ফিরে পাওয়া
অর্পিতা মজুমদার
-----------
সোদপুর স্টেশন, বিকেল ৪:৩০টা- জনারণ্য! কোনরকমে ভিড় ঠেলে কল্যাণী সীমান্ত লোকালের মহিলা কামরায় উঠতে পারলো মেধা। হাতে দুটো ভারী ব্যাগ , কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। গন্তব্য ব্যারাকপুর। মাত্র দুটো স্টেশন ।তাই বেশি ভেতরে গিয়ে তো লাভ নেই। এ সময় ট্রেনে অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড়। কামরায় ঢোকার মুখেই কয়েকজন মহিলা এমন ভাবে দাঁড়িয়ে যে একটুও এগোবার উপায় নেই। একেই তো আজ গুমোট গরম তার ওপর কামরার ভেতরে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এক মধ্যবয়সী মহিলা বলেই ফেললেন" এসময় কেউ দুটো ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠার সাহস দেখায়? " আর একজন তৎক্ষণাৎ সায় দিলেন" নেমে যান! নেমে যান! " এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাই সমীচীন মনে করলো মেধা।
আজ তাড়াতাড়ি স্কুলে ছুটি হওয়ায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে, রেডিমেড সেন্টারে একটা অফার চলছিল, কেনাকাটা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।
পরের স্টেশনে একজন অল্পবয়সী সুদর্শন যুবককে ওই কামরার গেটে দেখা গেল। দেখামাত্রই হৈচৈ শুরু হল। " এই ছোকরা! জাননা এটা মহিলা কামরা? " কী স্পর্ধা দেখেছো, আজকালকার ছেলেদের! " ইত্যাদি, ইত্যাদি। কমবেশি সবাই ছেলেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেধা ভাবলো ভালোই হয়েছে, সবার নজর এখন ছেলেটির দিকেই।
ছেলেটিকে দেখল মেধা। মহিলা কামরায় ওঠা অন্যান্য ছেলেদের মতো তো লাগছে না! প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সুগঠিত মেদহীন শরীর, গায়ের রং বেশ পরিষ্কার, চোখে রোদ চশমা। সব রকম কটুক্তি উপেক্ষা করে, ছেলেটি হাওয়া খেতে খেতে চললো।
ব্যারাকপুরে ট্রেনটি প্লাটফর্ম বদল করায়, নামার সময় মেধা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হল, কিন্তু কেউ যেন অতি যত্নে ব্যাগ দুটো সামলে হাত ধরে মেধাকে নামতে সাহায্য করলো।
" আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাম? আমায় চিনতে পারেননি আপনি ? আমি তো সোদপুর স্টেশনেই আপনাকে দেখে চিনতে পেরেছি" । ছেলেটি সহাস্যে বললো। রোদ চশমাটা খুলে ফেলেছে ছেলেটি।
এবারে মনে পড়েছে। ছেলেটির নাম হারুন। ব্যারাকপুর গান্ধী ঘাটে বেলুন বিক্রি করে পড়াশোনা চালাতো। স্কুলে তো বটেই, মেধা নিজের বাড়িতেও দুবছর পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলো হারুনকে। তবে কিছু দামি বই আর ক্যালকুলেটর ফেরত দেয়নি বলে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিল মেধা।
" আমি এখন বায়ুসেনা অফিসার ম্যাম। আপনি সেই সময় আমার পাশে না থাকলে আজ হয়তো এ জায়গায় আমি পৌঁছাতে পারতাম না। আজই কলকাতায় এসেছি। আপনার দেওয়া বইগুলো এবং ক্যালকুলেটর কাল আমি স্কুলে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসব ।আমার কাছে ওগুলো যত্ন করে রাখা আছে"।
আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে মেধা বলার চেষ্টা করল" থাক না সেসব! "
" আমার মতন অনেকে আছে ম্যাম, তাদের ওগুলো প্রয়োজন হবে"। হারুন হাতজোড় করে বলল। মেধা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সব বিরক্তি এক নিমেষেই খুশিতে পরিণত হয়েছে তার।
কিছুই তো হারায় নি! কিছুই হারায় না। সব ফিরে আসে, সুদ সমেত!
No comments:
Post a Comment