Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Monday, December 9, 2019

শেষ দেখা --- অন্তিম পর্ব

                 শেষ দেখা --- অন্তিম পর্ব

    স্টেশনচত্বর একদম খাঁ খাঁ করছে । টোটোর কোনো চিহ্ণ নেই । মনে পড়ল গতকালের একটা ভাসা ভাসা কথা --- বিকেলের দিকে টোটো উইনিয়নে মিটিং আছে বোধহয় । উঃ এবার কি করবে । চোখ ফেটে জল আসছে । কি আর করা যাবে । আসার সময় তাড়াহুড়োয় মোবাইলটা টেবিলেই ফেলে এসেছে বোধহয় ।
হাটাপথ ধরল ঐশী । মাঠের মধ্যে দিয়ে গেলে একটু সর্টকাট হয় । জমির ফসল উঠে গেছে । মাঠও এখন ফাঁকা । অন্তত দশ মিনিট সময় কমবে ।
মনের মধ্যেটায় কু ডাকছে বারবার । হে ঈশ্বর ভালো করে দিও । বাড়ি ফিরে মানুষটাকে যেন ভালো দেখতে পারি ।
    সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে পালদের  পুকুরের কাছে চলে এসেছে ঐশী । আর বেশিদূর নয় তাদের বাড়ি । পুকুরটা বায়ে রেখে একটু এগোলেই বড়ো রাস্তা । তারপর পাঁচ মিনিট হাটলেই ওদের সাবেকি বাড়ি । যদিও এত বড় বাড়িতে এখন বাসিন্দা বলতে ওরা চার শরিকের চার ছেলের পরিবার । আর তাদের চার ঘর ভাড়াটে ।

    হঠাৎ পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধরাস করে উঠল ঐশীর । একটা আবছায়া দেখা যাচ্ছে । এইসময় এখানে কে দাঁড়িয়ে আছে । পা যেন ভারী হয়ে আসছে ঐশীর । পালদের পুকুর সম্পর্কে বদনাম আছে অনেক । প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের পুরানো পুকুর । দেবাংশুর চিন্তায় আগে পুকুরের কথা মনে পড়েনি । পুকুরপাড়ের কলাবাগানের মধ্যে কি যেন একটা ছুটে পালালো । ঐশীর গা শিরশির করে উঠল । একপা একপা করে এগোতে লাগল ঐশী । আর কিছু মাথায় আসছে না । আবছায়াটা এবার উঠে দাঁড়ালো । ঐশী আর এগোতে পারল না । মুহূর্তে চোখের সামনেটা অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে শুনতে পেল কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে ।

     এ কি দেবাংশু তুমি এখানে ।
আজ তো টোটো ইউনিয়নের মিটিং আছে । টোটো পাবে না । ফোনেও তোমাকে পাচ্ছি না । তাই এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি ।
ওঃ কি ভয় পেয়েছিলাম । তোমার কথা ভাবতে ভাবতে  আর এই পুকুরের কথা মনেই ছিল না । কিন্তু তুমি যে বললে তোমার শরীর খুব খারাপ । তাহলে এতটা পথ এলে কি করে ।
অন্ধকারে দেবাংশুর মুখটা দেখা গেল না । এইরকম পরিবেশে সুস্থ দেবাংশুকে পেয়ে আজ যেন কথায় পেয়েছে ঐশীকে ।

     হঠাৎ মনে হল পাড়াটা যেন আজ একটু বেশিই নিস্তব্ধ । কুকুরগুলো চুপচাপ । মনে একটা খটকা লাগলেও দেবাংশুর সুস্থ হয়ে ওঠার আনন্দে এসব আর আমল পেল না ঐশীর কাছে ।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বাড়ির সামনে বহু মানুষের জটলা চোখে পড়ল ঐশীর । কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই 'তুমি এগোও , আমি একটু আসছি ' বলে যেন অন্ধকারে মিশে গেল দেবাংশু ।
ঐশী পায়ে পায়ে বাড়ির গেটের কাছে উপস্থিত হয় । তাকে দেখতে পেয়ে সবাই তার পথ ছেড়ে দাঁড়ায় । সবার চোখে মুখে কেমন একটা সন্ত্রস্তভাব । কিছু বুঝতে না পেরে ঐশী ছুটে যায় ভেতরদিকে । উঠোনের মাঝখানে শোয়ানো রয়েছে দেবাংশুর নিষ্প্রাণ নিথর দেহ । এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না ঐশী । তার অচৈতন্য শরীরটা লুটিয়ে পড়ল মৃত দেবাংশুর পায়ের কাছে ।

