Saturday, August 10, 2024

কেল্লাফতে ঠাকুর -- স্বপন কুমার দাস

কেল্লাফতে ঠাকুর
স্বপন কুমার দাস 
০৯/০৮/২০২৪
সামনের দিকে যত এগোচ্ছি তত কানে আসে তমসাছন্ন আঁধার দ্বীপের রোদন! ঘোর সন্ধে বেলা সকলের বাড়ির সামনে তুলসীমঞ্চে রাখা প্রদীপ গুলো দিপদিপ করে জ্বলছে, কেউ আবার দেখি পুরো নিভে বসে আছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি নভ মন্ডলের গ্রহ তারা নক্ষত্র সবার আঁধারে অবস্থান।প্রথমে ভাবলাম  আজ বুঝি অমাবস্যা। কিন্তু না,হঠাত মনে পড়ে গেল আজ তো উষা লগ্নে বেরোবার আগে পঞ্জিকা দর্শন করে বেরিয়েছি, তখন পঞ্জিকা পাঠে দেখলাম আজ  রাখী পূর্ণিমা।
সেই জন্যই তো কয়েক গাছা পৈতে আর রাখী নিয়ে বেরিয়েছি আমার দুরের কিছু জজমান বাড়ির উদ্দেশ্যে।কোনোরকম পৌঁছে গেলে, যে দশ বারোটি জজমান বাড়ি আছে তাতে ভালো রকম দাউ মারা যাবে।
তা আর হচ্ছে না বাদ সাজলো আবার রিমঝিম টিপটিপ ঝরঝর বর্ষণ।আঁধার পথ জোর কদমে বামুন চালে চলাও মুশকিল। যেতে যেতে আবার কিছুটা মেঠোপথ দুইধার ধানজমি জেগে। আদ্বিকালের ঠাকুদা আমলের পুরাতন ছাতা,ছাতার কাপড়ের মধ্যে যত্রতত্র ছোট্ট ছোট্ট ছিদ্র তার ভিতর দিয়ে পড়ছে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির জল আমার তেল চকচকে সুন্দর মাথার টাক টিকে ভিজাচ্ছে।
কনোমতে ঝিঁঝি পোকার ডাক ব্যঙের গ্যঙর গ্যঙর মকমক শব্দ সাপের ফোঁস ফাঁস আওয়াজ উপেক্ষা করে বুকে সাহস নিয়ে রাম নাম জপতে জপতে এগিয়ে চলেছি।
অবশেষে অনেক ধকল সয়ে গাঁয়ের প্রারম্ভে একটি ঝুপড়ি বাড়িটিতে উপস্থিত হলাম। ঐ বাড়িতে পৌঁছে দেখি বাড়িময় অন্ধকার, ঘরের ভিতর দিকে একটি লন্ঠন দিপদিপ করে জ্বলছে।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কোন মানুষের সাড়া নেই।তারপর ডাকতে ডাকতে বাড়ির বারান্দা পর্যন্ত এলাম, বলি কেউ আছেন?
দুই চারবার ডাকার পর একজন ঘরের ভিতর জ্বলতে থাকা শিশপড়া লন্ঠন হাতে কাশতে কাশতে বেরোলেন। আমার মুখের ওপর লন্ঠন টি ধরে জিজ্ঞেস করলেন কাকে চাই?
আমি বললাম রমেন বাবুর বাড়ি যাব উনার বাড়িটা ঠিক ঠাওর করতে পারছিনা ঘন অন্ধকারে গোটা গ্রাম ভরে আছে?উনার বাড়িটি কোন দিকে একটু পথটা দেখিয়ে দিন তো? আমার নাম ভজহরি ভট্টাচার্য আমি পৈতে ও রাখি নিয়ে এসেছি উনার বাড়িতে যাব।মুখের  কথা শেষ হতে নাহতেই উত্তর এলো!
রমেন বাবু বলে তো এখানে কেউ থাকেন না আমার নাম তো রফিক মিঁয়া।আমি এই বাড়িতে একাই থাকি আমার মরলে জল দেওয়ার মতো সাত পুরুষের কেউ নেই!সবাই ওলাওঠা রোগে একে একে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে আল্লাহর দরবারে, আমি পড়ে একা পুরো গ্রাম ফাঁকা। কোনোরকম পাশের গ্রাম থেকে চাল আলু চেয়ে ভাতে ভাত করে খেয়ে বেঁচে বর্ত্তে আছি বাবু!আল্লাহ আকবর আমার মতো পাপীপেট কে কেন যে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার উত্তর আমি পাইনা।
আপনি মনে হয় বাবু ভুলকরে অন্য গাঁয়ে ঢুকে পড়েছেন। 
এটা কোন গ্রাম বাবু?
এটা সিরাজগঞ্জ বস্তি, আগে এখানে অনেক লোকের বাসছিল এখন সব বাড়ি ভুতড়ে বাড়ি হয়ে গেছে।বললাম না ওলাওঠা রোগে পাঁচ ছয় মাস আগে সবাই আল্লাহর দরবারে শিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে..!!
আমি কেবল একা রাজরোগের সাথে বন্ধুত্ব করে বেঁচে আছি।খুঁক! খুঁক! খুঁক! আমার সাতকুলের কেউ নেই। 
আপনি কোন গ্রামের খোঁজে এখানে এসেছেন বাবু?লোক টি কাশতে কাশতে জিজ্ঞেস করল। 
সুন্দরপুর। 
এটা সুন্দরপুর গ্রাম তো?
না বাবু সুন্দরপুর এখান থেকে চারক্রোশ রাস্তা। আপনার গ্রাম কোথায় বাবু?খুঁক! খুঁক! খুঁক! 
আমার গ্রাম কল্পতরু গ্রাম। 
সেওতো চারক্রোশ ধারাধারি!প্রতিটি কথার ফাঁকে কাশির আওয়াজ খুঁক! খুঁক! খুঁক!
আচ্ছা এসেই যখন পড়েছেন, তাহলে রাতটুকু আমার এই গরীবের দুয়ারে কাটিয়ে আগামীকাল ভোরে আবার আপনার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন।খাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করতে পারবনা বাবু তবে, আমাকে একজন ঈদের সময় নতুন বিছানা বালিশ দান করে ছিল সেইটা আমি ব্যবহার করার সুযোগ পাইনি আপনি ঐটা পেতে ঘুমিয়ে পড়ুন। 
না ও সম্ভব না আমাকে আজই ফিরতে হবে আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী একা ও আবার আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে।না ফিরে ওর আবার চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরঞ্চ ভুল করে এসেই যখন পড়েছি তখন তোমার ডান হাতটি বাড়াও তো বাপু। 
এই বলে বামুন তার হাতে একটি রাখী বেঁধে দিল আর বললো তিনদিন তোমার হাতে এই রাখী বাঁধা থাকবে চতুর্থ দিন ভোরে কোন নদী বা খালের জলে একে ভাসিয়ে একটি মাত্র ডুব মারবে তারপর বাড়ি ফিরে তোমার নামাজ পড়বে।
এই বলে বামুন ফিরলো বাড়ি।
 তিনদিন পর বামুনের কথামতো সমস্ত কর্ম পালন করলো। 
সব নিয়ম করে সবকিছু করার পর হঠাৎই বুঝতে পারে তার শরীর সুস্থ সে আর খুক খুক কাশেও না।
তখন সে ভাবলো আল্লাহ আকবর মনে হয় কল্পতরু গ্রামের মহান সেই বামুন ঠাকুরকে আমার রাজরোগ ভালো করার জন্য উনাকে ভুলে পথে পরিচালিত করে আমার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। 
তৎক্ষণাত সে কল্পতরু গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।পৌঁছে  বামুন ঠাকুরের পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো ঠাকুর আমি আজ সুস্থ আল্লাহ আকবর আপনার দোয়া করুন। এইবলে বামুনের পাদুটি জড়িয়ে ধরে লুটোপুটি করতে লাগলো।
এদিকে বামুন ভাভছে...
আমি এতটাই টাকা রোজগারের ভাবনায় মশগুল ছিলাম পথ চিনতে ভুল করলাম...!!
নাকি! ঈশ্বর আমাকে এই রাজরোগ গ্রস্থ লোকটিকে সুস্থ করার জন্য, ঈশ্বরের কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে পরিচালনা করে সেই পথে নিয়ে গেলেন।
বামুন ঠাকুরের বাড়িতে উপস্থিত গ্রামবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে সেই দৃশ্য দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। 
সেই দিন থেকে গ্রামের সকল লোক ভজহরি ঠাকুর কে কেল্লাফতে ঠাকুর নামে ডাকতে লাগল এবং উচ্চস্বরে দুবাহু তুলে জয় কেল্লাফতে ঠাকুরের জয় বলে উন্মাদনায় নাচতে লাগল।।
                     

No comments: