাতাতেও অনেকে ঘর দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে আমি 'রুমান্না খাতুন' তখনই দূরে সরে গেছে। তাদের 'গোপালে'র কথা মনে হয়েছে''। মৃদু হাসি খেলে যায় শোভনের মুখে। 'আসলে বড় অদ্ভুত এই দেশ।এদেশ বুদ্ধ, মুহাম্মদের দেশ। এদেশ শ্রীচৈতন্যের দেশ যার পরমভক্ত যবন হরিদাস। যিনি একজন মুসলমান। এঁরা তো সেই গোপালেরই ভক্ত। এটা খানিকটা সংস্কারের মতো মিশে রয়েছে। কার্যকারণ ব্যাখ্যা হয়তোএদের কাছেও নেই'।

   বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে রুমার।  আপনমনে সকালের খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে থমকে যায় রুমা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শোভনের। অতিমারিতে মৃত এক হিন্দু যুবককে পোড়াতে নিয়ে চলেছে চার মুসলমান যুবক। প্রতিবেশীরা কেউই আসেনি। রুমান্নার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

    শোভন বলে চলে---'বুঝলে জীবনের  সার সত্যটা কেউই বুঝলো না।  মানুষই সত্য। ধর্ম,জাত সবই মিথ্যা। এগুলো শুধু জীবনের এক একটা আভরণ। দর্পীর অহং। আভরণ খুললেই দেখবে জীবনের শাশ্বত সত্য রূপ'।

    রুমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের নানা ছবি। নতুন সংসারী দুই যুবক যুবতী ঘর খুঁজে ফেরে। জীবনতরী এগিয়ে চলে এমনি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অবশেষে ঘর মেলে।সংসারেরও শুরু হয়।...

   তারপর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পৌঁছে মনে হয় শোভনের জীবনের সবটাই অসুন্দর নয়। গোলাপের সৌন্দর্য নিতে গেলে কাঁটার আঁচড় ও যে খেতে হয়। ততক্ষণে রুমান্না গান ধরেছে--- 'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ'...। 
     গানটা কখন থেমে গেছে মুখোমুখি বসে দুই প্রৌঢ় দম্পতি। পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একমাত্র ছেলের নাম। ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় রুমান্না... 

(শব্দ সংখ্যা:৩১২)

সুতপা ব্যানার্জি

আসমান জমিন
সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)
     ছটু সিং এক সওদাগরী অফিসে দ্বারোয়ানের কাজ করে। বাবা-মা আর নিজের পরিবার নিয়ে একটা খুপরি ভাড়ার বাসায় থাকে। ভাড়াটা একটু কম হবে বলে সবচেয়ে ওপরে চারতলায় ওদের বাস। সিঁড়ি ভেঙেই যাতায়াত। সেদিন অফিস থেকে ফিরে শুনল-"মায়ের শরীরটা গরমে আজ ভীষণ খারাপ হয়েছে।গরমি জ্বর এসে গেছে"-কথা কটা বলে বউ সরলা রান্না ঘরে লেবু জল আনতে গেল। ছেলে বাবুল-"বাবা দুপুরে গরমে ঘরে টেকা যাচ্ছে না, আমরা বাসা বদল করতে পারি না?" ছটু-"এত কম ভাড়ায় কোথায় ঘর পাব বেটা, গরম কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।" ছোট মেয়ে শামলি বাবার হাত ধরে বায়না করে-"তাহলে বাবা আনো না একটা কুলার কিনে, দাদিও আরাম পাবে আর আমরাও একটু ঠান্ডা পাব।" সরলা স্বামীকে লেবু জল দিতে এসে মেয়ের আবদার শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে-" ভাত কী করে জুটবে জানা নেই আবার কুলারের হাওয়া খাচ্ছে, যা ভাগ,নিজের বই খুলে বস।" ছটু-"শামলি কথাটা খারাপ বলে নি, চার-পাঁচ হাজার টাকায় হয়েও যাবে, দেখি অফিসে সাহেবের থেকে লোন পেলে মাসে মাসে কাটিয়ে নেব।" বাবার কথায় বাবুল আর শামলি খুব খুশী হল।

    পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমে বড়বাবুর কাছে গেল-"রায় বাবু আমার চার-পাঁচহাজারটাকা লোন লাগবে,আপনি একটু সাহেবকে বলুন না।" বড়বাবু-"কেন? আমি বলব কেন? তুমি সাহেবকে নিজের কথা নিজে বল।" ছটু কাজটা জটিল হয়ে যাওয়ায় দোনামোনায় পড়ে গেল, তবে বাড়ির পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সাহস সঞ্চয় করে পায়ে পায়ে সাহেবের কেবিনের দরজায় দাঁড়াল। পর্দাটা কাঁপা হাতে সরিয়ে-"একবার ভেতরে আসব স‍্যার?" ফাইলের দিকে চোখ রেখেই অফিসের মালিক ঝুনঝুনওয়ালা-"কী বলবে, দের কিঁউ, জলদি বোলো।" ছটু-"আজ্ঞে স‍্যার বাড়ির প্রয়োজনে আমার পাঁচহাজার টাকা লাগবে। আপনি মাসে মাসে কেটে নেবেন।" ঝুনঝুনওয়ালা-"অফিসের এখন অবস্থা ভাল না, আভি নেহি।" ছটু কাচুমাচু হয়ে-"গরমে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, একটা কুলার কিনতাম স‍্যার।" ঝুনঝুনওয়ালা হাসিতে ফেটে পড়ে
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-" সবলোগ শুনো.. আমাদের ছটুর কুলার কেনার জন‍্য টাকা লাগবে...হা হা হা।" আরো কয়েকজন সেই বিদ্রুপের হাসিতে যোগ দিল। ছটুর চোখ ফেটে জল আসছিল। তা সামলে নিজের কাজের জায়গায় গিয়ে বসল। চাকরি বলে কথা, অপমান গায়ে মাখলে তো হবে না। যদিও মনটা খুব খারাপ হয়ে থাকল। পরদিন অফিস ফেরত পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। দেখল রাস্তার উল্টো দিকে একটা এসি মেসিন বিক্রির দোকানে অফিসের সাহেব দাঁড়িয়ে। ছোটা হাতি করে নতুন বাক্সে ওনার বাড়ির এসি চলল। সাহেব চলে যেতে ছটু দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-"যে এসিটা বিক্রী হল, ওটার দাম কত?" দোকানদার-"কেন আপনি কিনবেন,ষাট হাজার টাকা।" ছটুকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোকানদার বলতে থাকে-" ওনার অনেক বড় ব‍্যবসা। ওনার সব ঘরেই এসি আছে। সবই আমাদের দোকান থেকে কেনা। শুধু পোষা কুকুরের ঘরের এসিটা খারাপ হওয়ায় নতুন একটা কিনে নিয়ে গেলেন।" ছটু দোকান থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ডিউটির পর একটা শপিং মলে বা কোন পেট্রল পাম্পে কাজ করে হলেও নিজের পরিবারের কষ্ট দূর করবে, তার মায়ের কষ্ট দূর করবে। সাহেবের দাক্ষিণ‍্যে নয়, নিজের নগদ টাকায় এই গরমেই কুলার কিনবে।