Thursday, December 5, 2019

শেষদেখা --- প্রথম পর্ব

                  শেষদেখা --- প্রথম পর্ব

ট্রেন থেকে নামতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল ।প্রায় দু'কিমি পথ এখনও যেতে হবে । টোটো করে যেতে হবে । মনের মধ্যে নানান চিন্তা ভিড় করে আসছে । একটা সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা । মনটাকে কিছুতেই সংযত করতে পারছে না ঐশী ।
অফিসে তখন লাঞ্চব্রেক চলছিল । খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে মাত্র মাত্র টেবিলে বসেছে , ওমনি দেবাংশুর ফোন ।
তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো , আমার শরীরটা ভালো লাগছে না ।
তখন থেকেই মনটা খচখচ করছে । ক'দিন ধরেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছে । গত বুধবার অফিস থেকে ফিরল জ্বর নিয়ে । রাতে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল ঐশী । সামান্য জ্বর । রাতটা গেলেই ভালো হয়ে যাবে । কিন্তু রাতটা যেন আর কাটতেই চাইছে না । জ্বর কিছুতেই একশো চারের নীচে নামছে না । গত দু'দিন এভাবে কেটেছে । দুদিন পর আজ অফিসে এসেছে ঐশী । ভেবেছিল একটু তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে । কিন্তু দেবাংশুর ফোনটা পেয়ে আর স্থির থাকতে পারল না ঐশী । কোনো রকমে একটু খেয়ে রাইকে ফাইলগুলো বুঝিয়ে দিয়েই বেড়িয়ে এল । তবু প্ল্যাটফর্মে পৌঁছবার আগেই তিনটে চল্লিশের ট্রেনটা বাই বাই করে বেরিয়ে গেল । যেদিন তাড়া থাকে সেদিন সবেতেই এরকম হয় । এরপর ট্রেন সেই চারটে পঁচিশে ।
ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত পা চালাল ঐশী।আগে নাগেলে টোটোতে জায়গা পাওয়ামুশকিল হবে।একার জন্য কোনো টোটো যাবে না।আর গেলেও বেশি ভাড়া চাইবে।কিন্তু একি!

Monday, December 2, 2019

অনুগল্প --- খবর

                       অনুগল্প --- খবর

ওমা বৌদি জানো না কাল রাতেই শেষ গো ।
আমাদের কাজের মেয়ে চুমকির বলার ধরনে শুয়ে থেকেও কানটা সজাগ হয়ে উঠল । সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়ার আগে স্থানীয় যা কিছু সংবাদ চুমকির দৌলতে তার প্রায় সবই আমার কানে এসে পৌঁছোয় । এমনকি পাশাপাশি বাড়িগুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তথ্য , যেগুলি কোনোভাবেই আমাদের জানবার কথা নয় সেগুলিও অনায়াসেই আমরা জানতে পারি চুমকির খবর শোনাবার আতিশয্যে । মাঝে মাঝে ভাবি আমার আর আমার স্ত্রীর নির্ভেজাল সংসারে এমন কোনো ঘটনা ভাগ্যিস ঘটে না যেটা এভাবে অন্য কোনো বাড়িতে মুখরোচক হয়ে পরিবেশিত হয় । যাই হোক চুমকির আজকের খবরটা শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম ।
কি আবার হোলো রে । কি শুনব । আমার স্ত্রীর নিরুত্তাপ অভিব্যক্তি । এমন শান্ত শিষ্ট নিরুত্তাপ স্রোতা পেলে আদৌ কারো এমন টাটকা সংবাদ শোনাতে ইচ্ছে হয় কিনা মাঝে মাঝে আমার তাতে সন্দেহ জাগে । অবশ্য এক দিক থেকে আমার স্ত্রী যে এক নম্বর সে কথা মানতেই হবে । কারো কোনো কথায় কখনো বিরক্ত হতে তাকে আমি আজ পর্যন্ত কখনো দেখিনি । সে সবার সব কথাই খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে । আজো তাই ।
ওমা , বিলে গো , বিলে গুন্ডা .... । কাল রাতে ছ'টা গুলি করেছে গো । কি আওয়াজ সাঁই সাঁই করে .... । আমাদের ঘরের কাছাকাছি কিনা .... । ভয়ে আমার সেকি অবস্থা .....। তারপর আমাদের ঘরের পেছন দিয়েই তো সব ছুটে গেল গো । আমার তখন কি কাঁপুনি .... । ভয়ে কাউকে ডাকতেও পারছিনা ..... ।সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারিনি গো ।
প্রত্যেকটা পাড়ায় যেমন একটি করে উঠতি দাদা থাকে বিলেও তাই । ভালো নাম প্রবাল শিকদার । ক্লাশ নাইট - টেনে আমার কাছে পড়ত । বাবা কাঁকিনাড়ার ঔদিকে কিসের একটা কারখানায় কাজ করে । বাড়িতে অনেকগুলো ভাইবোন । ও পরিবারের বড় ছেলে । হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়ার পরপর ওর বাবা মারা যায় । তারপর  এঘাট ওঘাট করে অবশেষে এই পথে স্থিতু হয়েছিল । কিছুদিন ধরেই ওর জুলুমবাজির নানা কান্ডকারখানা কানে আসছিল । তারই কোনোটার প্রতিফলন নাকি আজকের ঘটনা ।
আরে ঐ যে খালপাড়ে দশ বিঘা জমিটা নিয়ে যে বুড়িটা একা একা থাকে না .... । ঔ বাড়িটার ওপর ওর অনেকদিন ধরে লোভ রয়েছে  গো ....। গতকাল বুড়ি ওর বাগানের দুটো মোটা মোটা গাছ কুড়ি হাজার টাকায় বিক্রি করেছে গো । বুড়ির তো কেউ নেই । খাবে কি । তাই গাছ দুটো বেচেছে । তা আর খাওয়া ...... । গাছ কেটে নিয়ে যাওয়াও সারা  আর বিলের ওখানে পৌছনোও সারা । ব্যাস গাছ বেচা টাকা থেকে দশ হাজার দাও । বুড়ি বলে  , ও বাবা  আমি একা মানুষ । কেউ দেখারও নেই খাওয়ানোরও নেই । এই বয়সে কি কাজ করতে পারি । এই টাকা দিয়ে আমি শেষ দিন কটা খেয়ে পরে চলব বলে গাছদুটো বিক্রি করলাম । আর তুই সে টাকাও আমায় দিবিনা । তোর এত লোভ । ভগবান তোর বিচার করবে । ভগবানই তো আমাকে পাঠিয়েছে বলে সে টাকা নিয়ে নিল গো । এতটুকু মায়া দয়া নেই । কিন্তু কি হল । পারলি না তো একটা রাতও কাটাতে । ভগবান দূত পাঠিয়ে ঠিক শাস্তি দিল তো । এজ্যেই বলে লোভে পাপ , পাপে মৃত্যু ।
কি একটা কাজে কদিন আগে ঐ পথ দিয়ে একবার যাবার দরকার হয়েছিল । তখন খালপাড়ের ঐ বাড়িট চোখে পড়িছিল । কেউ যে ওই বাড়িতে থাকে তা অবশ্য মনে হয়নি । নানা রকম দুষ্কর্ম করার উপযুক্ত জায়গা বটে । কিন্তু অসহায় মানুষের পাশে না থেকে তাদের শেষ সহায়টুকু আত্মসাৎ করার এ কি খেলায় মেতে উঠেছে যুব সমাজ ! যাদের হাত ধরে সমাজ  আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা তারা কোন পাঁকে ডুবে যাচ্ছে ! এই দুঃসময়ে এইরকম দিশাহীন ছেলেগুলোকে সঠিক দিশা কে দেখাবে । অন্ধকারের উৎস হতে আলোর দিকে হাত ধরে নিয়ে যাবে কে । নাকি সত্যিই ভগবানের দূত এসে  এভাবে শাস্তি দেবে তাদের !

