তাতিনী
গৌ ত ম ত র ফ দা র
১০.০৭.২০২৪
দীর্ঘ চব্বিশ বছর পরে নিজের জন্মভূমি মালদা জেলার অজ পাড়াগাঁ কান্তিপুরে এসে পৌঁছাল ছেচল্লিশ বছরের বিপত্নীক হরিনীল বর্ধন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সারাদিনে একবার চলা রেলগাড়ির শেষ বগি থেকে কান্তিপুর স্টেশনে নামতেই যেন ঘন অন্ধকার তার দিকে ধেয়ে এল। সদ্য বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা যেন আঁধার রাতের নিমন্ত্রণ নিয়ে হাজির। রাস্তাঘাট আজও কোথাও এবড়োখেবড়ো, কোথাও বেশি বেশি গর্ত, বিদ্যুতের খুঁটি উপস্থিতির জানান দিলেও সারাদিনে বিদ্যুৎ দু'ঘন্টাও থাকে না। ছেড়ে যাওয়া গ্রামের আনাচেকানাচে কোথাও উন্নতিলাভের চিহ্ন নেই। গ্রামের বনেদি বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সাধাসিধে বিচিত্র বিশ্বাস ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে ছেলের ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়েছে। বৃষ্টির কারণে গাড়ি চারিদিক ঢাকা। গাড়ির চালক অল্পবয়সী বিচিত্র বিশ্বাসের ছেলে।
ছেলেটি পটাপট মালিকের দুইটা সুটকেস গাড়িতে তুলে নিতেই ঝমঝমিয়ে আবার বৃষ্টি শুরু হল।
হরিনীল তড়িঘড়ি ঘোড়ার গাড়িতে উঠতেই দেখতে পেল আগে থেকেই পুরোপুরি ঘোমটায় এক মহিলা ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে বসে আছে। হাতে একটা ছোটো বোচকা। ছেলেটি চলতে চলতে বলতে থাকলো.....
--- এই দিদিটাও নাকি আমাদের গ্রামেরই। অনেক বছর আগেই চলে গিয়েছিল। আজ আপনার সাথেই একই ট্রেন থেকে নেমেছে। গ্রামে যাওয়ার গাড়ি নেই, তাই তারে তুলে নিয়েছি।
--- ঠিকই করেছো
প্রত্যুত্তরে হরিনীল বললো।
চলতে চলতে হরিনীল মহিলার মুখটা দেখতে চাইলো... কথা বলতে চাইলো.... একই গ্রামের যখন কোনো পরিচিতাও হতে পারে। কিন্তু না, ঘোমটা বা মুখ কোনোটাই খুললো না।
গ্রামে ঢোকার মুখে বৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দিলেও মহিলাটি ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে নীরবে নেমে গেল। আশ্চর্য! এখানেই তো হরিনীলের স্মৃতিবিজড়িত প্রেমিকা তাতিনী তালুকদারের বাড়ি ছিল। ভালোবাসা... গোপন অভিসার... দুই পরিবারের তীব্র আপত্তি... চুপিসারে লুকিয়ে গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত কালীমন্দিরে গিয়ে মালাবদল...সিঁদুর দান করার পরই তাদের জীবনে সিঁদুরমেঘ দেখা দিয়েছিল।
গ্রাম্য সালিশিতে দু'জনকেই ব্যাপক মারধোর... সেই রাতেই আপন দাদার হাতে তাতিনীর নৃশংসভাবে খুন হওয়া....হরিনীলের কান্তিপুর গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া কোলকাতার মেসবাড়ি। সেখানেই পড়াশুনো শেষে সরকারি চাকরি পাওয়া... বাড়ি করা....তাতিনীকে ভুলতে না পারা.... পুনর্বার বিয়ে না করায় অনড় থেকেছে।
বাড়ি দেখভাল করা বিচিত্র বিশ্বাস, তার স্ত্রী ও তাদের ঘোড়া গাড়ি চালানো ছেলে খুব খাতির-যত্ন করে রাতের খাবার খাইয়ে আগে থেকেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হরিনীলের আপন ঘরেই বিছানা করে দিল রাতের জন্য।
গভীর রাত পর্যন্ত অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলো হরিনীল। এই ঘরেই তো চুপিচুপি তাতিনীকে প্রথমবার নিয়ে এসেছিল বিয়ে করার রাতে। অসমাপ্ত ফুলসজ্জার অতৃপ্ততা আজও কষ্ট দেয় হরিনীলকে।
বৃষ্টি মুখর গভীর রাতে দু'চোখ বন্ধ করে ঘুমে জড়িয়ে পড়তেই হঠাৎ অস্ফুট আওয়াজে মায়াবী নীলাভ আলো হাতে কে যেন হরিনীলের দিকে এগিয়ে এল। কাছে আসতেই অবাক! আরে! এ তো ঘোড়ার গাড়িতে বসা সেই নারীর মুর্তি! ঘোমটা সরতেই হরিনীল শিহরিত। একি! এ তো তার তাতিনী! আবছা আবছা হাসিমুখ। হরিনীলের বাস্তবজ্ঞান হারালো.... তাতিনীকে বারবার নাম ধরে ডাকলো.... ছুঁতে চাইলো...হাসি ও কান্নার শব্দ একসাথে এল... নীল আলোটাও নিভে গেল... হরিনীল জ্ঞান হারালো।
পরদিন সকালে হরিনীল দেরিতে দরজা খুলতেই দেখে বিচিত্র বিশ্বাস ও তার স্ত্রী উদ্বিগ্নচিত্তে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে পাড়ার আরও কয়েকজন মহিলাদের জটলা। রাত্রে হরিনীল বারবার তাতিনীর নাম ধরে ডাকছিল আর গোঙাচ্ছিল। আশেপাশের সবাই জানে অতৃপ্ত তাতিনীর আত্মা প্রতি রাত্রেই বর্ধনদের বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। আজ হরিনীলকে কাছে পেয়ে কাছে আসতে চাইছিল, নিজের করে পেতে চাইছিল। কপালজোরে বেঁচে গেছে হরিনীল।
হরিনীলের আপত্তি স্বত্বেও দুপুরে গ্রামের মাতব্বরদের আয়োজনে গ্রামের পশ্চিমে জাগ্রত কালীমন্দির সংলগ্ন ঘাটে সাধুসন্ন্যাসী ডেকে পুজো ও তাতিনীর পিন্ডিদানের ব্যবস্থা করা হয়।
লৌকিক বনাম অলৌকিকের বহুযুগের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের গোলমেলে আচার-আচরণে হরিনীলের দু'চোখ জলে ভরে এল প্রিয়তমা তাতিনীর জন্য। ঈশ্বরের কাছে ওর চিরশান্তি কামনা করলো।
No comments:
Post a Comment