Tuesday, May 16, 2023

নারী হতে সাবধান -- মৃনাল কান্তি রায়


নারী হতে সাবধান
মৃণাল কান্তি রায় 
অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে ঘূর্ণি। পাড়াময় ঘুরে বেড়ালোই যার কাজ।এ গাছে সে গাছে চড়া আর ফলগাছের ফল পাড়া যার নিত্য দিনের কাজ। এ ছাড়াও বর্শী নিয়ে এ পুকুর ও দীঘি আর এ খাল সে খালে মাছ ধরা- যাও তার সখ তালিকায়। কখন যে সে তরুনী থেকে যুবতী হয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। মায়ের শত বকা- ঝকাকে উপেক্ষা করে সে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। এজন্য গ্রামের সবাই তাকে নাম দিয়েছে ঘূর্ণি। উঠতি বয়সি ছেলে ছোকরারা তার ঐশরিয়ার মত রূপ দেখে প্রেমে পাগলপারা হয়ে ভাব জমানোর জন্য কাছে ঘেঁষতে চায় কিন্তু ঘূর্ণি কাউকেই পাত্তা দেয় না একদম। কেবল সে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে স্বর্ণকে মন থেকে পছন্দ করে।পছন্দ করার কারণ হোলো স্বর্ণ দেখতে ঠিক সোনার রঙের গৌড় বর্ণীয়। পছন্দ করার অপর কারণ হোলো স্বর্ণের একটি মাত্র স্লোগান 'নারী হইতে সাবধান' নয়তো কেড়ে নেবে জান'। 
একদিন স্বর্ণ গ্রামের এক পুকুরে সাঁতার কাটছে। বেশি গরম পড়েছে ঠিক তাই। সেই পথ ধরে ধেই ধেই করে যাচ্ছিল ঘূর্ণি। সে দেখতে পেল পুকুরে সাঁতার কাটছে স্বর্ণ যাকে সে মন থেকে পছন্দ করে কিন্তু স্বর্ণ পাত্তা দেয়না তাকে। সে এও জানে নারী বিশেষ করে যুবতী নারী তার চোখের শুল।কারণ তার এই ধারণা যে সব স্লিম ছেলেরা কোন যুবতী নারীকে বিয়ে করে পরবর্তীতে তারাই স্লিমত্ব হারায়। আর সে কারণেই ঘূর্ণির বদ্ধমূল ধারণা স্বর্ণ ছাড়া সাত গ্রামে আর ভাল ছেলে নেই। তার মানে স্বর্ণ নিখাদ ছেলে এবং সে শুধু তার সাথেই ভাব করবে এবং জীবনসঙ্গী করে চিরকাল নিখাদ জনকে পাশে রাখবে। পুকুরে সে স্বর্ণকে একের পর এক আড়াল থেকে ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে-ই! স্বর্ণের চারপাশে বৃষ্টির মত ঢিল পড়ছে আর এতে করে স্বর্ণ প্রথমে ভাবছে বৃষ্টি হচ্ছে- যার জল পুকুর থেকে ছিটকে তার গায়ে পড়ছে। তার এ ভাবা যে ভুল তা সে নিমিষেই বুঝতে পারল।কারণ সে দেখতে পেয়েছে ঘূর্ণির ঢিল ছোঁড়ার দৃশ্য। এ জন্য সে পুকুর থেকেই বলে উঠল," নারী থেকে সাবধান। নারী জ্বালাময়ী ভীষণ যন্ত্রণা আর পীড়াদায়ক। ভাইসব কেউ কোন নারীর ধারে কাছেও ঘেঁষবেন না।ঘেষলেই স্লিমত্ব আর ধরে রাখতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি! " সে যতই এমন সব কথা বলছে আর যে জন্য বলছে ফল দাঁড়াচ্ছে ঠিক উল্টোটা। একক প্রেমের প্রেম নদী কানায় কানায় যেন পূর্ণ হচ্ছে।কারণ ভাল মেয়েরা কখনো তাদের মনের জনের বাইরে আর কাউকেই সহ্য করতে পারেনা। এদিক থেকে স্বর্ণই যে পারফেক্ট হবে এ ঘূর্ণি বুঝে নিয়েছে। তাই বলছে," সজনেটায় একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না! " গাছপালাকে উদ্দেশ্য করে বলছে," তোমরাই বল,আমি কি দেখতে কম সুন্দর নাকি। তোমরা যদি প্রকৃতি হও তবে আমিওতো প্রকৃতি,তাইনা? " গাছপালা যেন সায় দিয়ে বলে চলছে," ঘূর্ণি!  