Monday, November 25, 2019

অনুগল্প --- ভাত

                        অনুগল্প --- ভাত
                                  
মেয়েটি হাপাতে হাপাতে এসে দাঁড়ালো দরজায় ।
ম্যাম , আসবো ?
     আড়িপুর গ্রামের কাননদেবী উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে । পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে পনেরো মিনিট হল । পাঁচটি গ্রামের মধ্যে এই একটিই হাই স্কুল ।বর্তমান ডিজিটাল যুগেও যে এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে সোহিনীর তেমন ধারণা ছিল না । এখানে চাকরি নিয়ে এসে মাত্র ছয় - সাত মাসে কত অভিজ্ঞতা যে হচ্ছে ! বাইরের আলো হাওয়াও যেন এই গ্রামের মানুষগুলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । গরীবস্য গরীব এখানকার মানুষ । বিদ্যুৎ তো দূরের কথা পানীয় জলটুকু পাওয়া যে কি কঠিন এদের কাছে । পঞ্চায়েতের তরফ থেকে গ্রাম পিছু একটি করে টিউবয়েল বসিয়ে দিয়েছে । তার মধ্যে দুটো ইতিমধ্যেই খারাপ হয়ে পড়ে আছে । বাকিগুলোতেও পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায় না এখানকার ভৌগোলিক  কারনে । বর্ষা ঠিকঠাক হলে জলাশয়গুলিতে যাওবা একটু জল থাকে বাকি গরমকালটা খুব কষ্টে কাটাতে হয় ।সরকারী প্রকল্পগুলো সবে মাত্র পেতে শুরু করেছে  এরা। রুক্ষ মাটির বুক চিরে ফসল ফলানোর কঠোর পরিশ্রমে তারা দিনরাত ব্যায় করে । বিনিময়ে যে সামান্য ফসল পায় তাতে কোনোভাবে খাওয়াটুকু জোটে । বিদ্যালয়গুলি তাই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোর কাছে যতটা লেখাপড়ার জন্য আকর্ষনীয় তার চাইতে অনেক বেশী আকর্ষনীয় ভরপেট ভাতের জন্য এটুকু বুঝেছে সোহিনী । তাই  শুকনো মুখ আর রোগা রোগা হাত-পায়ের ছেলেমেয়েগুলোকে দেখলে বড় কষ্ট হয় তার । এক অব্যক্ত বেদনায় ছটফট করে সে । এত কষ্ট করেও মানুষগুলোর মধ্যে কোনো অভিযোগ নেই । যেন আজন্ম এইভাবে বেঁচে থাকার অঙ্গীকারে আবদ্ধ এরা ।কোনো কিছু চাওয়ার নেই , কোনো কিছু পাওয়ারও নেই ।
পরীক্ষার খাতায় সই করা থেকে পলক চোখ তুলে   ছোট্টো মেয়েটাকে দরজায় দেখে সোহিনী বলল , কি রে এত দেরি কেন ? পরীক্ষা তো কখন শুরু হয়ে গেছে । আয় আয় । কোন ক্লাস ? যা ওখানে বসে পড় ।
 
  পরীক্ষার খাতা আর প্রশ্নপত্র  এগিয়ে দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল সোহিনী , কোথায় বাড়ি তোর । এত দেরি করলি কেন । পরীক্ষার সময় টাইম মত স্কুলে আসতে হয় বুঝলি ।
শুকনো মুখে ছলছলে চোখদুটো তুলে কি যেন বলতে গেল মেয়েটি । ঠোঁটটা একটু কাঁপল শুধু , শব্দ বেরোলো না । সোহিনী মাথায় হাত দিতেই ফুঁফিয়ে উঠল মেয়েটি , তিন রাত আগে আমার বাবা মরে গেছে ।
তাও তুই পরীক্ষা দিতে এলি ? পিতৃহারা ছোটো মেয়েটির প্রতি সমানুভুতিতে তারও চোখে জল চলে এল ।
তিন দিন মা - দাদার সাথে আমিও কিছু খাই নি । তাই আজ ইস্কুলে এলাম । মেয়েটির চোখদুটো চকচক করে উঠল । আজ আমি পেট ভরে ভাত খাব ।

Friday, September 20, 2019

বালুকার'পরে কালের বেলায়

 বালুকার'পরে কালের বেলায়

    জানালার গ্রীলটা ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে রোদ আর বৃষ্টির খেলা দেখছিলাম । রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে যেন শক্তিপরীক্ষা চলছে । রোদের প্রচন্ড তেজ , অথচ মুষলধারে বৃষ্টি । পাশের বাড়ির কাকীমা জামাকাপড় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন । একবার রোদে দেন আর একবার তোলেন । সেইসঙ্গে চলছিল বৃষ্টির প্রতি অবিরাম গালি বর্ষণ । আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছিল । রোদের মনেও বোধহয় কিছুটা কৌতুকের ছাপ ছিল । তাই বৃষ্টিকে পরাজিত করার আনন্দে তার তেজ আরো বেড়ে যাচ্ছিল । আর অসহায় বৃষ্টি করুন শুষ্ক মুখে আবার নতুন করে বর্ষণ শুরু করলেও পৃথিবীর বুকের ওপর রোদের মত তার অধিকার যেন আর নেই । অনেক প্রত্যাশা নিয়েও বৃষ্টি কিছুতেই পৃথিবীর বুকে মুখ লুকিয়ে প্রাণভরে হাসতে পারছে না । প্রত্যেকবারই দুষ্টু রোদ পৃথিবীর কোল দখল করে নিচ্ছে ।
                আমাদের এক আত্মীয়ের কথা মনে পড়ল । আমার দূর সম্পর্কের কাকা হন । পাশাপাশি বাস করার ফলে সম্পর্কটা পুরানো হলেও হৃদ্যতার ঘাটতি ছিল না । কাকার বড় মেয়ে আমার চাইতে বছর কয়েকের ছোটো । তার যখন নয় বছর বয়স তখন তার একটি ফুটফুটে ভাইয়ের আবির্ভাব ঘটে । মায়ের মুখে শুনেছি দেবতার কাছে অনেক মানত , পুজো আর্চনা করে নাকি তারা এই বংশধরকে পেয়েছেন ।
              আমার ঐ কাকাতো বোনটি বেশ মেধাবী । স্কুলে সে বরাবর প্রথম হত । সকলেই তাকে ভালোবাসত । সারাদিন সে নিজের মনেই মগ্ন । নিজের বইখাতা , পুতুলের বাক্স নিয়েই তার দিন কাটে । তবে ভাইকে সে ভালোবাসত না তা নয় । খেলাঘরের একটি জ্যান্ত পুতুল মনে হত তার এই একরতি ভাইটিকে । যেন একটা কথা-বলা , হাত-পা নাড়া পুতুল । অনেকদিন ধরে বায়না করেও যা সে পায় নি ।
                 তবে সাধের এই ভাইকে সে কাছে পেত খুবই কম । কেননা তার মায়ের মনে হত ভাইকে দেখাশোনা করার মত বয়স তার হয়নি । মা কেমন করে জানবেন খেলাঘরের প্রতিটি পুতুলের সে বড়দিদি । তাদের নিয়ে আদরে বকুনিতে তার কত সময় কেটে যায় ।
                কথা-বলা , হাত -পা নাড়া পুতুলের অভাব পূর্ণ হত তার ভাই ঘুমোবার পর । তখন সে আপন ইচ্ছানুসারে কখনো ভাইকে পাউডার মাখিয়ে সাহেব বানাবার চেষ্টা করত , কখনো কপালে চন্দনের ফোটা দিয়ে বর সাজাতো । আবার কখনো নিজের হাতের চুরিগুলি ভায়ের হাতে পরিয়ে , চুপি চুপি পুতুলের বাক্স থেকে একটা টিপ নিয়ে পরিয়ে দিয়ে ভাবত --- আহা , ভাইকে যদি বৌ সাজানো যায় তো বেশ হয় ।কোনোদিন নিজের এই ভাবনার মাঝে শিশুর অচেতন মুখের হাসির রেখা ফুটে উঠত । আর ভাইয়ের সাথে নিজেকে মিলিয়ে সেও হাসতে থাকত । তার হাসির শব্দে এইসময় হয়ত ঘরে ঢুকতেন তার মা । আর ছেলের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাবার প্রয়াসে মেয়েকে বকাঝকা করে সারা হতেন । মেয়ের কল্পরাজ্যের ঘরকন্নায় এটুকু পুঁচকে ছেলেটার অবদান কতখানি তা তো তাঁর জানবার কথা নয় ।
                 গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে মাঠের ঐপাড়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা ছেলের ক্রিকেট খেলা দেখে আমার ছোটোবেলার একটা দিনের কথা মনে পড়ল । অনেক বছর আগে , আমি তখন বেশ ছোটো । এমনি এক বর্ষার দিনেই বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম তাঁর কাকার বাড়ি । আমার বাবার কাকা অর্থাৎ আমার দাদুর বাড়িটা তাঁতিপাড়া আর চাষিপাড়ার সন্ধিস্থলে । এখানে তাঁতিবাড়ির ছেলেমেয়েরা যেমন চাষীবাড়ির তকতকে ঝকঝকে করে লেপা শক্ত বুক টান করা উঠোনে খেলা করে , তেমনি চাষিবাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাঁতিবাড়ির তখনকার মত বাহুল্য হিসেবে পড়ে থাকা চরকা , টেকো , সুতো সহযোগে খেলা করে ।
     সেদিন আমি এদের সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এদের মধ্যে যেন দুটো আলাদা দল দেখতে পাচ্ছিলাম । একপাড়ার ছেলেমেয়েরা আর এক পাড়ায় এলে আগন্তুক ছেলেমেয়েদের অধিকার কিছুটা খর্ব হয় দেখেছিলাম । এর কারণ পাড়াগত ব্যবধান না জীবিকাগত  ব্যবধান তা বোঝার সাধ্য তখন আমার ছিল না ।
                

         এমনি একদিন খেলতে খেলতে প্রচন্ড রোদের পাশাপাশি ঝমঝম বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে আমি দৌড়ে উঠে গিয়েছিলাম বারান্দায় । সেখান থেকে দেখছিলাম ছেলেমেয়েগুলো আনন্দে হাততালি দিয়ে নাচছে আর ছড়া কাটছে ---- রোদ উঠেছে বৃষ্টি পড়ে / শেয়াল পন্ডিত বিয়ে করে ।

            সত্যিই এমন দিনে শেয়াল পন্ডিত বিয়ে করে কিনা তা আমার দেখা হয়নি কখনো । শুধু এই রোদভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ছবি আমার চোখে ভেসে উঠেছিল । মাথায় টোপর পড়া শেয়াল পন্ডিত হাতে ধুতির কোঁচা ধরে লেজ দুলিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে । কিন্তু কার সঙ্গে যে বিয়ে হচ্ছে সেটা জিজ্ঞাসা করার আগেই সরমা নামে একটি মেয়ে আমার হাত ধরে টেনে ওদের মাঝখানে নিয়ে গেল ----- ' এমা তুমি ওখানে কেন । এ বৃষ্টি বুঝি গায়ে লাগে ? '
           আমি কোনো উত্তর দেবার আগেই পাশের একটি ছেলে বলে উঠল ---- ' তুমি বুঝি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসো না ? '

     

            আমি কিছু একটা বলতে যাব তখনি শুনতে পেলাম ধেনোর বাবা আর চরকির বাবার আলাপ । ধেনোর বাবা আনন্দে গদগদ কন্ঠে চরকির বাবাকে বলছে , ---- ' এবারে ধান ভালো হবে দাদা । বৃষ্টিটা ঠিক সময়েই হচ্ছে । ' আর চরকির বাবার নিষ্প্রদীপ জবাব ---- ' তা ভাই তোমাদের তো এই বৃষ্টিটা ভালো । কিন্তু আমাদের সুতো কাপড় কিছুই যে শুকোয় না । হ্যারিকেনের তাপে , উনুনের আঁচে সেঁকে কি আর রোদে শুকোনোর মত শক্ত কাপড় পাওয়া যায় । '
             রোদ আর বৃষ্টির প্রেক্ষাপটে পর পর তিনটি দৃশ্য আমার চোখে ভেসে উঠল । একদিকে ধেনোর বাবার আনন্দে আপ্লুত মুখ , তার বিপরীতে চরকির বাবার উদাস বিরক্ত মুখ । আর খেলুড়ে ছেলেমেয়ের দল ।
             রোদের তেজ এখন কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে । ওর শক্তি যেন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে । নাকি মায়ের স্নেহ কচি বুকটাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে এরই মধ্যে । তাই পরিপূর্ণ হৃদয়ে এখন সে অন্য কোনো খেলার স্বাদ নিতে চাইছে ।
            দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো । বৃষ্টিটাও বেশ জাকিয়ে উঠেছে । এতক্ষণে খেয়াল হলো জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে আমার টেবিলের ওপর সযত্নে ভাঁজ করে রাখা শাড়িটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে । আমি তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে শাড়িটা খাটের ওপর ছড়িয়ে দিলাম ।
           নীচে বাবার গলার স্বর শুনতে পেলাম ----- ' এমন বর্ষার দিনে আর বাইরে বেরোব না , বেশ করে পেঁয়াজের ফুলুরি করো দেখি । গরম গরম । মুড়ি দিয়ে খাই । '

           ------ ' ওমা , মুড়ির কথা তো তোমাকে সকালেই বললাম । সকালে বাজার করে আনলে   মুড়ি এনেছো কি ?
            উত্তরে বাবা কি বললেন তা আর কানে এলো না ।

      আমার ঘরের দেওয়ালের ছবিটার দিকে চোখ গেলো । গত বছর রথের মেলা থেকে কিনেছিলাম । ছবিটাতে শিল্পীর নিপুন হাতে আঁকা কোনো এক অদৃশ্য শক্তির হাতে ঝুলন্ত একটা দাঁড়িপাল্লার একদিকে রয়েছে একজন নারী আর অপর দিকে রয়েছে একজন পুরুষ । হয়ত শিল্পীর মনে কখনো প্রশ্ন জেগেছিলো এই সংসারে নারী বড় না পুরুষ বড় ।
         আজ এই বর্ষার দিনে নির্জন ঘরে বসে আমার মনে হচ্ছে সংসারে নারী-পুরুষের স্থান অনেকটা চাঁদ-সূর্যের মত । রাতের নিবিড় অন্ধকার ছাড়া যেমন চাঁদের গুরুত্ব বোঝা যায় না ,তেমনি কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণে ক্লান্ত শ্রান্ত টলটলে জলেভরা পৃথিবীর গাম্ভীর্য যখন অসহ্য মনে হয় তখনি সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা সমস্ত প্রাণীকুলকে ব্যাকুল করে তোলে ।তবে মাঝে মাঝে এদের লুকোচুরি নতুন স্বাদের জন্ম দেয় ----- এটাই সত্য ।
             

