নিভু দীপের ধোঁয়া
------------------------
গৌতম তরফদার
--------------------------
বিচ্ছেদের আজ সাত বছর পূর্ণ হলো। সকালেই গৌড় এক্সপ্রেসে মালদা টাউন স্টেশনে নেমে ই-রিক্সায় সোজা বাড়ি পঞ্চমীর সকালে ঋচীক দাসগুপ্ত। মা অধীর অপেক্ষায় ছিল। প্রায় সাত মাস পরে ছেলে বাড়ি এল। বাবা তিন বছর আগেই গত হয়েছেন। বাড়িতে এখন শুধুমাত্র মা আর কাজের মাসি মন্দা। সেও প্রায় ১০ বছর ধরে মায়ের সাথেই আছে এই পরিবারের একজন হয়ে।
ভালোবাসার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র তিন বছর পুবালি দে'র সাথে। তখন কলেজে পড়ে। দু'জনেই একই শহরে থাকার সুবাদে ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ কখনও রেস্টুরেন্টে, কখনও সিনেমাহলে নতুবা পার্কে। শেষ বছরে তৃতীয় জনের প্রবেশ। শৈবাল কাঞ্জিলাল। রীতিমত ধনী ঘরের দুলাল। ঠাটেবাঁটে, হাবভাবে, প্রাচুর্যের জোয়ারে পুবালি ভেসে গেল। ঋচীক-কে এড়িয়ে যাওয়া শুরু। কিন্তু ঋচীক পুবালির প্রেমে পাগল। অল্পদিনেই অবজ্ঞার চরমরূপ দেখতে পেল ঋচীক। ঠিক সাত বছর আগে এই পঞ্চমীর দিন রথবাড়ি মোড়ে সন্ধ্যায় ঋচীক একাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুর্গাপূজা প্যান্ডেলের লাইটিং দেখছিল। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল সামনে এসে দাঁড়াল। শৈবালের পেছনে পুবালি বসে। নেমে এসেই পুবালি কর্কশভাবে বলল," আজ আমাকে এতবার ফোন করে ডিস্টার্ব করেছ কেন? তোমার সাথে তো আমার কথা নেই। নিছক বন্ধুত্ব ছিল। তার বেশী কিছু নয়। এরপর আর কোনোদিন আমাকে ডিস্টার্ব করবে না বলে দিলাম।"
এরপর শৈবালও নেমে এল। সরাসরি বলল," মজা দেখাবো তোকে। প্রস্তুত থাকিস "। ওরা চলে যেতেই কয়েকটা ছেলে এল। কিছু বোঝার আগেই সজোরে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিল ঋচীকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেল। চারিদিকে শারদীয়া পূজার জ্বলতে থাকা হাজার দীপের আলো যেন নিভে গিয়ে দু'চোখ ধোঁয়াতে ভরে গেল।
সেই শেষ। ঋচীক মাস্টার্স করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। পড়া শেষ হতেই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বি গ্রেডে অফিসার পদে চাকরি। দীঘায় পোস্টিং। মালদা ছাড়লো চাকরি পেয়ে। কয়েকমাস বাদে বাদে বাড়ি আসে। মায়ের আবদার এড়িয়ে আজও বিয়েই করেনি। বিয়ে আর করবে না ভেবেই নিয়েছে।
সারা দুপুর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঠিক সন্ধ্যার মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি পূজার প্যান্ডেল গুলো দেখতে শুরু করল। দিশারী সংঘের পূজো প্যান্ডেলের কাছে যেতেই দেখে দর্শনার্থীর ভীষণ ভিড়। হঠাৎ দেখে প্যান্ডেল থেকে সামান্য দূরে একটা বছর তিনেকের ফুটফুটে মেয়ে অঝোরে কাঁদছে। কয়েকজন তাকে ঘিরে রয়েছে। কাছে গিয়ে জানল সে তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এত ভিড়ে হয়তো হারিয়ে ফেলছে। ঋচীক মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। "কেঁদো না সোনা মেয়ে। তোমার মাকে আমি এক্ষুনি খুঁজে দিচ্ছি।
-- কী নাম তোমার? তোমার মায়ের নাম কী?
-- আমি পুচকি। আমার মা পুবালি।
চমকে গেল ঋচীক। সেই নয় তো? আবার জিজ্ঞেস করল, " তোমার বাবার নাম কী? "
-- আমার বাবা শৈবাল। বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে।
ঋচীক দ্রুত ক'জনের সাথে ভিড় ঠেলে প্যান্ডেলে পৌঁছে মাইকে ঘোষণা করিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিন-চারজন মহিলা একসাথে এল। হ্যাঁ, তারমধ্যে পুবালি একজন। কিন্ত একী চেহারা হয়েছে পুবালির! রোগা, গাল বসা, চোখের কোণে কালির প্রলেপ। সিঁথিতে সিঁদুর নেই।
ঋচীক মেয়েকে পুবালির কোলে সঁপে দিল। পুবালির দু'চোখ জলে ভরে গেল। একদৃষ্টে ঋচীকের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।
ঋচীক আজ আবার হাজার দীপের আলো নিভে যেতে আর ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখল।
No comments:
Post a Comment