শেষবেলার শাহজাহান
গৌতম তরফদার
০৫.০১.২০২৪
" পাঠশালার খোলামাঠে হেসেখেলে শৈশবসঙ্গী সেখ শাহজাহানের সাথে দিন কাটানো সমর্পণ বসুর ছোটোবেলা - বড়োবেলা একসূত্রে গাঁথা। দু'জনের আজীবন বন্ধুত্বের বন্ধন। পড়াশুনার কারণে একসময় দু'জনের শারীরিক ছাড়াছাড়ি হলেও দু'জন দু'জনের খোঁজখবর রাখে, খুঁটিনাটি জানে-বোঝে।
শাহজাহান জমিদারবাড়ির একমাত্র সন্তান। জমিদারতন্ত্র কবেই বিদায় নিয়েছে কিন্তু সেখ পরিবারের ঠাটবাট এখনও কিছুটা হলেও চলমান। শহর থেকে স্নাতক পাঠক্রম শেষ করেই গ্রামে ফিরে গেছে জমিজমা - চাষাবাদের বিপুল কর্মযজ্ঞে। শাহজাহানের অন্তর জুড়ে গ্রামেরই অতি সুন্দরী নিয়ালি খাতুনের বসবাস। তাদের দু'জনের মধ্যে পরিচয় - যোগাযোগ - ভালোবাসারর সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রধান কারিগর বন্ধু সমর্পণই। সম্পর্কের শুরুতেই ভালোবেসে শাহজাহান নিয়ালির নাম রেখেছে বনান্তিকা।
প্রথমার্ধে শাহজাহানের পরিবারের আপত্তি থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে ধুমধাম করে প্রায় জমিদারি মেজাজেই সাদি হয়ে যায় দু'জনের। সংসারজীবন শুরু.....গভীর মনোযোগে সংসারধর্ম পালন....পরপর তিন পুত্র সন্তানের জন্ম....তাদের বড়ো হয়ে ওঠা..... নিয়ালির ইচ্ছে ও অনুরোধে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে নিয়ালি ও শাহজাহানের নামে কেনা জায়গায় বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা.... শাহজাহানের ইচ্ছেতে বৃদ্ধাশ্রমের নাম রাখা 'বনান্তিকা' ..... প্রথম আবাসিকা নিয়ালির আম্মা নুরজাহান বেওয়া..... এগিয়ে যেতে থাকল শাহজাহান আর সমর্পণের বন্ধুত্বের বয়স। দুজনের চোখেই এখন বয়সী চশমা।
দুর্ভাগ্যক্রমে অল্পদিন আগে শাহজাহান তার প্রাণপ্রিয়া বনান্তিকাকে হারিয়েছে এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনায়। সেই থেকেই শাহজাহানের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য হারানোর প্রবনতা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ কাঁদে...হঠাৎ হাসে।
শাহজাহানের তিন ছেলে বড়ো তো হলো কিন্তু মানুষ হলো না। বাড়ি - জমি - জায়গা নিয়ে তিন ভাইয়ের চরম বিবাদ.... ছেলেদের অন্যায় দাবি, জোরজুলুম, অত্যাচার... মারধোর.... কিছুই বাদ গেল না শাহজাহানের উপর দিয়ে । বন্ধু সমর্পণের চেষ্টায় ছেলেদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওরই নিজহাতে গড়া বৃদ্ধাশ্রম, ' বনান্তিকা'য় শাহজাহানের ঠাঁই হলো........।"
আজ রবীন্দ্র ভবনের স্টেজে শ্রোতা-দর্শকে ঠাসা হলে নিজের সদ্য লেখা গল্প, "শেষবেলার শাহজাহান" বিখ্যাত কথাশিল্পী মহারণ্য বসু যার ছদ্মনাম সমর্পণ
স্ব-কন্ঠে গল্প পাঠ শেষ করতেই তুমুল করতালিমুখর হয়ে উঠল।
মহারণ্য বসু দৃপ্তকন্ঠে শেষে বলল," যার জীবনের গল্প আপনাদের পড়ে শোনালাম সে আর কেউ নয়, আমারই বাল্যবন্ধু শাহজাহান। ওই যে হুইল চেয়ারে বসে আছে। " বলেই স্টেজের পুর্ব কোণ দেখিয়ে দিল।
ভাগ্যক্রমে আজ রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী তার অফিসারদের নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে হাজির ছিলেন। তিনি সটান স্টেজে উঠে এলেন। শাহজাহানের হাত ধরে সহমর্মিতা প্রকাশ করে হঠাৎ এক প্রস্তাব দিলেন," আপনি অনুমতি দিলে ও রাজি থাকলে " বনান্তিকা "কে রাজ্যসরকার অধিগ্রহণ করবে। বৃদ্ধাশ্রমের নাম অবশ্যই অপরিবর্তিত থাকবে আর আপনি আমরণ সম্মানীয় আবাসিক হয়েই থাকবেন। "
আনন্দের অশ্রুজল শাহজাহানের দু'চোখ গড়িয়ে পড়ল। আশ্চর্যজনকভাবে ঠিক সেই মুহুর্তে শাহজাহানের তিন ছেলে যারা লুকিয়ে আব্বার নামের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল গুটিগুটি পায়ে স্টেজে উঠে এসে আব্বার পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইল।
No comments:
Post a Comment