Saturday, April 6, 2019

অনুগল্প --- মা

                             অনুগল্প --- মা  
                                       


  শর্মী আজ সাত বছরের হল । অন্যান্য বাচ্চাদের মত জন্মদিনে মায়ের হাতের পায়েস খাওয়ার সৌভাগ্য তার নেই । তার মায়ের মুখটা ছবি দেখা ছাড়া স্মৃতিতেও আসে না । কেননা জন্মের পর মাত্র কয়েকটা দিন সে তার মায়ের সান্নিধ্য পেয়েছে ।স্কুলের বন্ধুরা যখন তাদের মায়েদের কথা গল্প করে তার খুব মন খারাপ করে । তারও ইচ্ছে করে স্কুলে আসার সময় তার মা ব্যাগ গুছিয়ে , জামা পরিয়ে , চুল আঁচড়ে , চুমু খেয়ে , আদর করে দিক অন্যান্য বন্ধুদের মত । এই সময় তার খুব রাগ হয় ভগবানের ওপর । ভগবান তাকেই কেন এরকম একা করে মাকে তার কাছে ডেকে নিয়েছেন ।
            ******************************
     সকাল থেকেই খুব মন খারাপ শর্মীর । দিদা আজ কত আদর করে তাকে ঘুম থেকে তুলেছে । তার জন্য পায়েসও বানাবে বলেছে । কিন্তু মা যে মা-ই হয় । কতদিন হল বাবাও সেই যে গেছে আর আসেনি ।
     ব্রাশ হাতে নিয়েই বাগানে এসে দাঁড়ায় শর্মী । এখানে দোলনচাঁপা গাছটাতে সেবারে একটা দোলনা বেঁধে দিয়েছিল বাবা । এই জায়গাটা শর্মীর খুব প্রিয় । দিদা বলে এই দোলনচাঁপা গাছটা খুব পুরনো । তার মাও ছোটোবেলায় এই গাছটাতে দোল খেত । মায়ের খুব প্রিয় জায়গা ছিল এই গাছতলাটা । শর্মীর দুচোখ জলে ভরে এল । কেন , মা , আমি কি দুষ্টুমি করেছিলাম যে আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গেলে ।
         হঠাৎ এক ঠান্ডা হাওয়ায় শর্মীর মনের ভেতরটা কেমন করে উঠল । খুব আপন একটা গন্ধ , যেন অনেক কালের চেনা , মাতৃগর্ভের মত একটা অনুভূতিতে ভরে গেল তার মনটা । যেন কেউ পরম মমতায় তার গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে , তাকে আদর করছে । তার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেড়িয়ে এল --- মা !

Wednesday, April 3, 2019

অনুগল্প --- আগাছা

                         অনুগল্প --- আগাছা 
                                        

    সকাল সকাল কাজটা সারতে পেরে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে প্রতাপের । নিত্যদিনের এই অশান্তি আর ভালো লাগে না । তাই স্ত্রী রীনার জন্য এটুকু করতে পেরে বেশ ভালো লাগছে । এবার আর বাড়িতে কোনো অশান্তি নেই । শুধু সে আর রীনা আর অখন্ড শান্তি । 
        বৃদ্ধাশ্রমে মাকে রেখে নির্দিষ্ট ফর্মালিটিগুলো পূরণ করতে যতটুকু সময় লাগে তাড়াতাড়ি সেরে আর মায়ের দিকে ফিরে তাকালো না প্রতাপ , পাছে মায়ের চোখের জল তাকে দুর্বল করে দেয় । তার ভবিষ্যৎ সুখ কল্পনাতেই সে সুখি ।
          
              **************************


         ওদিকে প্রতাপের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই অসীমার একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে মিউনিসিপ্যালিটির ডাষ্টবিনের পাশে কতগুলি কুকুরকে একটা পুটুলি ঘিরে চীৎকার করতে দেখেছিল সে । খুব ভোরে উঠে ঠাকুরের জন্য ফুল তোলা নিত্যদিনের অভ্যাস অসীমার । সেদিন ফুল খুঁজতে এপথেই যাচ্ছিল সে । রাস্তা নির্জণ । কুকুরগুলোর আচরনে এমনকিছু ছিল যে অসীমা এড়িয়ে যেতে পারল না । কাছে যেতেই দিখতে পেল ছোট্ট একটা মুখ দুটো কচি কচি হাত । বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল তার । রাস্তায় যে এখন কেউ নেই । তিন তিনবার অন্তঃসত্বা হয়েও সন্তান কোলে নিতে পারেনি অসীমা । ডাক্তার বলেছিল কি এক কঠিন সমস্যা আছে তার । অনেকদিন ওষুধ খেতে হবে । খেয়েওছিল । কিন্তু ঈশ্বর বিরূপ । সন্তানের মা হওয়া তার আর হয়ে ওঠেনি । 
        তবে আজ ঈশ্বরের কি অভিপ্রায় । তিনি কি চান এভাবে অসীমাকে মাতৃত্বের স্বাদ দিতে । মনে মনে এ স্বাদের লোভ সামলাতে পারল না অসীমা । ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে কারো অনুপস্থিতিতে  ময়লা কাপড় ছাড়িয়ে তার আঁচল দিয়ে জড়িয়ে নেয় বাচ্চাটিকে । একছুটে বাড়ি এসে শিবুকে ঠেলে তুলে সমস্ত ঘটনা জানায় । তারপর সাত সকালে সেখানকার পাঠ চুকিয়ে নতুন ঠিকানায় । 
      তারপর কত উত্থানপতন শেষে নিজেরা আধপেটা খেয়েও প্রতাপকে নাড়ি ছেড়া ধনের মতই আগলে আগলে বড়ো করা । 
     আজ প্রতাপ বড়ো চাকরি করে । শিবু গত হয়েছে চার বছর হল । বিয়ে করতে না করতেই মা তার সংসারে আগাছা হয়ে উঠল । চোখের কোনটা ভিজে উঠল অসীমার । দুই হাত জোড় করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রর্থনা জানালো , ওদের ভালো রেখো ঠাকুর । মঙ্গল কোরো ।

