-----------------------
মৌমিতা সরকার
-----------------------
-"তিনটে টাকা দিবি?"
ব্যান্ডেলের তিন নং প্ল্যাটফর্মে ডাউন ট্রেনের জন্য আনমনে অপেক্ষা করার সময় আচমকা সম্বিত ফিরল এই প্রশ্নে। পিছন ঘুরে দেখি একটা বুড়ি, শতচ্ছিন্ন, মলিন একটা শাড়ি পড়ে ডান হাত টা বাড়িয়ে বসে আছে। ওর দিকে তাকাতেই ফোকলা মাড়ি বার করে নিষ্পাপ একটা হাসি হেসে আবার বলল-
-"দিবি তিনটে টাকা?"
এই স্টেশনে পাগলীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হঠাৎ যদি কোনো পাগলীকে দু হাত বাড়িয়ে কোনো এক অসহায় নিত্যযাত্রীর পিছনে দৌড়তে দেখা যায় ( উদ্দেশ্য কখনও কখনও বলপূর্বক চুম্বনও হতে পারে) তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে যাই হোক, তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম গত তিন চারদিন স্কুলের half yearly পরীক্ষার খাতা দেখার চাপে লোকজনের সাথে কথা বলার তেমন সময় পাইনি। হলই বা একটা পাগলী, খানিকটা গল্প করা যাক।
-"দিবি না? একটা, দুটো, তিনটে টাকা?"
-" হ্যাঁ, দেবো তো। তা তুমি এইরকম ঝড়-জলের দিনে স্টেশনে বসে ভিক্ষা করছ কেন? ঘর বর নেই? না ছেলে বউ দেখে না?"
-" কি বললি? ঘর, বর, ছেলে!! হ্যা হ্যা হ্যা...সব ছিল, সব। কপাল বুঝলি?"
-" না বুঝলাম না। নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিয়েছে?"
-" তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই দেখ আকাশ টা দেখ। ওই আকশের ওপারে নাকি বলে ভগবান আছে। চোখে ছানি পড়েছে তো। আমি আর তাকে দেখতে পাই না। তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, বুঝলি? ওই শা' ভগবান আমায় ঘর বর ছেলে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর ওই তিনটে শব্দ, ওই তিনটে শব্দ তাড়িয়ে মারছে আমায়। যেদিকে যাই।"
বুঝলাম মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বেশ কিছুটা। ট্রেন আসতে তখনও খানিক দেরি। কিন্তু আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে।
-"আচ্ছা, তোমায় ওরা এমনি এমনি তাড়িয়ে দিলো? ভালোবসেনি কখনও? "
-" হ্যা হ্যা হ্যা.....খুব বেসেছে। ওইরকম ভালো আর কেউ বাসেনি বুঝলি? বর আমার খুব খেয়াল রাখত। সাত বাড়ি কাজ করে বাড়ি ফিরতাম যখন, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। সে মুখখারাপ করত খুব, কিন্তু রান্না করে দিত। আর রাতের বেলা আদর করত খুব। কিন্তু ওই যে ওলাউঠো ভগবান! সহ্য হল তার? হঠাৎ করে একদিন সে ঘুম থেকে আর উঠল না রে। সে কি ঘুম.... কি ঘুম। আমার কেন এমন ঘুম হয় না? গুনে গুনেও ঘুম হয় না।
এক..দুই...তিন
এক..দুই...তিন।"
-"আর তোমার ছেলে?"
-" আমার ছেলে....আমার ছেলে...."
-" হ্যাঁগো তুমি বললে না? ঘর...বর...ছেলে।"
-" সেদিন রাতে তাকে নিয়ে চলেই গেলো। ভোটের সময়। খুব অন্ধকার। সবে সবে ঘুমিয়েছে সে। দরজায় তিনটে টোকা। খুলতেই হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়ল একদল লোক। তারপর কি মার মারল রে আমার ওই বাচ্চা ছেলেটা কে। ওদের বুক কি পাথর দিয়ে গড়া? হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। হাতে ধরে, পায়ে পড়েও আটকাত পারলাম না। আমার দেবশিশু টা রে, আমার বাপ, আমার কোলজোড়ানো হাসি...
কালী পুজোর বলির সময় ছাগলটা যে শেষ ডাকটা ডাকে, আমি তখন ছেলের মুখে সেই ডাকটা শুনেছিলাম। তারপর...তারপর..."
-"তারপর?"
-"তারপর ওই তিনটে আওয়াজ। ফট, ফট, ফট। আমার ছেলের আওয়াজ তখন থেমে গেছে। আমি আর ভাবতে পারি না, আর..আর গুনতে পারি না। এক..দুই...তিন...তারপর তো সবকিছু হারিয়ে গেছে।
.........................
দিবি? আমায় তিনটে টাকা?"
ট্রেন টা আসতেই ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। পাগলীটার ঘোলাটে চোখে এক পৃথিবী কষ্ট। আমার কিছু বলার নেই। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যা ছিল সবটাই বার করলাম। শুনেছি নাকি, কাউকে দিতে গেলে হাতে যা ওঠে তাই দিতে হয়। হাতে উঠলো ওই তিনটে টাকাই। কপাল! ভেবেছিলাম কিছু বেশিই দেবো। টাকাগুলো দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়ল। মুখ বাড়িয়ে দেখি, সে আপন মনে গুনেই যাচ্ছে,
এক....দুই....তিন*********
No comments:
Post a Comment