পাহাড়ি সৌন্দর্যের টানে
বিজয়া মিশ্র
১৫.০৭.২০২৩
হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে ভোর চারটের আগেই ভাড়া গাড়িতে উঠে বসলাম সপরিবারে।গন্তব্য টাইগার হিল।গত দুদিন অনেক চেষ্টা করেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলেনি। রিসর্ট থেকে বেরোনোর আগেই গরম চা সার্ভ করেছে হোটেল।তাতে কী, মনে হচ্ছে সবসময় এক কাপ হলে ভালো হয়। গাড়ি সামান্য এগিয়েই দাঁড়াচ্ছে কেন জানতে চাইলে ড্রাইভার জানালো রাস্তা জ্যাম। আধঘন্টার রাস্তা প্রায় দেড়ঘন্টা লাগলো। অবশেষে গন্তব্যস্থলের কিছুটা আগেই নেমে হেঁটে যেতে বললেন ড্রাইভার।অগত্যা চড়াই পথে এগোতেই হল। গতরাতে একই হোটেলে কলকাতার অন্য একটি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।ওনারাও আজ একই পথের যাত্রী।বহুকষ্টে স্পটে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য।সূর্যোদয় কোথায়! দিগন্তরেখা মেঘে ঢাকা। দু একবার লালচে আভা দেখে সবাই উল্লসিত কেউ কেউ বলল "ওই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা।"ঘন মেঘের মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে একচিলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিচ্ছে সত্যিই।ক্রমশ বেলা বাড়তেই হতাশ দর্শকেরা পিছু হটলো।সূর্য চকচকে চোখে হাসছে,কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা লুকোচুরি খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়।আমরা ফেরার পথ ধরলাম পাহাড়ের আঁকা বাঁকা ঘিঞ্জি পথে।ফেরার পথে বিভিন্ন মনেষ্ট্রিতে কাটালাম কিছুটা সময়।অবশেষে বাতাসিয়া লুপ। এখান থেকে সুদূরের দৃশ্য দেখার জন্য দূরবীক্ষণের ব্যবস্থা প্রচুর। বাচ্চারা বেশ আনন্দ পেল।সেইসঙ্গে টয় ট্রেনের ধীরলয়ে চলা ভারি সুন্দর।
সারা সকাল খুব আনন্দে কাটিয়ে আমরা ছুটলাম ম্যালে।সহসা বৃষ্টি এলো। অনেক দূরের পাহাড়গুলোও লুকিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে। একটু মেঘ সরলেই পাহাড়ের সারিবদ্ধ আহ্বান ভারি মনোরম।পরেরদিনই ফেরার গাড়ী।রাতেই খবর পেলাম বৃষ্টিতে ধস নেমেছে পাহাড়ে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাদের গাড়ি আসবে রিসর্টের গেটে। সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে সাতপাঁচ না ভেবেই বেরোতে হল।যদি যাওয়া না যায় হোটেলেই ফিরবো আবার সেইমতো কথা হল। ঘুম স্টেশন পৌঁছেই চায়ের জন্য দাঁড়ালাম।আজ ঝকঝকে আকাশ । চায়ের অর্ডার দিয়েই আমরা হতবাক।এ কী দেখছি! কাঞ্চনজঙ্ঘা! অপরূপা সুন্দরী রূপোলী মুকুটে সুশোভিতা,হাসিতে মুক্তো ঝরিয়ে হাতছানি দিয়ে এভাবেই বুঝি পাগল করে অনাদি অনন্তকাল ধ'রে মুগ্ধ ,সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষকে। অনেক ভালোলাগা,অনেকটা তৃপ্তি সঙ্গে নিয়ে ফিরেছি আমরা। আনন্দের আবহে ভুলেই গিয়েছিলাম পাহাড়ের ধসের খবরটা। ফেরার পথের দুদিকে তখন সোনালী রোদে ঝিকমিক করা পাড়াড়ের সারি, পাহাড়ি ঝর্ণার নেমে আসার মধুর ধ্বণিতে আপ্লুত হয়ে দেখছিলাম সকলে। আমাদের ড্রাইভার কত নামও বলছিল । পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘন বনের ছায়ায় নাম না জানা পাখিরা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল।ওই সময়ের মধ্যেই সুরক্ষাবাহিনী অবশ্য গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা কিছুটা পরিস্কার করে দুশ্চিন্তা দূর ক'রে দিয়েছিল। নিরাপদে পৌঁছে আমাদের স্মৃতিরোমন্থনে আচমকা ধাক্কা। মিডিয়ার দৌলতে সমস্ত ভালোলাগার আবেশে নিমেষে হোঁচট খেল। আমাদের সঙ্গে যে পরিবারটির রিসর্টে আলাপ হয়েছিল ,যাঁরা টাইগার হিলে ওঠার দুরূহ কষ্টে বেশ কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গী ছিলেন তাঁরা আজ টয় ট্রেনে ভ্রমনকালে পরিবারের কর্তা শোভনবাবু টয়ট্রেনের গেটে হাত ছেড়ে দাঁড়িয়েছিলেন । বাতাসিয়া লুপে বাঁক নিচ্ছিল টয়ট্রেন।তখনই আচমকা পড়ে গিয়েছেন তিনি।মাথায় মারাত্মক চোট পেয়ে কোমায় চলে গেছেন। ওখানেই আপাতত চিকিৎসা চলছে প্লেনে কলকাতায় আনার চেষ্টা চলছে।অত্যাধিক রক্তক্ষরণের জন্য চিকিৎসকেরা কোন আশা দিতে পারছেন না। এমন অভাবনীয় একটা খবরে আমরা সকলেই অপ্রস্তুত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।চোখের সামনে আনন্দে ঝলমল করা বাতাসিয়া লুপের ছবি ভেসে উঠছে সঙ্গে বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা যন্ত্রনা...।
No comments:
Post a Comment