তুমি পিছু ছেড়োনা। একদিন না একদিন তুমি মনের মানুষকে পাশে পাবে।নিরাশ হয়োনা কেমন?" এরপর ঘূর্ণি বলছে," আমার নামও ঘূর্ণি!  ঘূর্ণির মত ঘুরাব যদ্দিন আমার কথায় সায় না পাব। দেখি কে তাতে বাগড়া দিতে আসে। তাকে ঠিকই আমি দেখে নেব। " এই শুনে স্বর্ণ বলছে," যা যা যেদিকে যাবি সেদিকে যা! আমার পিছু লাগা কেন হ্যা!" এবারে ঘূর্ণি বলছে," কেন যে ঘুরঘুর করছি তা বুঝতে হোলে আলাদা একটা মন থাকা চাই-যা তোর নেই! আর মেয়েদের কথা বলছিস? আরে আমি কি আর পাঁচটা মেয়ের মত এই ভাবিস।না রে না আমি তেমন মেয়ে নইরে!  আরে কার কাছে কি বলছি! তোরতো আবার স্লোগান নারী হইতে সাবধান! তা তুই নারীর মর্ম কি বুঝবি রে বুদ্দু!  একবার মেনেই নে দেখবি অনেক মজা অনেক আনন্দ!" এই শুনে স্বর্ণ বলছে," ওওও এই কথা!  আমার স্লিমত্ব নষ্ট হোক এই তুই চাস। আরে তুই কি করে বন্ধু হবি,তুইতো দেখছি পাক্কা শত্রু! " এবারে ঘূর্ণি তার ওড়নার একধার দুলিয়ে দুলিয়ে চলে যাচ্ছে আর বলছে," টাটকা আছিরে বুদ্দু! তুই ছাড়া এ মনে আর কারোর স্থান নাই! তোকে আমার চাই-ই চাই! আজ চলে যাচ্ছি তবে পিছু ছাড়ছি না। "ঘূর্ণি স্বর্ণের চোখের অদৃশ্য হোলে স্বর্ণ পুকুর থেকে উঠে তার বাড়ি চলে গেল। 
এর কিছুদিন পরে একটি মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে কোমড় দুলিয়ে দুলিয়ে ঘূর্ণি যাচ্ছে ওই দূরে পদ্ম পাতার দীঘিতে জল নিয়ে আসতে। সে ঘাট থেকে জল ভরে বাড়ির দিকে ফিরছিল।হঠাৎ সে দেখতে পেল বিপরীত দিক থেকে আসছে তার পছন্দের স্বর্ণ। এবারে সে ভান ধরল। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে আর কলসির জল মাটি ভিজিয়ে দিয়েছে। তার মাঝে বেহুশ অবস্থায় ঘূর্ণি!  এবারে প্রথমত অতস্তত করে বলছে," মানুষের উপকার করা মানুষের ধর্ম কিন্তু আমার স্লোগান নারী হইতে সাবধান তার কি হবে। এত করে ডাকছি,সারা দিচ্ছেনা। কেউ যদি দেখে ফেলে তখন কি হবে। পাছে যদি মরে গিয়ে থাকে তবে তো জ্যান্ত না মৃত ঘূর্ণি আমায় জেলের ভাত খাওয়াবে।আর জেলখানায় শুনেছি পঁচা আর বাশি খাবার খেতে হয়! বিবেক! আমি এখন কী করতে পারি?" বিবেক ধমকিয়ে উঠে বলল," তুই এখনো কোলে তুলে নিসনি! আরে তুই কী পুরুষ?  এত্তসব আজেবাজে চিন্তা করে চলেছিস। নে শিগ্গির কোলে তুলে নে! ঘূর্ণিকে ওর বাড়িতে সসম্মানে পৌঁছে দিয়ে আয়!" এবারে স্বর্ণ বলছে," আরে যাচ্ছি যাচ্ছি মারী হইতে সাবধান আর বিপদে পড়লে উপকারী হয়ে সমাধান!" এই বলে স্বর্ণ ঘূর্ণিকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে ঘূর্ণিদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ ঘূর্ণি একলাফে নিচে নেমে বলছে," কি! কিছু মজা পেলে? আমিতো বেশ পেলুম!" এবারে স্বর্ণ রাগে কটমট করে বলল," হতচ্ছাড়ি পাজি কোথা কার!  ফের তুই মরে গেলেও তোর কাছে ঘেষব না! আমার স্লিমত্ব নষ্ট করে দিতে চাস! তুই মানুষ না।আস্ত একটা জন্তু জানোয়ার! আমার এখন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আর উনি দাঁত বের করে হাহা হিহি করছে! " এবারে ঘূর্ণি নিজের দু'কান নিজেই মলে মলে বলছে," রাগ করিসনা।আর এমনটি কখখনো হবেনা রে! তুই মন খারাপ করিসনা!" এই বলে ঘূর্ণি তাদের বাড়িতে আর স্বর্ণ তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। 

এর কিছুদিন বাদে ঘূর্ণি আবার পদ্মপাতার দীঘিতে জল আনতে গেল। মায়ের বকুনি খেয়ে তার জল আনতে যাওয়া কিন্তু তার শরীরটা এদিন একদম ভালো যাচ্ছিল না। তাই জল নিয়ে ফেরার পথে কাঁখের কলসি কাঁখ থেকে রাস্তার মাঝে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল এবং কলসি ভাঙার ওপরে ঘূর্ণি ঘুল্লা খেয়ে পড়ে গেল।আর তাতে করে মাথাটা কিঞ্চিৎ কেটে গেল! রক্ত কপালে টিপের ন্যায় জমাট বেঁধে আছে। পুরোপুরি অচৈতন্য সে। এদিনও স্বর্ণ একই পথে আসছিল এবং ঘূর্ণিকে ওইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বলল," ফের ভেলকি! আবার লাল টিপ দিয়েছে কপালে! কি সখ রে বাপু! আজ কি আর ভুল করি! পড়ে থাক আজন্মকাল তাও আমি তোকে স্পর্শ করছি না। নারী হইতে সাবধান!" এই বলে স্বর্ণ হন হন করে সেখান থেকে চলে গেল।এবারে ওই পথেই এক বুড়ো ভদ্রলোক আর তার ছেলে- যে কিনা ঘূর্ণিকে পছন্দ করে কিন্তু ঘূর্ণি যাকে পাত্তা দেয় না তারা ঘূর্ণিকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে তড়িৎ তাকে তুলে নিয়ে নিকটস্থ একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেল। ক্লিনিক কর্মকর্তা ঘূর্ণির মাথায় ব্যাণ্ডেজ করে দিয়ে বললেন," চিন্তার কোন কারণ নেই।এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘূর্ণি ভালো হয়ে উঠবে।" ভদ্রলোক ঘূর্ণিকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন। 
এর ক'দিন পরে স্বর্ণি পাশের একটি টিস্টলে বসে দুধ ছাড়া রঙ চা পান করছিল।এমন সময় দোকানীর কাছে জানতে পেল ঘূর্ণির মাথা কেটে গেছে।কেউ একজন তাকে চিকিৎসা করিয়ে তার বাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।এই শুনে স্বর্ণের মনে ভাবনার উদ্রেক হোলো। সে ভাবলো মস্ত বড় অন্যায় সে করেছে।পীড়িতকে সেবাদান মানবধর্মে পড়ে- যা সে না করে পুরোপুরি পীড়িতকে ইগনোর করে গেছে- যাতে করে তার পাপ হয়েছে। তাই সে দ্রুত ঘূর্ণির বাড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে একসময় পৌঁছে গেল গন্তব্যে। গিয়ে দেখল চঞ্চলা ঘূর্ণি আনমনা হয়ে বসে আছে।এবারে স্বর্ণ ঘূর্ণির হাতদুটো আপন ক্রোড়ে নিয়ে বলল," ঘূর্ণি!  তুই আমাকে মাফ করে দে।আমি মস্ত একটা অপরাধ করেছি।ভেবেছিলাম তুইতো ভেলকি ধরিস আমাকে দেখলেই। তাই ভাবছিলাম তুই ভেলকি ধরেছিস। আমাকে মাফ করে দে। " এই শুনে ঘূর্ণি বলছে," তার আগে বল, হাত কি আমি তোর ধরেছি না তুও যেচে আমার হাত ধরেছিস। তোকে আমি মাফ করতে পারি যদি তুই আমার মন ধরতে পারিস নয়তো এ কসুরের কোন মাফ আমার অভিধানে জানা নাই।" এই শুনে স্বর্ণ বলছে," হাত যখন ধরতে পেরেছি তখন তোর মনও ঠিক ধরতে পারব। তবুও অর্জিত পাপ খণ্ডাতে চাই। " এই শুনে ঘূর্ণি বলল," তবেতো কথাই নাই তুই পাপ মুক্ত হলি। এবারে তোর স্লোগান পাল্টাবি এক পুরুষ এক নারী মিলেমিশে সংসার গড়ি!" এরুপর? ----------! থাকনা কিছুটা আকাঙ্ক্ষা। 

No comments: