Wednesday, October 6, 2021

মানস স্বামী--- দেবী চৌধুরী

মানস স্বামী
দেবী চৌধুরী
--------------------



মন মন্দিরে যতন করে রাখা তোমার ছবি,
তুমি আমার স্মরণ করা প্রথম প্রণাম রবি।
ঘুম ভেঙ্গে মোর হাসি ফুটে তোমায় মনে পড়ে,
এলোকেশে ছুটি বাগে তোমার নামটি ধরে ।

হৃদ মাঝারে দিবানিশি থাকো মনের সাজে,
ভালোবাসার আসন নিয়ে ভুলাও আপন কাজে।
নয়ন জলে করি পূজা প্রেমের আসন পেতে,
পুষ্প লয়ে অঞ্জলিতে থাকি সদাই মেতে।

মনে মনে ভালোবাসি মনের ক্রন্দন সুরে,
মনের ঘরে কাব্য পাতায় আছো মালার ডোরে।
হিয়ার মাঝে বাজাও বাঁশি প্রেম রাগিনী তানে,
ভেসে বেড়াই তোমার প্রেমে ভাসি প্রেমের বানে।

মনেপ্রাণে চেয়েছি গো তোমায় ভালোবেসে,
তোমার হাসির গানের লিপি প্রাণে বাঁধে শেষে ।
সারাদিবস মনের দ্বারে বেড়াও হেসে খেলে,
তোমার কথা ভেবে চলি আঁখি দুটি মেলে।

ফুল তুলিতে তোমায় ভাবি কাঁটাই ফুলের বাগে,
মনের স্বামীর ভালবাসা জাগে অসীম রাগে।
মনে পড়ে শাসন বারণ মধুর প্রীতির কথা,
মন মন্দিরে থাকবে সদা থাকো যথা তথা।

সঙ্গে গণেশ" (রম্যরচনা) -- অরবিন্দ সরকার



                  "সঙ্গে গণেশ"
                    (রম্যরচনা)
             অরবিন্দ সরকার
           -----------------------------





হ্যাঁরে গণেশ! তোকে নিয়ে এসে তো বিপদে পড়লাম। অতশত খাস না? ভূড়ি কমা। গোগ্রাসে গিলে চলেছিস্ সর্বত্র।
গণেশ-  মা তুমি বাংলা ব্যকরণ জান? গণ+ঈশ=গণেশ । তাহলে কি দাঁড়ালো, জনগণের ভগবান আমি। যতবার পূজা শুরু হয় শুধু সবকিছুই আমাকেই নিবেদন করছে,বলছে ঔম্ গণেশায় নমঃ। তাহলে আমি কি করতে পারি? না খেলে তো প্রসাদ হবে না।তাই খেয়েই যাচ্ছি যতক্ষণ না বমি হয়।বমন না হলে তো উপযুক্ত প্রসাদ তৈরি হবে না। উচ্ছিষ্ট খাবারের নামই তো প্রসাদ।দেখো না চাল ডাল কলা মূলা মিষ্টি বাতাসা সব উগড়িয়ে দিয়েছি।সব পেট থেকে মাখাজোখা অবস্থায় বের করেছি। আহারের সময় ব্যাঘাত করতে নেই জানো তো মা।

মা- তাই বলে সব খাবি।আদেখ্লার বেটা বলবে? সবাই বলবে বাপ কোনোদিন কিছুই খাওয়ায় নি আর বাপের জন্মে দেখেওনি! আমাদের দেবকূলের বদনাম হবে।আখ নারকেল এগুলোও সব খাচ্ছিস।

গণেশ- হাতির মুখ আমার ।তাও তো রয়ে সয়ে খাচ্ছি।হাতি গোটা নারকেল খেয়ে নেয়, আমি ছোবড়া ছাড়ানো ভেঙে ভেঙে খাচ্ছি।হাতি পশু আর আমি দেব।তফাৎ অনেকটাই, শুধুমাত্র মুণ্ডটা হাতির আর সব বাবার। বাবার ভূড়ি আছে আমারও আছে।বাবা সদাশিব, উনি সবসময় চুপচাপ থাকেন।আর তুমি? ধমক দিয়ে বকেই চলেছো আমাকে। 
কার্তিককে আর  তোমার  গুনধর মেয়ে দুটিকে সামলাও এবার?
মা-- ওরা আবার কি করেছে? শুধু শুধু ওদের বকতে যাব কেন!

গণেশ- তোমার চোখ নাই? তুমি আবার ত্রিনয়নী! কার্তিক যার তার বাড়িতে যাচ্ছে আর তাকে সবাই শালো কার্তিক বলছে , শুনতে পাও না? তোমার লক্ষ্মী সবার দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছে, হয়তো ঘরেই ঢুকে যাবে? ভাঁড়ে ভবানী,  তাও আবার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার গড়বে?  তোমার মুখে চুনকালি পরবে দেখো।
আর সরস্বতী পড়াশোনা ছেড়ে প্রেম করছে।বই খাতার সঙ্গে যোগাযোগ নাই।বলছে নাকি অনলাইনে ক্লাস। লাইন মেরে মেরে ঘরে ফেরে ! অনলাইনে পরীক্ষা শতকরা হিসাবে পাশফেল।ফেল কথাটি অভিধান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু পাশ। তোমার মেয়ের জানাশোনা যদি প্রেমিক থাকে তাহলে শতকরা ছাড়িয়ে একশত'র মধ্যে দেড়শত পেতেও পারে? একটু ওদের দিকে নজর দাও। আমার দিকে তাকিয়ো না মা! আমি যথেষ্ট ভদ্র সন্তান তোমার। ভালো না হলে সর্বপ্রথম আমাকে কেউ পূজা করে? দেখি এবার ইঁদুর গুলো মর্ত্যে ছেড়ে দিয়েই স্বর্গপুরের রাজধানীতে যাব!মর্ত্যকে সাফসূতরো করে দেবে আমার বাহিনী। কিছু মার খেয়ে মরবে , কিছু বিষ খেয়ে মরবে , তারপর সামনে বছর এসে যারা বেঁচে থাকবে তাদের নিয়ে যাব। স্বর্গের হাহাকার হতে দেওয়া যায় না।বুলাদি এখন স্বর্গে আছেন তাই রক্ষা!স্বর্গে আর দেবদেবীর সংখ্যা বাড়ছে না। জন্ম এবার নিয়ন্ত্রণে এসেছে ! আর মর্ত্যে মারামারি, ধ্বংস লীলা করেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েই পাচ্ছে। বোমা পিস্তল তারাও বেড়ে চলে যাচ্ছে ক্রমাগত সমানতালে। ওদের নিয়ন্ত্রণ কর তুমি মা! তোমার ত্রিশূল তৈরীর কারখানা কোথায়? সেখানে গিয়ে বল অস্ত্র তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্র পাচার - দুটোই বেআইনি।

মা - এবার তুই থাম্ ! আরতি হবে ও বলিদান হবে। লাইনে সব কেলে পাঁঠারা দাঁড়িয়ে আছে। আমার নামে বলি দিয়ে কি হচ্ছে দেখ্ চেয়ে।বলির মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে কুকুরের মতো।যে যেমনে পারবে ছাল ছাড়িয়ে নেবে! তুই এবার পাবি নাকি দেখ্ ? ফলমূল গণেশায় নমঃ  কিন্তু পাঁঠার মাংসে ধরায়ঃ মানবায় দানবায় নমঃ। ওদের বিচার কে করবে ! আমি না তুই?

প্রেতাত্মা লোকালয় — শ্রী বিষ্ণু দেব

প্রেতাত্মা লোকালয়
 শ্রী বিষ্ণু দেব
-------------------------



হৃদাকাশে অজানা ভূমিকম্পের অনুভূতি
নোনা শরীরে আহ্বান জানালো আলিঙ্গন,
ঝাঁপিয়ে পড়ছে অক্টোপাসের কল্পনা রূপ,
মূর্তিমান নিজ পরিমণ্ডলের বাহিরে ৷

চারদিকে উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলতার দ্বার,
মানুষ খুঁজে বেড়ায় সত্যিকার মানুষের সঙ্গ,
প্রেতাত্মারা লোকালয় প্রান্তরে দিব্যি ঠাঁই,
একাকীত্ব বোবাস্বরে স্থিরতায় করে আঘাত ৷

চলমান পৃথিবী অন্ধকার স্তম্ভিত ভয় বিষাদে,
একের পর এক সহস্র জন ভুল পথের পথিক,
অসুর পথে ক্রমে বিবেক বুদ্ধির বীভৎস রূপ,
বিবেকের অকাল ধরায় ধোঁয়াময় চারদিক ৷

চলমান মনুষ্যত্বের তপ্ত গগন ঘেষি হাহাকার,
জ্বালাতনে বিদীর্ণ মানবতার রূপ জৌলুস,
গুরুগম্ভীর আওয়াজ বজ্র বিদ্যুৎ শ্রীভূমি পতিত,
দ্বিমুখী স্বার্থান্বেষী পূর্ণ ধরা অসুর বাহক ৷

নারী শক্তিই দেবী শক্তি .......সুব্রত চক্রবর্ত্তী

নারী শক্তিই দেবী শক্তি 
সুব্রত চক্রবর্ত্তী
----------------------


আজ শরতের নীলাকাশে
সাদা মেঘের ভেলা,
মেঘের কোলে রোদের হাসি 
করছে শুধু খেলা।।

আগমনীর বার্তা আনে
পূবালী হিমেল বাতাস
শুভ্র কাশ ফুলের সাথে
শিউলি  ছড়ায় সুবাস।।

দেবী শক্তির আরাধনায়
মুখরিত এই ধরা,হবি
বাচ্চা বুড়ো নব আনন্দে
মত্ত পাগল হারা।

নারী শক্তিই দেবী শক্তি
দেবী দুর্গার প্রতীক,
নারীর মান দেয় না যারা
তাদের জানাই ধিক্ ।

নারী সম্মানেই দেবীর বোধন
তাহাই সঠিক পূজা,
নারী শক্তির অবমাননায়
দেবীই দেবেন সাজা।

সসাগরা বসুন্ধরা আজ
সুখ শান্তি মাগে ---
অসুর নিধন করতে তাই
নারী শক্তিই জাগে ।

এই ধরণীর সুন্দর যত
সুর লয় ছন্দ --
শয়তান আর পাপিষ্ঠরা
করতে চায় মন্দ।

দেবী শক্তির আগমনী
বোধনের এই প্রাক্কালে
নারী শক্তিরও বোধন হোক
জাগো নারী সক্কলে।।

বিনাশ হোক অসুর কূল
হবেই ওদের ক্ষয় ---
দেবী শক্তির আবাহনেই
নারী শক্তির জয়।।

            ********

স্বত্ব@সুঃচঃ

বাসনার পদাবলি ।। ------------------মোহাম্মদ ইলইয়াছ


বাসনার পদাবলি 
মোহাম্মদ ইলইয়াছ 
 --------------------------


তুমি আদুল গায়ের কোন রূপকুমারী নও,নও একালের ঐশ্বরিয়া
তুমি সাতসাগরের ওপার থেকে ভেসে আসা মর্মর ভেনাস 
তিনশ বছর আগে পাল খাটানো জাহাজে এসেছিলে কলকাতায় 
তখন ছিলে আড়ালে-আবড়ালে শ্বেতপাথরের ভাস্কর্য এক কন্যে।

তোমাকে গড়েনি মাইকেল এ্যাঞ্জেলা কিংবা আমাদের যোগেন-বিজন
খিদিরপুরের ডকে নেমে ভারতমাতার চরণ ছুঁইয়েছিলে ভেনাস
তারপর সরাসরি ঢুকে গেলে রাসমনির ঘরে, ঠাকুর পরিবারের অন্দরে
মল্লিক পরিবারের অন্তঃপুরে। নিন্দুকেরা বললো-শিল্পের নামে ভন্ডামি।

তুমি নও গোলাপ সুন্দরী-আমাদের গোয়ালন্দের আফ্রেদিতি
কিংবা রবীন্দ্রনাথের উর্বশী,হেমেনের-জলরঙের সিক্তবসনা
কালিঘাটের পটের বিবিরা তোমার সন্দর্শনে লুকিয়েছিলো একদা
তুমি আজো সাইপ্রাস ও গ্রিক নিদর্শনের পাশ্চাত্য কন্যে।

বত্তিচেল্লির বার্থ অব নেশান আর দ্যা ভিঞ্চির মোনালিশা
তোমার গল্প শুনে বন্দি ছিলো লজ্জায়-শরমে এবং হারার ভয়ে
তোমাকে নিয়ে লেখেনি কবিগুরু, নজরুল, জসীম, শা-রাহমান
আমি এক পান্থ কবি তোমার দেহে ছড়িয়ে দিলাম বাসনার পদাবলি। 
                             -

মন কলমে = অঞ্জন চক্রবর্তী

মন 
অঞ্জন চক্রবর্তী 
===========


মনের আমি না
আমার মন
ভেবে ভেবে
মরে সারাক্ষণ
কোথায় পাবে সে
তার আপনজন
নিজের মনের মতন l
সে তো লুকিয়ে বেড়ায়
কোথায় পালায়
যায় না তাকে ধরা
হন্যে হয়ে খুঁজি তারে
আমি ছন্নছাড়া
মন আমার পাখির মত
মেলে দিয়ে ডানা
উড়ে বেড়ায় ঘুরে বেড়ায়
নেই কোন সীমানা l
মন আমার ঘুরে বেড়ায়
খুঁজে বেড়ায়
একটা মনের আশায়
যার সাথে মনের
দুটো কথা বলা যায়
খুঁজে যদিও বা পাওয়া
গেল এক মনের ঠিকানা
সে তো আমার মনের
কথাই বোঝে না l
মন তাই বড় শ্রান্ত
বড় ক্লান্ত
হয়ে নিরুপায়
আপনমনে বসে
শুধু গুমরায় l

রূপার মা -- ধীরেন গোস্বামী

রূপার মা
ধীরেন গোস্বামী
--------------------------


রানুর মায়ের সাথে রূপার মায়ের খুব ভাব
রানু আর রূপা একই স্কুলে একই ক্লাসে দুজনে পড়ে
তাই স্কুলে যাতায়াত করে মায়েদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে
কিন্তু আজ কদিন হলো রূপার মা রূপাকে নিয়ে 
আর স্কুলে আসছে না দেখে
রানুর মা খুব চিন্তায় পড়ে যায়, 
তাই রবিবার দিন রানু কে সঙ্গে নিয়ে রানুর মা রূপাদের ঘরে খোঁজ খবর নিতে আসেন 
রূপার মা রানুর মাকে দেখে বললো আর বোলো না ভাই 
যা ঝড় গেলো, 
রানুর মা বললো কি রকম ?
রূপার মা বললো বসো বসো আগে চা করি
চা খেতে খেতে সব কথা হবে
রানুর হাতে একটা বাটিতে কতকটা চাঁছি দিয়ে বললো এটা তুই খা এটা ঘরের দুধের চাঁছিরে
খুব সুন্দর খেতে দারুণ স্বাদ,
রানুর মা বললো বা ঘরে গরুও আছে দেখছি 
রূপার মা বললো চা করে নিয়ে আসি
এসেই সব বলছি 
কিন্তু এই কথা ভাই আর পাঁচ কান
করা চলবে না
নইলে আমি সমস্যায় পড়ে যাব
বলেই চা বানাতে চলে গেল,
চা নিয়ে এসে বললো এই চা খাও
ঘরের খাঁটি দুধের চা
রানুর মা বললো এবার কথা টা কি বলুন শুনি,
রূপার মা বললো বলছি বলছি চা টা খাও
গল্প আরম্ভ করলো
আর বোলো না ভাই তোমাকে তো আগেই
বলে ছিলাম যে আমার স্বামী ছোট থেকেই 
স্টেশনের পাশে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে কাজ করে ডাক্তার বাবু খুব ভালো মনের মানুষ গো
আমার স্বামী কে খুউব ভালো বাসে
বলেই এক চুমুক চা খেলো
রানুর মা ও এক চুমুক চা খেয়ে বললো তার পর কাজ এখন করছে তো ?
রূপার মা বললো বলছি চায়ের কাপ টা শেষ করে পাশে নামিয়ে রেখে বললো জানো তো আমার স্বামীর মনটা খুব দয়ালু 
এই যে আমার ঘরে এতো দুধ হয় ও বলে সবাই কে খাওয়াও প্রতিদিন ডাক্তার বাবুর জন্য চেম্বারে যাওয়ার সময় এই দুধ দিয়ে কিছু না কিছু খাবার করে নিয়ে যাবেই ডাক্তার বাবুর জন্য
রানুর মা অধৈর্য হয়ে বললো এতো দিন স্কুল কামাই হলো রূপা স্কুলে যাচ্ছে না 
এর সঙ্গে তো স্কুল কামাই এর কোন যোগ নেই
রূপার মা বললো, আছে গো আছে বিরাট এক্সিটেণ্ড ওই উপর ওয়ালা মানে ভগবানের করুনা
আর ডাক্তার বাবুর পাকা হাত যশ
আমার স্বামী ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যাওয়ার সময় দেখতে পায় লাইন উপরে একটা বড়ো দুধেল গাই চরে বেড়াচ্ছে, এদিকে রেড সিগন্যাল হয়ে আছে
ওর তো দয়ার শরীর আর কি বলবো ভাই যেই গাই টার লেঁজ টা ধরে তাড়াতে গেল ওমনি আনাড়ি লোক দেখে গাই টা জোরে মারল
এক চাঁটি ব্যস্, 
রানুর মা বললো তারপর ?
রূপার মা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো তারপর, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যেই করেন,
রানুর মা বললো, দিয়ে কি হলো, 
আর কি বলবো ভাই লাইনের উপরেই দড়াম করে পড়ে গেল
রানুর মা বললো যাক কোনো বিপদ হয় নাই তো ?
রূপার মা বললো, বিপদ বলে বিপদ এক্সপ্রেস ট্রেন ঝাঁ করে পার হয়ে চলে গেলো
রানুর মা বললো, ও মাগো দাদার কিছু হয় নাই তো 
রূপার মা বললো হয়ে ছিলো ট্রেন টা চলে যেতেই প্রচুর ভিড় হয়ে ছিলো
রানুর মা বললো ভিড় হোক
দাদার কিছু হয় নাই তো, 
রূপার মা বললো না তেমন কিছু হয় নাই
শুধু গাই টার সামনের দিক টা
আর আমার স্বামীর কোমর পর্যন্ত গুড়ো করে
দিয়ে চলে গেলো-
-ডাক্তার বাবু ভাগ্যিস ওই সময় ওই খানে পৌছে যায় আমার স্বামীকে চিনতে পেরে স্বামী কে আর ওই গাভী টিকে তুলে নিয়ে গিয়ে অপারেশন টেবিলে রেখে গাভীর পিছনটা আর আমার স্বামীর সামনেটা জুড়ে দেন ডাক্তার বাবু 
রানুর মা বললো তারপর
রূপার মা বললো 
কি সুন্দর সেলাই করেছে গো
কিচ্ছু বোঝার উপায় নাই 
এখন সম্পূর্ণ সুস্থ প্রতিদিন কাজে ও যায়
সকালে বিকেলে মিলে পাঁচ ছয় সের দুধ ও দেয় 
রানুর মা বললো বাবাঃ তোমার কি ভাগ্য গো দিদি 
আমার স্বামীটা তো কুড়ের বাদশা,
রূপার মা বললো চাইলে তুমি প্রতিদিন দুধ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারো
এমন সময় রূপা ও রূপার বাবা বাজার করে বাড়ি ডুকতেই
রানু র মা বললো, কি দাদা কেমন আছেন আপনি 
এখন আর পায়ের কোন অসুবিধা নেই তো
পায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো আপনার ধুতিটা একটু উপর দিকে তুলুন তো দাদা 
আমি আপনার পা দুটো একবার দেখবো,
রূপার বাবা অবাক হয়ে বললো তার মানে,
রূপার মা হো হো করে হেসে উঠলো, বললো তুমি ভাই স্কুলে অনেক হাসি মজার গল্প শোনাও
তাই আজ তোমাকে ঘরে একা পেয়ে
ফাঁকা সময়ে 
একটা ছোট্ট নমুনা দিলাম মাত্র দেখলে তো
বানিয়ে গল্প বলতে আমি ও জানি।

মেলেনি -- মৃত্যুঞ্জয় সরকার

 মেলেনি
-------------
 মৃত্যুঞ্জয় সরকার 
-------------------------


 সাদা ধবধবে কুকুর ছানা মেজকর্তা শখ করে নাম রেখেছে কাব্বু। কি রুগ্ন ছিল যখন প্রথম এ বাড়িতে আসে। আদর যত্নে কে বলবেএখন  সেই কাব্বু। নাদুস নুদুস বেশ বড়ও  হয়েছে। কাব্বুর  মনে খুব কষ্ট। চেনটা সবসময় গলায় বাঁধা। ভালো লাগেনা ওর কিছু আজকাল।  
কেমন যেন দাসত্বের শৃঙ্খল। বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়া। ঠাঁই সদর দরজায় বসে  পাহারা দেওয়া। ঝিমুনি আসলেও উপায় নেই,মাঝেমাঝেই ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে হবে। এদিকে আজ আজ কাল চোরের উপদ্রব। এছাড়াও লোকজন ঘরে এলে প্রথমেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে পরিচিত হলে অত ঝুক্কি নেই, অন্যথায় বেগড়বাই হলেই লাঠির বাড়ি। 

 কি যন্ত্রনা কিঁউ কিঁউ করে কেঁদে উঠে কাব্বু, মায়ের করুণ মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের উপর। বুকের ভেতরটা ছটফট করে কেঁপে ওঠে স্পষ্ট দেখতে পাই মায়ের চোখ  ঠিকড়ে বেড়িয়ে আসা বিকৃতমুখ,বোনের থ্যাতলানো দেহ। সময় দুর্গাপুজো।  দশমী।  ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হইহই করে খেলছে। কেউ আতশবাজি ফোটাচ্ছে, ঢাকের তালে তালে নাচানাচি করছে।

রাস্তার ধারে বটগাছের তলায় কাব্বু  বসে আছে। মা বোনকে নিয়ে খাবারের খোঁজে বেড়িয়েছে।  পাশেই বিশু ময়রার খাবারের দোকান। যা বদরাগী মানুষ একটু এদিক-ওদিক হলেই গরম খুন্তির ছ্যাকা। এখনো তার পিঠে  সেই ঝলসানো দাগ লেগে আছে। বাপরে বাপ সে কি ভয়ংকর যন্ত্রণা।  কাব্বু মাকে দেখতে পাচ্ছে,এক  টুকরো পাউরুটি মুখে নিয়ে দোকান থেকে মা পালাচ্ছে। মনের মধ্যে কি আনন্দ অনেকদিন পর পাউরুটি খাবে ভাবাই যায় না! মনের ভিতর কি আনন্দ  মা বোনকে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।  দোকানির  চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে আঁচে বসানো কড়াই এর  গরম জল মগে করে নিয়ে বোনের দিকে ছুঁড়ে মারে। বোন কুঁই কুঁই করে কেঁদে ওঠে। একদিকে মুখে খাবার অন্যদিকে রুগ্ন বোনের  যন্ত্রণার ছটফটানি,মা কোনরকমে বোনকে নিয়ে ছুটে রোড পার হতে যায়, ছুটে আসা লড়ির  ধাক্কায় সব শেষ। ছিটকে ছিটিয়ে পড়ে মা বোনের দেহ । সারা রাস্তায় চাপচাপ রক্তের দাগ। গাড়ি ছুটে চলে, কারোর ভ্রক্ষেপ নেই।পাষাণ হয়ে যায় কাব্বুর মন। মেজকর্তার ডাকে সম্বিত ফেরে। মেজো কত্তা বলে, -ভোলার সাথে পার্কে যা, নজর রাখবি, বেগড় বাই হলে তুই তো জানিস.... 
-মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় কাব্বু। 

-----------------------
পার্কে বসে আছে কাব্বু। ভোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলছে। এই একমাত্র ছেলে যাকে কাব্বু  ভরসা করে, বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওর জন্যই এই খোলা বাতাসে বুক ভরে সে শ্বাস নিতে পারে।কিছুক্ষণের জন্য বন্দী দশা থেকে মুক্ত বাঁচার আনন্দে মন নেচে ওঠে।  এই পার্কেই,  ডাব্বুর সাথে তার প্রথম পরিচয়। তারপর গভীর বন্ধুত্ব। 

 ডাব্বুর  কাছে কাব্বু জানতে পারে  জীবনের অন্য ধারাপাত স্বপ্নময় আবেগ বাঁচার লড়াই -এর বীজ মন্ত্র।  চোখে জল এসেছিলো বারবার ডাব্বুর জীবন কথা শুনে । সেও তো ভুক্তভোগী।  কাব্বু  জেনেছে ডাব্বুর  বাবা খুব বদরাগী, নেশাখোর, গাঁয়ের ভাটিখানায় আশেপাশেই  লুচ্চার মত ঘুরঘুর করতো ওর বাবা। মাতাল  লোকদের  ফেলে দেওয়া চাট, মদের শেষ বিন্দু  চেটেপুটে স্বাদ নিতো। 
ঘরে যে  ছেলে বউ আছে ওদিকে কোন নজর ছিল না। আবার ঘরে ফিরে সেকি হম্বিতম্বি, বকাঝকা,  চিৎকার-চেঁচামেচি। মাঝে মাঝে ডাব্বুর মাকে মারধর। মনটা বিষিয়ে যেত ডাব্বুর।  মায়ের করুণ মুখটা দেখলেই কান্না পেত।  ঠিক করে নিয়েছিল এর একটা বিহিত করবে কিন্তু করতে পারিনি। হঠাৎ করেই একদিন বাবা উধাও হয়ে যায়।  তন্ন তন্ন করে এ গাঁ  থেকে ওগাঁ   খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু বাবা মেলেনি। এই বোধ হয় একজন সাদ্ধী নারীর  মনের ব্যাকুলতা হাজার অন্যায় সহ্য করেও একমুঠো বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে থাকা। 

 প্রতি সপ্তাহের রবিবার দুই বন্ধুর  দেখা হয়।  কত নতুন নতুন কথা ডাব্বুর  কাছ থেকে কাব্বু জানতে পেড়েছে।  ডাব্বুর প্রতি গভীর আস্থা ধীরে ধীরে জমে ওঠে সেও ডাব্বু হতে চায়। 

 ডাব্বুর কাছে জানতে পারে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সে একটা দল তৈরি করেছে।  সাম্যবাদী কুকুরের দল।  সমাজের বঞ্চনা,  অবহেলার প্রতিবাদে,  এক মঞ্চ তৈরি করেছে। ওদের জীবন নিয়ে কেউ ভাবে না শুধু প্রয়োজন মেটায়।  কিছু কিছু জাত ভাইদের  রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে ট্রেনিং দিয়ে  পুলিশ বিভাগে  কাজে লাগায়। তাও বিনা পরিশ্রমে। 
 কাজ ওদের,নাম বিভাগের। কাজ ওদের রোজগার মালিকের।  কেউ কেউ আবার ঘর, রেস্তোরাঁয়, হোটেলে পাহাড়াদার, কিছু পশুপ্রেমী আছে তাদেরও সংখ্যা কম।  এইতো কদিন আগে হাসপাতাল চত্বরে দুটো নার্স লাঠি মেরে মেরে শেষ করে দেয় ওদের এক জাতভাইকে। 
 বিতর্কের  ঝড় উঠে,  শুনেছে মামলাও শুরু হয়েছে নাকি। 

------------------------------
 বেশ কিছুদিন যাবত ডাব্বুর দেখা নেই। কাব্বুর মন আর আগের মতো ভালো নেই।  উদাস হয়ে  ওঠে।  মন স্বাধীনতাখুঁজে।ওই নিল নিল চোখ দুটোকাকে খুঁজে?  কাব্বু বসে আসে বেঞ্চে,ভোলা খেলছে। পাশের ঝোপ হঠাৎ,  নড়ে উঠলো। বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে কাব্বু দেখে শুকনো মুখ ছল ছল চোখ,  ল্যাংচাতে  ল্যাংচাতে ডাব্বু এগিয়ে আসছে তার দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলে,  একটু খাবার, একটু জল দিবি.... 
- কি হয়েছে তোমার
- আগে একটু দেনা কিছু খেতে, কোনরকমে জেলখানা  থেকে পালিয়ে এসেছি, তারপর তোকে বলছি সব একটু জিড়িয়ে নি।  
- কি হয়েছে বলো? 
 ডুকরে কেঁদে উঠে ডাব্বু 
 এই প্রথম কাব্বু ডাব্বুর চোখে  জল দেখতে পেল। প্রতিবাদী বিশ্বাসী মনে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পেল।  এক ছুটে কাব্বু মালিকের ছেলের ব্যাগ থেকে  খাবার, জলের বোতল,  নিয়ে দৌড়ে আসে ডাব্বুকে কে দেয়।  ডাব্বু গোগ্রাসে খাচ্ছে, কতদিন যেন খেতে পাইনি।  খুব মায়া হচ্ছে কাব্বুর। শুধু চেয়ে আছে বন্ধুর দিকে,  মনে ভাবছে খাবার চুরি করে আনা কোনো পাপ না।কোন ঘৃণা নেই, কোন চৌর্যবৃত্তি নেই, বাধ্যকতা নেই,একটু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মাত্র, এক নতুন বিপ্লব। 
কিছুক্ষণ পর ঢেকুর তুলে ডাব্বু বলে প্রাণ বাঁচালি তুই আজ আমার। এ কথা কোনদিন ভুলবো না আমি। ভেবেছিলাম আর হয়তো তোর সাথে দেখা হবে না আমার। 
- ও কথা বলে না বলতে নেই।  
- সত্যি কথাই তো বলছি রে ভাই। 
- কি হয়েছিল তোমার বলো না শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। 
- বলবো বলতে এসেছি তোর কাছে অনেক কাজ বাকি আছে রে। 
- ঠিক আছে তুমি একটু বিশ্রাম করো তারপর না হয় শুরু করবে। 
- না সময় খুব কম, চারিদিকে ফতোয়া জারি হয়েছে আমাকে দেখলেই এনকাউন্টার,বা বন্দি সব শেষ। 
- কি আবোল তাবোল বকছো কি সাংঘাতিক কথা বলছ? 
- তোকে বলেছিলাম না বাবাকে  আর খুঁজে পাওয়া যাইনি। আমি তো আমাদের লড়াই কায়েম করার জন্য নানা জায়গায়  ঘুরে ঘুরে এককাট্টা করছিলাম আমাদের জাতিদের। 
- হ্যাঁ সেতো জানি
- আস্তে আস্তে সবাই আমার কথা শুনছিল বুঝাতে চেয়েছিলাম সবাইকে আমরা তো বেশিরভাগই উদ্বাস্তু না আছে ঘর, না ঠিকানা,  না পেট ভরার মত কোন রসদ, সব সময় দয়া ভিক্ষা বা চুরি করা,  চুরি করে খাবার জোগাড় করা।  জীবন থেকে মুক্তি পেতে কি কি করতে হবে  তাই বলেছিলাম, সবাইকে বোঝাতে চেয়েছি অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত হয়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, অধিকার প্রতিষ্ঠা করার। 
- আমারও বন্দী দশা  ভালো লাগে না ভাই
= এভাবেই চলছিল বিপ্লবের পাঠ।  হঠাৎ একদিন শহরে এসে পড়ি বাবার সাথে দেখা হয়ে যায় হাসপাতাল চত্বরে বাবা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে পালাচ্ছিল
- কেন
= পরিচয় অস্বীকার করবে বলে। রাগ হল খুব যার জন্য আমার মায়ের এত কষ্ট,  আমার,এত কষ্ট, চোরনী নামে মায়ের অপবাদ, ইচ্ছে হচ্ছিল  ঝাঁপিয়ে বাবার  ঘাড় মটকে  দি।  পারিনি বাবা তো। 
- আমরা তো এখনো সম্পর্কে বিশ্বাসী মানবতার পূজারী
- হাঁ রে  এ তো আমি তোকে শিখিয়েছি, শোন অন্য জাতিভাইদের  মুখে জানতে পারি আমার নাকি আরো কয়েকটা মা, ভাই আছে, বাবা এলাকার দলের সর্দার। 
- কি ভয়ংকর
- হ্যাঁ অন্য মা ভাই বোনদের উপর না বাবার উপর একরাশ ঘৃণা হয়েছিলো।  জিজ্ঞেস করেছিলাম  কেন আমাদের বিসর্জন দিলে? 
- কি বলল তোমার বাবা
- এটাই ধর্ম। ধোঁকা দেওয়ায় কাজ পুরাতন বিসর্জন দিয়ে নতুনত্ব কে আবাহন করতে হয়।  আমি অবাক হয়ে যাই।এইজন্য,এখনকার  নেতার মত চাটুকদারী কথা। মুহূর্তে  ওখান থেকে চলে আসি।  

- তবে যে  বলছিলে  জেলখানা
- সেটাই তোকে বলছি রাস্তায় ঘুরে ঘুরেই আমার জাতির লোকদের অনেক কে আমার স্বপ্নের কথা বলি,  ফ্যাক ফ্যাক করে  হেঁসে সবায়
পালিয়ে যায়। কেউবা বলে ন্যাকামো করো না সুযোগ পেলে খাবার ছিনিয়ে নাও।  সে সময় বুঝলাম...
- কি বুঝলে
- অধিকার, কাইম, সমাজতন্ত্র, প্রয়োগের ক্ষেত্র আলাদা আলাদা। 
- সমাজতন্ত্র কি গো
- ও, তোকে সহজ করে বলি, যে সমাজ ব্যবস্থায় সবাই সমান অধিকার ভোগ করে সেটাই সমাজতন্ত্র
- চলনা, আমরা স্বাধীনতা খুঁজি, সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠি। 
-  মনে তুমুল ঝড় ওঠে,  নিজের মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় হাজার প্রশ্ন, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি বারবার। শহুরে একটা পার্কে বসে আকাশের দিকে চেয়ে জীবনের কথা ভাবছিলাম হঠাৎ কানে এলো কি ভাইয়া করছো কি? তাকিয়ে দেখি
- কি দেখলে? 
- তোর  মত নাদুসনুদুস একটা কুকুর ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসছে।  তোর কথা খুব মনে পড়ে গেল কেঁদে উঠলো মনটা আমার। 
- তাই বুঝি!
- হ্যাঁ রে তোকে খুব মিস করছিলাম। কুকুর ভাই আমাকে বলল, আগে তো তোমায় এদিকে কোনদিন দেখিনি নতুন বুঝি? থাকো কোথায়?"। 
 আমি বললাম গাঁ  থেকে এসেছি।  ও বল্ল, বাউণ্ডুলে  বুঝি? কি মন চাই  না আস্তানা?  আমিও মাথা নাড়ি। ও বললো, "তোমাকে একটা পথ বলতে পারি তবে কি জানো ভাইয়া উপযাচক  হয়ে  কাউকে উপকার করলে পিছনে আঝোরা বাঁশ নিতে হয়। তোমাকে দেখে বেশ সহজ সরল মনে হচ্ছে তাই মায়া হলো তাই আমি.
একটা তোমার ব্যবস্থা করে দিতে পারি নিরম্বু উপবাস থেকে তো কমসেকম বাঁচবে। যদি তোমার ভালো লাগে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। মন চাইলে 
 যখন খুশি চলে যেতে পারো তোমার ইচ্ছে"। ওর কথা শুনে আমার খুব ভালো লেগে গেল চলে গেলাম ওর সাথে ওর মনিবের বাড়ি। 
- তাহলে জেলখানা বলছ কেন? 
= আরে বলছি বলছি।  কি আনন্দ ক'দিন। বাসার নাম দিয়েছে "আনন্দ নিকেতন"। কতো ধরনের কুকুর দেশী-বিদেশী কতো প্রজাতির সবার জন্য আলাদা আলাদা সুন্দর থাকার ব্যবস্থা ঠিক যেন ফাইভ স্টার হোটেল অত্যাধুনিক ব্যবস্থা. রুটিনমাফিক অনুশীলন. সাপ্তাহিক বডি চেকআপ,আরো কত কি। ঠিক যেন  আমার স্বপ্নের রাজ্য। 
- আমাকেও নিয়ে চলো না তোমার সঙ্গে...
= চুপ এসব লোক দেখানো টাকা রোজগারের কারখানা।  একটা রূপান্তর জীবন। নতুন নতুন কুকুর ক্রস করে  নতুন নতুন প্রজাতি চড়া দামে বিক্রি। কাজ শেষে আবার আমাদেও বিক্রি করে দেয়। আবার বিক্রি. এইভাবে হাত ফেরত হতে হতে এক বদ্ধ জুয়াড়ি,  মাতালের কাছে এসে পৌঁছায়।  

- সেকি গো? 
- চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আমার সারা দেহে কালশিটে দাগ  পড়ে গেছে । প্রথম বিক্রির সময় আমি কুকুর বন্ধুকে বলেছিলাম কেন আমাকে ধোঁকা  দিলে? ও হেসে বলেছিল, "বোকা ধোঁকা দেওয়াই আমার পেশা।  আমিও তো ধোঁকা খেয়ে এখানে এসেছি"।  কথাটা বলেই  হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, আমাকে জাপ্টে ধরে ছিল বলে ছিল, "ক্ষমা করে দিও"। আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। 
- মায়া হচ্ছিল খুব তাই না? 
 হবেই তো। এটাই তো জীবনের নতুন পাঠ বর্ণমালা।  একদিন সুযোগ এলো মনির আমাকে খোলা রেখে কোন এক জরুরি মিটিংয়ের চলে গেল। এসে গেল সুযোগ, মুক্তির আনন্দে মন মেতে উঠলো,  দিলাম চম্পাট, দৌড়...দৌড়...  দৌড়.. কত পথ  পেড়িয়ে অজানা অলি গলি পেড়িয়ে, বনবাদর পেড়িয়ে,  রাস্তাঘাট পেড়িয়ে, অনেক কষ্টে এইখানে। দুদিন থেকে এখানে বসে আছি। 
বৃষ্টির জলে ভিজে জবুথবু হয়েছি তবু বিশ্বাস ছিল তুই আসবি। তুই বেঁচে আছিস। 
- তুমি না ওই মন্দির দিকে আজ থেকে থেকো। আমি  তোমায় মাঝে মাঝে দেখতে আসবো। 
- না রে  থাকবো না। 
 তুই কি যাবি আমার সাথে?  আমি নতুন জীবন দেখতে চাই, সত্যি যাবি আমার সাথে? 
- হ্যাঁ গো আমি তোমার সাথে যেতে চাই আমাকে মুক্ত করো মুক্ত করো এই পরাধীন জীবন। আমি স্বাধীনতা চাই...
- চল আমরা যাই ফিরে সেই তপবন আশ্রম। ওখানেই শুরু করি নতুন জীবন, ঋদ্ধ  হই  ঋষিদের মাঝে থেকে।   শুরু করি শুদ্ধতার পাঠ, শুরু করি মঙ্গলাচরণ, শক্ত হয়ে ওঠে তৈরি করি নিজেদের মন মানসিকতার  বিকাশ।  সজীব করে তুলি মানবতা।  জীবনের শিক্ষা নিতে নিতে আশাবাদী হয়ে উঠি খুঁজে নি  সত্য পথের ঠিকানা। 

------------------------------
 অন্ধকার হয়ে আসছে চারিদিক।  দুটি হৃদয় বড় কাছাকাছি আজ। একে অপরকে জাপ্টে ধরেছে,  টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়ছে.....
চিবুক বেঁয়ে।  চোখে-মুখে বিস্ময়। হাওয়ার স্রোত বইতে শুরু করেছে,  মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে,  একটু পরেই অঝোড়ে  বৃষ্টি নামবে উঠে দাঁড়িয়েছে ডাব্বু কাব্বু, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে নতুন পথের  ঠিকানায়......

অভিজ্ঞতার পাঠশালায় নীরদ দত্ত


        অভিজ্ঞতার পাঠশালায়
                               নীরদ দত্ত
--------------------------------


যে শিশু চায়ের দোকানে
মনিবের চাবুক খেতে খেতে বড় হলো,
যে শিশু স্নেহ-ভালোবাসার মরুভূমিতে
কামারশালার দগ্ধ হাপরের মতো
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আর
অভিজ্ঞতার পাঠশালায় বঞ্চনার অক্ষরে
সাজানো "বর্ণপরিচয়" পড়তে পড়তে বড় হলো
আজ সে সমাজ চেতনায় দার্শনিক ৷
হয়তো তার সরকারি কোনো শংসাপত্র নেই
নেই তথাকথিত বিদ্বজ্জনদের মতো
আত্মকেন্দ্রিক জীবনের আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্ক্ষা,
সে জানে না তার নিজস্বতাকে
নিলামের দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে
গিরগিটির মতো রঙ বদলাতে,
তাইতো সে আজও রবির রুদ্র দহনে
নগ্ন পায়ে খাদ্যের মিছিলে হাঁটে পথ,
উন্নত শিরে বজ্রমুষ্টিতে
আকাশকে ধরতে চায়
অনুকম্পাকে পদদলিত করে
অভিজ্ঞতার পাঠশালায় পুঞ্জিভূত
সমাজের শোষণ শাসনের নির্মমতাকে ভেঙে
পূবের সূর্যকে আপন করতে চায় ৷
********************************************

ছাত্র যখন শিক্ষক ডঃ সঞ্জীব রায়


ছাত্র যখন শিক্ষক
------------------------
ডঃ সঞ্জীব রায়
------------------------



রাহুল ছেলে হিসেবে বড়ই ভালো। একটাই দোষ, পড়াশোনায় মন নেই। বাবা-মা আর এক বোনকে নিয়ে সংসার। বেশ কষ্টেই চলে।  বাবা হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। নবম শ্রেণীর ছাত্র রাহুল পারলৌকিক ক্রিয়া মিটে যাওয়ার কয়েকদিন পর স্কুলে হাজির হয়।

প্রথম দিনেই দ্বিতীয় ক্লাসটি অনিলবাবুর, ইংরেজি। অত্যন্ত বদরাগী অনিলবাবু কারণে-অকারণে প্রহার করেন। সেদিন তিনি Tense পড়াচ্ছিলেন। রাহুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমার বাবা ৭দিন ধরে জ্বরে ভুগিতেছেন - এর ইংরেজি কী হবে?" পড়া না পারলে রাহুল চুপ করেই থাকে। সেদিন কি হলো, ছলছল চোখে বলে ফেলে "আমার বাবা একমাস আগে গত হয়েছেন।" ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা না বুঝেই হেসে ওঠে৷ রেগে অনিলবাবু পাগলের মত রাহুলকে প্রহার করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে হেডমাস্টারমশাই অত্যন্ত বিচলিত হয়ে প্রচন্ড কাঁপতে থাকা রাহুলকে একটি ছেলের সঙ্গে বাড়ি পাঠান।

দুদিন পরে অনিলবাবু কি মনে করে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিজের নাম গোপন করে রাহুলকে দেখতে যান। দরজার সামনে সাদা কাপড় পরিহিতা এক মহিলা নিজেকে রাহুলের মা বলে পরিচয় দিলেন। কঠিন হৃদয় অনিলবাবুর মূহুর্তের উপলব্ধি, হয়ত রাহুল সত্যি কথাই বলেছিল। জিজ্ঞাসা করেন "রাহুল এখন কেমন আছে ?" উত্তরে মা বলেন, "জ্বর আছে। দুজন সহপাঠী বলেছিল স্কুলের মাস্টারমশাই অনিলবাবু ওকে খুব প্রহার করেছেন। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করলে বলে - মা উনি খুব ভালো। আমি বন্ধুদের সঙ্গেই মারামারি করেছি।" অনিলবাবু আর বসতে চাননি।

বিদায় নেবার মুহূর্তে রাহুলের মা হাতজোড় করে বলেন, "মহাগুরুনিপাত বছর, খুব ভয়ে আছি ওকে নিয়ে। দয়া করে একটু আশীর্বাদ করে দেবেন।" অনিলবাবু তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 


গল্পঃ ফিরে পাওয়া

ফিরে পাওয়া

অর্পিতা মজুমদার

-----------



সোদপুর স্টেশন, বিকেল ৪:৩০টা- জনারণ্য! কোনরকমে ভিড় ঠেলে কল্যাণী সীমান্ত লোকালের মহিলা কামরায় উঠতে পারলো মেধা। হাতে দুটো ভারী ব্যাগ , কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। গন্তব্য ব্যারাকপুর।  মাত্র দুটো স্টেশন ।তাই বেশি ভেতরে গিয়ে তো লাভ নেই। এ সময় ট্রেনে অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড়। কামরায় ঢোকার মুখেই কয়েকজন মহিলা এমন ভাবে দাঁড়িয়ে যে একটুও এগোবার উপায় নেই। একেই তো আজ গুমোট গরম তার ওপর কামরার ভেতরে এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। এক মধ্যবয়সী মহিলা বলেই ফেললেন" এসময় কেউ দুটো ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠার সাহস দেখায়? " আর একজন তৎক্ষণাৎ সায় দিলেন" নেমে যান! নেমে যান! " এই পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকাই সমীচীন মনে করলো মেধা। 

আজ তাড়াতাড়ি স্কুলে ছুটি হওয়ায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে, রেডিমেড সেন্টারে একটা অফার চলছিল, কেনাকাটা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। 

পরের স্টেশনে একজন অল্পবয়সী সুদর্শন যুবককে ওই কামরার গেটে দেখা গেল। দেখামাত্রই হৈচৈ শুরু হল। " এই ছোকরা! জাননা এটা মহিলা কামরা? " কী স্পর্ধা দেখেছো, আজকালকার ছেলেদের! " ইত্যাদি, ইত্যাদি। কমবেশি সবাই ছেলেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেধা ভাবলো ভালোই হয়েছে, সবার নজর এখন ছেলেটির দিকেই। 

ছেলেটিকে দেখল মেধা। মহিলা কামরায় ওঠা অন্যান্য ছেলেদের মতো তো লাগছে না! প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সুগঠিত মেদহীন শরীর, গায়ের রং বেশ পরিষ্কার, চোখে রোদ চশমা। সব রকম কটুক্তি উপেক্ষা করে, ছেলেটি হাওয়া খেতে খেতে চললো। 

ব্যারাকপুরে ট্রেনটি প্লাটফর্ম বদল করায়, নামার সময় মেধা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে  পড়ার উপক্রম হল, কিন্তু কেউ যেন অতি যত্নে ব্যাগ দুটো সামলে হাত ধরে মেধাকে নামতে সাহায্য করলো। 

" আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাম?  আমায় চিনতে পারেননি আপনি ? আমি তো সোদপুর স্টেশনেই আপনাকে দেখে চিনতে পেরেছি" । ছেলেটি সহাস্যে বললো। রোদ চশমাটা খুলে ফেলেছে ছেলেটি। 

এবারে মনে পড়েছে। ছেলেটির নাম হারুন। ব্যারাকপুর গান্ধী ঘাটে বেলুন বিক্রি করে পড়াশোনা চালাতো। স্কুলে তো বটেই, মেধা নিজের বাড়িতেও দুবছর পড়াশোনায় সাহায্য করেছিলো  হারুনকে। তবে কিছু দামি বই আর ক্যালকুলেটর ফেরত দেয়নি বলে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিল মেধা। 

" আমি এখন বায়ুসেনা অফিসার ম্যাম। আপনি সেই সময় আমার পাশে না থাকলে আজ হয়তো এ জায়গায় আমি পৌঁছাতে পারতাম না। আজই কলকাতায় এসেছি। আপনার দেওয়া বইগুলো এবং ক্যালকুলেটর কাল আমি স্কুলে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসব ।আমার কাছে ওগুলো যত্ন করে রাখা আছে"। 

আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে মেধা বলার চেষ্টা করল" থাক না সেসব! "

" আমার মতন অনেকে আছে ম্যাম, তাদের ওগুলো প্রয়োজন হবে"। হারুন হাতজোড় করে বলল। মেধা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সব  বিরক্তি এক নিমেষেই খুশিতে পরিণত হয়েছে তার। 

কিছুই তো হারায় নি!  কিছুই হারায় না। সব ফিরে আসে, সুদ সমেত!

নিভু দীপের ধোঁয়া -- গৌতম তরফদার


নিভু দীপের ধোঁয়া
------------------------ 
 গৌতম তরফদার
--------------------------


          বিচ্ছেদের আজ সাত বছর পূর্ণ হলো। সকালেই গৌড় এক্সপ্রেসে মালদা টাউন স্টেশনে নেমে ই-রিক্সায় সোজা বাড়ি পঞ্চমীর সকালে ঋচীক দাসগুপ্ত। মা অধীর অপেক্ষায় ছিল। প্রায় সাত মাস পরে ছেলে বাড়ি এল। বাবা তিন বছর আগেই গত হয়েছেন। বাড়িতে এখন শুধুমাত্র মা আর কাজের মাসি মন্দা। সেও প্রায় ১০ বছর ধরে মায়ের সাথেই আছে এই পরিবারের একজন হয়ে।

         ভালোবাসার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র তিন বছর পুবালি দে'র সাথে। তখন কলেজে পড়ে। দু'জনেই একই শহরে থাকার সুবাদে ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ কখনও রেস্টুরেন্টে, কখনও সিনেমাহলে নতুবা পার্কে। শেষ বছরে তৃতীয় জনের প্রবেশ। শৈবাল কাঞ্জিলাল। রীতিমত ধনী ঘরের দুলাল। ঠাটেবাঁটে, হাবভাবে, প্রাচুর্যের জোয়ারে পুবালি ভেসে গেল। ঋচীক-কে এড়িয়ে যাওয়া শুরু। কিন্তু ঋচীক পুবালির প্রেমে পাগল। অল্পদিনেই অবজ্ঞার চরমরূপ দেখতে পেল ঋচীক। ঠিক সাত বছর আগে এই পঞ্চমীর দিন রথবাড়ি মোড়ে সন্ধ্যায় ঋচীক একাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুর্গাপূজা প্যান্ডেলের লাইটিং দেখছিল। হঠাৎ একটা মোটরসাইকেল সামনে এসে দাঁড়াল। শৈবালের পেছনে পুবালি বসে। নেমে এসেই পুবালি কর্কশভাবে বলল," আজ আমাকে এতবার ফোন করে ডিস্টার্ব করেছ কেন?  তোমার সাথে তো আমার কথা নেই। নিছক বন্ধুত্ব ছিল। তার বেশী কিছু নয়। এরপর আর কোনোদিন আমাকে ডিস্টার্ব করবে না বলে দিলাম।" 

        এরপর শৈবালও নেমে এল। সরাসরি বলল," মজা দেখাবো তোকে। প্রস্তুত থাকিস "। ওরা চলে যেতেই কয়েকটা ছেলে এল। কিছু বোঝার আগেই সজোরে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিল ঋচীকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেল। চারিদিকে শারদীয়া পূজার  জ্বলতে থাকা হাজার দীপের আলো যেন নিভে গিয়ে দু'চোখ ধোঁয়াতে ভরে গেল। 

         সেই শেষ। ঋচীক মাস্টার্স করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। পড়া শেষ হতেই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে বি গ্রেডে অফিসার পদে চাকরি। দীঘায় পোস্টিং। মালদা ছাড়লো চাকরি পেয়ে। কয়েকমাস বাদে বাদে বাড়ি আসে। মায়ের আবদার এড়িয়ে আজও বিয়েই করেনি। বিয়ে আর করবে না ভেবেই নিয়েছে। 

       সারা দুপুর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঠিক সন্ধ্যার মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি পূজার প্যান্ডেল গুলো দেখতে শুরু করল। দিশারী সংঘের পূজো প্যান্ডেলের কাছে যেতেই দেখে দর্শনার্থীর ভীষণ ভিড়। হঠাৎ দেখে প্যান্ডেল থেকে সামান্য দূরে একটা বছর তিনেকের ফুটফুটে মেয়ে অঝোরে কাঁদছে।  কয়েকজন তাকে ঘিরে রয়েছে। কাছে গিয়ে জানল সে তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এত ভিড়ে হয়তো হারিয়ে ফেলছে। ঋচীক মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। "কেঁদো না সোনা মেয়ে। তোমার মাকে আমি এক্ষুনি  খুঁজে দিচ্ছি। 

    -- কী নাম তোমার? তোমার মায়ের নাম কী?
    -- আমি পুচকি।  আমার মা পুবালি। 

  চমকে গেল ঋচীক। সেই নয় তো? আবার জিজ্ঞেস করল, " তোমার বাবার নাম কী? " 

   -- আমার বাবা শৈবাল। বাবা আকাশের তারা হয়ে গেছে। 

     ঋচীক দ্রুত ক'জনের সাথে ভিড় ঠেলে প্যান্ডেলে পৌঁছে মাইকে ঘোষণা করিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিন-চারজন মহিলা একসাথে এল। হ্যাঁ, তারমধ্যে পুবালি একজন। কিন্ত একী চেহারা হয়েছে পুবালির! রোগা, গাল বসা, চোখের কোণে কালির প্রলেপ। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। 

       ঋচীক মেয়েকে পুবালির কোলে সঁপে দিল। পুবালির দু'চোখ জলে ভরে গেল। একদৃষ্টে ঋচীকের দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। 

       ঋচীক আজ আবার হাজার দীপের আলো নিভে যেতে আর ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখল।


মৌমিতা সরকার


তিন টাকার গল্প
-----------------------
মৌমিতা সরকার
 ----------------------- 


-"তিনটে টাকা দিবি?"
ব্যান্ডেলের তিন নং প্ল্যাটফর্মে ডাউন ট্রেনের জন্য আনমনে অপেক্ষা করার সময় আচমকা সম্বিত ফিরল এই প্রশ্নে। পিছন ঘুরে দেখি একটা বুড়ি, শতচ্ছিন্ন,  মলিন একটা শাড়ি পড়ে ডান হাত টা বাড়িয়ে বসে আছে। ওর দিকে তাকাতেই ফোকলা মাড়ি বার করে নিষ্পাপ একটা হাসি হেসে আবার বলল-
-"দিবি তিনটে টাকা?"

এই স্টেশনে পাগলীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। হঠাৎ যদি কোনো পাগলীকে দু হাত বাড়িয়ে কোনো এক অসহায় নিত্যযাত্রীর পিছনে দৌড়তে দেখা যায় ( উদ্দেশ্য কখনও কখনও বলপূর্বক চুম্বনও হতে পারে) তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সে যাই হোক, তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম গত তিন চারদিন স্কুলের half yearly পরীক্ষার খাতা দেখার চাপে লোকজনের সাথে কথা বলার তেমন সময় পাইনি। হলই বা একটা পাগলী, খানিকটা গল্প করা যাক।

-"দিবি না? একটা, দুটো, তিনটে টাকা?"
-" হ্যাঁ, দেবো তো। তা তুমি এইরকম ঝড়-জলের দিনে স্টেশনে বসে ভিক্ষা করছ কেন? ঘর বর নেই? না ছেলে বউ দেখে না?"
-" কি বললি? ঘর, বর, ছেলে!! হ্যা হ্যা হ্যা...সব ছিল, সব। কপাল বুঝলি?"
-" না বুঝলাম না। নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দিয়েছে?"
-" তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ওই দেখ আকাশ টা দেখ। ওই আকশের ওপারে নাকি বলে ভগবান আছে। চোখে ছানি পড়েছে তো। আমি আর তাকে দেখতে পাই না। তাড়িয়ে দিয়েছে, তাড়িয়ে দিয়েছে, বুঝলি? ওই শা' ভগবান আমায় ঘর বর ছেলে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর ওই তিনটে শব্দ, ওই তিনটে শব্দ তাড়িয়ে মারছে আমায়। যেদিকে যাই।"

বুঝলাম মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বেশ কিছুটা।  ট্রেন আসতে তখনও খানিক দেরি। কিন্তু আমার বড্ড জানতে ইচ্ছা করছে।

-"আচ্ছা, তোমায় ওরা এমনি এমনি তাড়িয়ে দিলো? ভালোবসেনি কখনও? "
-" হ্যা হ্যা হ্যা.....খুব বেসেছে।  ওইরকম ভালো আর কেউ বাসেনি বুঝলি? বর আমার খুব খেয়াল রাখত। সাত বাড়ি কাজ করে বাড়ি ফিরতাম যখন, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। সে মুখখারাপ করত খুব, কিন্তু রান্না করে দিত। আর রাতের বেলা আদর করত খুব। কিন্তু ওই যে ওলাউঠো ভগবান! সহ্য হল তার? হঠাৎ করে একদিন সে ঘুম থেকে আর উঠল না রে। সে কি ঘুম.... কি ঘুম। আমার কেন এমন ঘুম হয় না? গুনে গুনেও ঘুম হয় না।
এক..দুই...তিন
এক..দুই...তিন।"
-"আর তোমার ছেলে?"
-" আমার ছেলে....আমার ছেলে...."
-" হ্যাঁগো তুমি বললে না? ঘর...বর...ছেলে।"
-" সেদিন রাতে তাকে নিয়ে চলেই গেলো।  ভোটের সময়। খুব অন্ধকার।  সবে সবে ঘুমিয়েছে সে। দরজায় তিনটে টোকা। খুলতেই হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়ল একদল লোক। তারপর কি মার মারল রে আমার ওই বাচ্চা ছেলেটা কে। ওদের বুক কি পাথর দিয়ে গড়া? হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। হাতে ধরে,  পায়ে পড়েও আটকাত পারলাম না। আমার দেবশিশু টা রে, আমার বাপ, আমার কোলজোড়ানো হাসি... 
কালী পুজোর বলির সময় ছাগলটা যে শেষ ডাকটা ডাকে, আমি তখন ছেলের মুখে সেই ডাকটা শুনেছিলাম। তারপর...তারপর..."
-"তারপর?"
-"তারপর ওই তিনটে আওয়াজ। ফট, ফট, ফট। আমার ছেলের আওয়াজ তখন থেমে গেছে। আমি আর ভাবতে পারি না, আর..আর গুনতে পারি না। এক..দুই...তিন...তারপর তো সবকিছু হারিয়ে গেছে।
.........................
দিবি? আমায় তিনটে টাকা?"

ট্রেন টা আসতেই ঝাপটা দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।  পাগলীটার ঘোলাটে চোখে এক পৃথিবী কষ্ট। আমার কিছু বলার নেই। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যা ছিল সবটাই বার করলাম। শুনেছি নাকি, কাউকে দিতে গেলে হাতে যা ওঠে তাই দিতে হয়। হাতে উঠলো ওই তিনটে টাকাই। কপাল! ভেবেছিলাম কিছু বেশিই দেবো। টাকাগুলো দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়ল। মুখ বাড়িয়ে দেখি, সে আপন মনে গুনেই যাচ্ছে,
এক....দুই....তিন*********

Tuesday, October 5, 2021

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে

মানুষ থাকলে ভূত ও থাকে 
অনিল চন্দ্র সিকদার
------------------------------ 


গ্রামে মানুষ থাকলে ভূতও থাকবে। মানুষ আছে ভূত নেই, ছেলে বেলায় আমরা ওটা কল্পনা করতে পারতামনা। আমাদের বাড়িটার সামনে পুকুর, দক্ষিণে খাল, খালটা গেছে সেনদের বাড়ির পাশ দিয়ে। মাঝখানের জায়গা টা অন্য কারোর। বড় একটা আম বাগান। পিছনে একটা জামরুল গাছ, আর আমাদের  আম বাগান। আমগাছ গুলি এত বড় যে ঐ গাছ বট গাছের মত। উঠাও  মুস্কিল। 
আমগাছের পাশে ঘন  বেতের জঙ্গল চারিদিকে ঘন অন্ধকার। কাছেও যাওয়া যায়না। গাছে বড় বড় অজস্র কাঁঠ পিঁপড়ে। গায়ে রসুন গোটা তেল মেখে না উঠলে, কারো সাধ্য নেই  গাছে উঠে। 
এহেন ঐ বিশাল গাছটায় এক ভুতের আবাস ছিল। 
অগম্য জায়গা হলেই আমাদের ধারনা হয়, ওখানে 
ভুত থাকে। রাতে আমরা কোনো ভাই বোনেরা  একলা  ঘর থেকে বের হতে সাহস পেতামনা। 

ন-বছরে আমার উপনয়ন হয়। উপবীত হয়ে ও আমাকে ভূতের  ভয় থেকে রক্ষা করতে পারেনি। 
ছোট কাকা বাড়ি না থাকলে আমার কিংবা বড় দারপালা পড়তো ঠাকুরের বৈকালি দেওয়ার। ভূতের ভয় থেকে গৃহদেবতা  ও তখন  মুক্ত  থাকতেন না। ঠাকুর ঘরের পাশে ছিল দুটো বড় তালগাছ। তাল হত না। কোন অশুভ প্রভাব না থাকলে গাছ অন্যান্য হয়না। তাই মনে  হচ্ছে আমাদের কাছাকাছি যিনি থাকেন  ওনি আমাদের ছোটো ঠাকুর দা। তাঁর পৈতা হওয়ার আগেই নাকি তিনি সামনের পুকুর টার জলে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। তালগাছ দুটো তাঁরই লাগানো। ছোট বয়সেই ছোট ঠাকুর দার গাছ পালার বাতিক ছিল। 
তালগাছ  আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। 

যাই হোক ছোট ঠাকুর দা মারা যাওয়ার পর বড় ঠাকুর দা গয়া ধামে গিয়ে পিন্ড দান ও করেছেন। অথচ তারপরও নাকি বড় ঠাকুর দাঐ তালগাছে ছোট ঠাকুর দাকে কয়েকবার দেখেছেন। বিশাল
দৈত্যের মত চেহারা এক পা তালগাছে আর এক পা আমগাছে দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর আমাদের  বাড়ির দিকে  তাকিয়ে  বাড়ি পাহারা দিতেন। ছোট ঠাকুর দা  ভূতটি বরং আমাদের কোন ক্ষতি করেননি, ভালই করেছেন। বরং  তারই দয়ায় নাকি আমাদের বাড়িতে অপমৃত্যু ও অকাল মৃত্যু ঘটেনি। শিশুদেরকে টৌকায় ধরে না। বাড়িতে শিশু  জন্মালে মরেনি। বাঁচে বড় হয়। সবারই ধারণা ছোটো ঠাকুর দা আছে বলেই বাড়ির সবাই ভাল আছে। ভূত যেমনটা ভাল আবার তেমনটা  খারাপ ও আছে।