Thursday, December 26, 2019

কঙ্কাল

কঙ্কাল




         আমার কথায় রামশরণ যেন বাস্তবে ফিরে আসে আবার । 

        --- তারপর আর কি মাষ্টারমশাই । বড়বাবুর চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার নিশ্চিন্ত জীবনেরও ইতি ঘটে গেল । আবার বেড়িয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের পথে । কিন্তু যে পাক থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম বড়বাবুর স্নেহের শাসনে সে পথে আর পা বাড়াইনি । কতদিন কত দোকানে কাজ করলাম --- চায়ের দোকানে , মুদির দোকানে , হোটেলে । কিন্তু এই কয় বছরে বড়বাবুর কাছে থেকে আমার রুচিরও পরিবর্তন ঘটে গেছে । ওদের গালাগালি , খিস্তি - খেউরগুলো আর ভালো লাগত না । বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম । একদিন এক বইয়ের দোকানে কাজ পেলাম । বেশ বড় দোকান । কত বই । সারাদিন বই পড়ার এমন সুযোগ পড়ার নেশাটাকে আরো বাড়িয়ে দিল । দোকানে বিক্রিও হত মন্দ না । মালিককাকার একটামাত্র মেয়ে ছিল । একদিন কাকা এসে বলল , ক'দিন দোকান বন্ধ থাকবে । তার মেয়ের বিয়ে । দোকানের বদলে এই কয়দিন তার বাড়িতে কাজ করতে হবে । গেলাম তার বাড়ি । লোকজন বলতে তেমন কেউ নেই । কাকা কাকীমা আর দিদি । ফলে দোকানবাজারের অনেক কাজই আমি পেলাম । করলাম আনন্দের সাথে ।কি বলব মাষ্টারমশাই এই প্রথম যেন কোনো পরিবারের অংশ বলে মনে হল নিজেকে । দিদি বিয়ে হয়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোর । আমি দোকান বাড়ি দুটোই সামলাতে থাকলাম । কাকীমাও আমাকে নিজের ছেলের মত ই ভালোবাসতেন । 

       কিন্তু এ সুখও সইল না । কাকীমার হঠাৎ খুব কঠিন রোগ ধরা পড়ল । এখানে চিকিৎসা হবে না । দিদি কাকা-কাকীমাকে নিয়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোর । দোকানটা হয়ে গেল বন্ধ । আমি আবার বেকার ।

       পুরানো কথায় ডুবে গেছে রামশরণ । একইসাথে সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যকে দেখা , অনুভব করা ঘটেছে তার জীবনে বারবার । জীবনের কত উত্থান-পতন যে মানুষকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় ।

        ---- তা তুমি এখানে এলে কি করে ? 

           ----- সে তো আরো বড় ইতিহাস মাষ্টারমশাই । কিছুদিন একাজ- ওকাজ কত কাজই না করলাম । কিন্তু কিছুতেই মন বসে না । একদিন ট্রেনে চেপে বসে রইলাম । হাতে টাকাপয়সা প্রায় নেই । জামাকাপড় অত্যন্ত মলিন । স্নান হয়নি কয়দিন । অবসন্ন শরীরে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙল ধাক্কায় । ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি সামনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে । আর কালো কোট পড়া একজন লোক সবার টিকিট চেক করছে । পেটে খাবার নেই তো টিকিট কাটব কি করে । আমার কাছে টিকিট চাইলে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । টিকিট না পেয়ে আমাকে পাগল ভেবে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দিল । শিয়ালদা থেকে কত দূরে আছি , কোথায় যাব কিছুই জানি না । প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম সারাদিন । খিদে তেষ্টার অনুভূতিও আর নেই । বিকেল হয় হয় । একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম । দুটো বিস্কুট আর চা খেলাম । তারপর ওয়েটিং রুমে গয়ে বসলাম । সারারাত সেখানেই পড়ে রইলাম । বড়বাবু আর কাকা-কাকীমার কথা খুব মনে পড়ছিল । দিদির ফোন নম্বর দিয়েছিল আমাকে । খুব ইচ্ছে করছিল ফোন করে ওদের খবর নিতে । কিন্তু পয়সা কোথায় ফোন করার । 

          ---- তারপর ? যতই শুনছি কঙ্কালের কথা শোনার আগ্রহ আরো বেড়ে যাচ্ছে ।

          ----- তারপর সকাল হল । একের পর এক ট্রেন যাচ্ছে আসছে । একসময় দেখলাম একদল স্কুলের ছেলে দলবেধে কলরব করতে করতে যাচ্ছে । কি ভেবে ওদের পিছু নিলাম । হাটতে হাটতে এই স্কুলটার সামনে এলাম । ওরা ভেতরে ঢুকে গেল । আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম । আর ওদের দেখতে লাগলাম ।

        জানেন মাষ্টারমশাই , আমি আগের জন্মে অনেক পাপ করলেও কিছু কিছু পুণ্য কাজও করেছিলাম । তাই একসময় নজরে পড়লাম ঐ দ্বিজেনমাষ্টারের । তিনি অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করে একসময় কাছে এগিয়ে এলেন । আমার নাম-ধাম-ঠিকানা সব জিজ্ঞাসা করলেন । এমন ভালো মনের মানুষদের কাছে মন আপনাআপনি আত্মসমর্পণ করে জানেন তো মাষ্টারমশাই । আমিও আমার জীবনের পিছনে ফেলে আসা  সব ঘটনা মাষ্টারমশাইকে বলে চললাম । মাষ্টারমশাই আমাকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে গেল । ঐ যে আমগাছের বেদিটা দেখছেন সেখানে আমাকে বসতে বলে ভেতরে গেল । তারপর কিছুক্ষণ পর হাসিমুখে এসে বলল যে আমার চাকরি হয়ে গেছে । আমি মাষ্টারমশাইয়ের পা ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম মাষ্টারমশাই । তিনি আমাকে তুলে নিয়ে ঐ ঘরটাতে থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন । তার উপর দিলেন মাইনে । আমিও প্রাণ দিয়ে স্কুলটাকে ভালোবেসে ফেললাম । সারাদিন ছোটোবড় কত ছেলেদের আনাগোনা  । ছোটাছুটি , চীৎকার , চেঁচামিচি । একসময় ওদের সাথে ভাব হয়ে গেল । ওরা কতরকম দুষ্টুমি করত । আমার হয়ত একটু ঘুমের ঢুল এসেছে । ওমনি পেছন দিয়ে এসে আমার টিকির সাথে দড়ি বেঁধে দিত । কখনো প্লাষ্টিকের সাপ সামনে ফেলে দিয়ে ' সাপ ' ' সাপ ' বলে ভয় দেখাতো । আমিও ওদের মজা দেবার জন্য ভয় পেয়ে লাফাতাম । কখনো আমার জুতো লুকিয়ে রাখত । তবে ওরা শুধু দুষ্টুমিই করত না ওদের জন্মদিনের কেক লজেন্সটাও আমার জন্য নিয়ে আসত । ওদের ভালোবাসায় আবার আমার জীবনটা ভরে উঠল । আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে লাগল ।ষাট পেরিয়ে পয়ষট্টি - সত্তর । আমি যেন এই স্কুলেই একটা অঙ্গ হয়ে উঠলাম । তারপর একদিন ওপরয়ালার ডাক এল । এই ঘরেই আমার জীবনের শেষ হল । আমার তো কেউ ছিল না । মাষ্টারমশাইরা আমাকে গোর দিল । 

          ---- আচ্ছা , তাহলে তুমি এখানে এলে কি করে । ---- শেষ কৌতুহলটা আর চাপতে পারলাম না ।

           ----- ওদের ভালোবাসা আমাকে ওখানে শান্তি দিল না মাষ্টারমশাই । আমি ইস্কুল আসার জন্য অস্থির হতে লাগলাম । একদিন সুযোগ এল ।

             ----- ইস্কুলের কয়েকজন মাষ্টারমশাই আমার গোরের পাশ দিয়ে কোনো অনুষ্ঠানবাড়ি থেকে সেদিন রাতে বাড়ি ফিরছিল । অনেক রাত । গোরে শুয়েও আমার তো সবসময় এই স্কুলের দিকেই মনটা পড়ে থাকত । তাই স্কুলের কোনো মাষ্টারমশাই বা ছাত্রদের কথা শুনলেই উৎগ্রীব হয়ে উঠতাম । সেদিনও মাষ্টারমশাইদের কথা শুনছিলাম । বিজ্ঞানের মাষ্টার অভীকবাবু হেডমাষ্টারমশাইকে বলছিল যদি স্কুলের জন্য একটা আসল কঙ্কাল পাওয়া যায় তবে খুব ভালো হয় । এমনি তাদের কথাবার্তা চলছিল । হঠাৎ মুখঢাকা দুজন অস্ত্রধারি লোক মাষ্টারমশাইদের সামনে এসে দাঁড়াল । যা আছে দিয়ে দিতে বলল । নয়ত প্রাণে মারবে বলে হুমকি দিতে লাগল । আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না । ছোকরাদুটোর কাছে গিয়ে নানারকম কায়দা করতে লাগলাম । ভয়ে সেদুজনের সেকি পড়িমড়ি দৌড় । হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনা । মাষ্টারমশাইদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদেরও একি অবস্থা । শুধু অভীকবাবু আর হেডমাষ্টারমশাই দাঁড়িয়ে আছে । আমি আস্তে আস্তে তাদের বললাম --- ভয় পাবেন না মাষ্টারমশাই । আমি রামশরণ । অভীকবাবু আমাকে অনেকদিন ধরে দেখেছে এই স্কুলে । তাই নির্ভয়ে হেসে বলল --- এখনো কিসের টানে রামশরণ । আমি বললাম ---- আজ্ঞে মাষ্টারমশাই । আমাকে স্কুলেই একটু জায়গা দিন । ছেলেদের কলকল না শুনে আমি থাকতে পারিনা । অভীকবাবু বলল ---- ঠিক আছে দেখছি তোমার জন্য কি করতে পারি । তার কিছুদিন পর মাষ্টারমশাইরা আমাকে ওখান থেকে তুলে পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন করে স্নান- টান করিয়ে এখানে রেখেছে । আমিও খুব খুশিতে আছি এখন ।

          নিজের অজান্তে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল আমার বুক চিরে । আমিও হারিয়ে যেতে থাকলাম অনেক অনেক দূরে যেখানে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছেলেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রামশরণকে । আর রামশরণ হাত - পা নেড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছে ।

####সমাপ্ত ####

Wednesday, December 25, 2019

কঙ্কাল

কঙ্কাল


--- তুমি কে ? -- আমি অষ্ফুটে জানতে চাইলাম ।

----  আপনি তো এই স্কুলে নতুন এসেছেন তাই আপনি আমাকে চেনেন না । আমার নাম রামশরণ । ছেলেরা ঐ নামেই আমাকে ডাকত । গেটে চৌকিদারির কাজ করতাম । ঐ যে এখন যেখানে মিড ডে মিলের ঘর হয়েছে সেখানে আগে ছিল আমার বাস । চব্বিশ বছর বয়সে একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিলাম ইস্কুলের সামনে । কোনো কাজ-কামের আশায় । তখনকার দ্বিজেনমাষ্টার দেবতা ছিলেন । গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাকে সব জিজ্ঞাসা করলেন । তারপর আমাকে একটা চাকরি দিলেন । থাকার জায়গাও দিলেন ইস্কুলের ভিতর । কাজের মধ্যে রাতদিন ইস্কুল পাহাড়া দেওয়া । সকালে ইস্কুল শুরু হওয়ার আগে দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খেয়ে নিতাম । আর সেই রাতে একবার ।

----- তোমার বাড়ি কোথায় ছিল রামশরণ । --- কৌতুহলে জানতে চাইলাম ।

-----  সে তো ছিল বিহারে । কত ছোটোবেলায় মা মারা যাবার পর বাপটা আমাকে নিয়ে গা-ঘর সব ছেড়ে চলে এল কলকাতায় । বাপ শিয়ালদায় কুলিগিরি করত । আমি প্ল্যাটফর্মের একটা কোনে বসে থাকতাম । ট্রেন আসা-যাওয়ার ফাঁকে বাপ আমার কাছে আসত আর দু-পাঁচটাকা করে দিয়ে যেত । আমি খাবার কিনে খেতাম । তারপর বাপটাও একদিন মরে গেল । না-খাওয়া পেটে অত ভারি ভারি মালপত্র টানতে পারছিল না আর । একদিন এক বাবুর মাল মাথায় নিয়ে যেতে গিয়ে প্ল্যাটফর্মেই পড়ে গেল । আর উঠল না । আমি এবার কি করব । অন্যান্যো কুলিকাকারা প্রথম প্রথম দু-তিনটাকা করে দিত । কিন্তু তাতে আমার পেট ভরত না । খিদের জ্বালায় চুরি করতে শুরু করলাম । এভাবে বেশ হাত পাকিয়েও ফেললাম । তখন একটু বড়ো হয়েছি । একদিন এক মহিলার সোনার চেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম । পুলিশ ধরে নিয়ে গেল ।খোঁজ করার মত আমার তো কেউ ছিলনা । তাই পনেরো দিন জেলেই রইলাম । নাবালক বলে তেমন কোনো সাজা হল না । কিন্তু জেলের যে বড়বাবু ছিল সে একদিন আমায় ডেকে আমার সব কথা শুনল । কি জানি হয়ত আমার ওপর তার মায়া হয়েছিল । একদিন আমায় ডেকে জিজ্ঞাসা করল -- তুই জেল থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবি । 

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । কি বলব । আমার তো কোনো ঘরবাড়ি বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন কোথাও কেউ নেই । আবার অনির্দেশের পথে আমাকে কামড়াকামড়ি করে বাঁচতে হবে । বুক ফেটে কান্না আসছিল তখন । কেবল বাপের কথা মনে হচ্ছিল । বড়বাবু আমার মাথায় হাত রেখে বলল --- আমার সাথে যাবি ? আমার ঘরবাড়ি দেখাশুনা করবি , বাগান দেখবি আর আমার ঘরে থাকবি । কি বলব সেদিন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । একমুঠো নিশ্চিন্তের ভাতের আশায় চোখদুটো চকচক করে উঠেছিল । 

রামশরণ তার পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়ে একটু থামল । আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম --- বড়বাবুর বাড়িতে তুমি গেলে ?

--- হ্যাঁ , আবার বলতে শুরু করল রামশরণ । ছাড়া পেয়ে সেইদিন আমি জেলের বাইরে বসেছিলাম । তারপর বড়বাবুর ডিউটি শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন । কি বলব মাষ্টারমশাই এমন ভালো মানুষ যে পৃথিবীতে আছে তা তার সঙ্গে না গেলে বুঝতেই পারতাম না । উনি আমার জন্য যা করেছেন তা অনেক বাবা তার ছেলের জন্যও করে না । নামেই তার বাড়ির কাজের লোক ছিলাম । সে আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিল , থাকার জায়গা দিল , দিনকয়েক পড়ে আমাকে ইস্কুলেও ভর্তি করে দিল । আমি খাইদাই পড়াশুনা করি আর বড়বাবুর বাগানে বাড়িতে যতটা সম্ভব কাজ করি । এভাবে মাধ্যমিকটা পাশ করেছিলাম । একদিন হল কি দিব্বি ভালো মানুষ খেয়েদেয়ে জেলে গেলেন । সন্ধ্যার সময় প্রচুর গাড়ির ভীড় সামনে । কি ব্যাপার বাবু তো জেলে গেছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি গেটের দিকে । একটা মড়াবাহী গাড়ি ঢুকল গেট দিয়ে । ছুটে গেলাম । আমার বড়বাবু শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে । একবারো তাকিয়ে দেখল না ।

কঙ্কাল বোধহয় নিজের কষ্টকে দমন করতে কিছুক্ষণ থামল । আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল । ভালো মানুষরা বোধহয় বেশিদিন আয়ুকাল নিয়ে পৃথিবীতে আসে না ।

---- তারপর কি হল রামশরণ ? --- রামশরণের জীবনকাহিনী আমাকে চুম্বকের মত টানতে লাগল আরো জানার জন্য ।


পরের পর্ব আগামীকাল ........... 

Tuesday, December 24, 2019

কঙ্কাল

কঙ্কাল


         ক্লাশ টুয়েলভের টেষ্ট পরীক্ষা শেষ । ফাইনালের জন্য ল্যাবটা পরিষ্কার করাচ্ছিলাম কয়েকটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে । এক্সটারনাল এগজামিনার আসবেন । একটু গোছগাছ না করলে কেমন দেখায় । 

               গোছানো শেষে একটু আগে ছেলেরা চলে গেছে । আমি তখনো চেয়ারে বসে ওদের প্রজেক্টের খাতাপত্রগুলো ঘাটাঘাটি করছিলাম । সাড়ে তিনটে বাজে । চারটে নাগাদ বেরোবার ইচ্ছে । একটি ছেলের খাতায় চোখটা আটকে গেছে । কভারটা তো সুন্দরই । খাতার ভিতরটাও এত সুন্দর পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন যে চোখ আপনা-আপনি পরপর পৃষ্ঠাগুলো পড়তে বাধ্য করছিল । এমন সময় কে যেন ডাকল ---- ' শুনছেন ' । আমি দরজার দিকে তাকালাম । কেউ নেই । হয়ত আমার মনের ভুল অথবা নীচে থেকে আওয়াজ আসছে ভেবে আবার খাতায় মনোনিবেশ করলাম ।

     দ্বিতীয় ডাকটা একটু পরে আরো স্পষ্ট করে উচ্চারিত হল ---- ' মাটারমশাই , শুনছেন । '

       এবারও আমি দরজা-জানালাসহ সমস্ত ঘরটাতে একবার চোখ ঘুড়িয়ে নিলাম । এই স্কুলে আমি জয়েন করেছি আট মাস হল । এর মধ্যে শুধু ক্লাশটুকু করা ছাড়া ল্যাবে খুব বেশি সময় কাটেনি আমার । উপরন্তু ল্যাবরেটরিটা তিনতলায় সারি সারি চারটে ঘরের একদম শেষ ঘরটায় । বাকি ঘরগুলোও বন্ধ । তাই এমন নির্জন পরিবেশে গাটা ছমছম করে উঠল । হঠাৎ চোখ পড়ল আলমারির ভেতরে রাখা কঙ্কালটার দিকে । 

   --- হ্যাঁ , হ্যাঁ , আমি বলছি । আলমারির পাল্লাটা একটু খুলুন না । '

          আলমারের পাল্লা খুলব কি মুহূর্তে আমার সারা শরীর কেমন অবশ মনে হল । হাত-পাগুলো এত ভারি যে আমার নড়বার ক্ষমতা নেই । মাথার মধ্যে কোনো বোধও কাজ করছে না । 

      --- ' আলমারির পাল্লাটা একটু খুলুন না । আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । খুব কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস করুন । '

         এই করুণ আর্তিতে আস্তে আস্তে সম্বিত ফেরে আমার । একুশ শতকে ভুত ! তাও আবার আমার ল্যাবে ! আমার বিজ্ঞানমনষ্ক মন জেগে উঠতে থাকে । কৌতুহল হয় । যা শুনছি সেটা কি ঠিক । চেয়ার ছেড়ে উঠে আলমারির চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম । আজকাল স্যার - ম্যাডামদের বিপাকে ফেলার জন্য ছেলেরা অনেক রকম দুষ্টুমি করে । আমাকে ভয় দেখাবার জন্য সেরকম কিছু করে রাখেনি তো । এখন তো সবার হাতেই এন্ড্রয়েড ফোন । ভালো করে ল্যাবের সর্বত্র খুঁজে দেখতে লাগলাম । না । সন্দেহ করার মতো কোনো বাক্স বা স্পীকার কোথাও নেই । বাইরে বেড়িয়ে কড়িডোরটা একবার দেখলাম । নীচের দিকে ঝুঁকে দেখলাম । সব ফাঁকা । এবার আস্তে আস্তে আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । কঙ্কালটাকে ভালো করে লক্ষ্য করছি । খুব বেশি পুরনো তো নয়ই , জিনিষটাও আসল বলেই মনে হচ্ছে । পর্যবেক্ষণ করছি , এমন সময় কঙ্কালের মুখটা যেন সত্যিই নড়ে উঠল । 

       --- মাষ্টারমশাই , পাল্লাটা একটু খুলবেন । 

      আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে আবার একই কথা বলল । আমি এবার আস্তে করে পাল্লার একটুখানি খুললাম ।

     --- ব্যাস , ব্যাস , ওতেই হবে মাষ্টারমশাই । অনেক ধন্যবাদ । ছেলেগুলো একেবারে আটকে দিয়ে গেছে ।

       আমার নির্বাক মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকে --- প্রায় ন'মাস ধরে আমি এখানে আছি । কি করব বলুন সারা জীবন যাদের মাঝে কাটিয়ে দিলাম মড়েও যে তাদের ছেড়ে থাকতে পারিনা । বাচ্চাদের কলরব না শুনতে পারলে আমার ভালো লাগে না মাষ্টারমশাই ।

       ---- তুমি কে ? --- আমি অষ্ফুটে জানতে চাইলাম । 


ক্রমশ : ......