Tuesday, February 12, 2019

মিথ্যে ভূতের কারসাজি

মিথ্যে ভূতের কারসাজি

সেদিন ছিল আমার ঠাকুরমার আদ্যশ্রাদ্ধ । দু'দিন ধরেই অনবরত বৃষ্টি হয়ে চলেছে ।

সেদিনটা রোদ না উঠলেও আকাশ মেঘলা করে ছিল ।আদ্যশ্রাদ্ধ সমাপন শেষে বাবা পুকুরপারের নিয়মকানুন শেষ করে স্নান সেরে যেইমাত্র ঘরে ঢুকেছেন , অমনি শুরু হল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি । তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া । একে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ , তার ওপর বাড়িতে সদ্য একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে । স্বভাবতই পরিবেশটা একটু ছমছমে হয়ে আছে । আত্মীয়-স্বজন যারা এসেছিল , তাদের মধ্যে দু'চারজন থেকে বাকি সকলেই বাড়ি ফিরে গেছেন । তাই বাড়িটাও মোটামুটি ফাঁকা । কয়েকদিনের ধকলে বাবা-মায়ের শরীরটা এমনিতেই অবসন্ন । আর আজ আমরাও ক্লান্ত । @ তাই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে সবাই শুয়ে পড়তে চাইল । আমার এক পিসি ছিল অন্তঃসত্বা । তার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ কাছকাছি হওয়ায় সবাই একটু চিন্তিতও ছিল । সেরাতে পিসিকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে আমরা মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনেরা শুয়েছিলাম একটাই ঘরে । সত্যি কথা বলতে কি এই পরিবেশে একা ঘরে থাকার সাহস কারো ছিল না ।


আলো নিভানের পর কিছুক্ষণ আমরা টুকটাক গল্পগাছা করে যে যার মত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙল আমার হাতের কব্জিতে প্রচন্ড চাপ অনুভব করে । আমার পিসতুতো দিদি খুব জোরে আমার হাতটা চেপে ধরে আছে । আমি ওর দিকে তাকালাম । দেখি ও চোখগুলোও চেপে বন্ধ করে আছে । দিদিকে ঠেলা দিতেই সে সভয়ে ' রাম রাম ' জপতে শুরু করেছে । @ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।উঠে লাইট জ্বালালাম । দিদি তাকিয়ে একবার চারদিক দেখল । বিশেষ করে জানালার দিকটা । দেখলাম জানালা বন্ধ আছে । ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল , ' কিসের যেন শব্দ হচ্ছিল । ' ' কই আমি তো কিছু শুনিনি । তুই ভুল শুনেছিস । ' বলে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে লাইট অফ করে আমি শুয়ে পড়লাম ।

ঘন্টাখানেক বোধহয় হয়নি আবার ঘুমটা ভেঙে গেল । বাবার গলার স্বর শুনতে পেলাম । সঙ্গে মায়েরও । তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম । পিসির প্রসববেদনা উঠেছে । @ এত রাতে । ভাগ্যিস হাসপাতালটা কাছেই আছে । বাবা আমাদের বাড়িতে থাকা দু'জন কর্মচারিকে ডেকে পিসি আর মাকে নিয়ে গেল হাসপাতালে । কখন ফিরবে ঠিক নেই । তাই আমি দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম । ঘড়িতে তখন 2-30 ।

বিছানায় শুয়ে ঘুম আর আসেনা । একে পিসির জন্য চিন্তা হচ্ছে , তার ওপর বাড়িতে বড়ো মানুষ বলতে আমার পিসতুতো দিদি , যে কিনা কিছুক্ষণ আগে রামনাম জপতে শুরু করেছিল । এপাশ - ওপাশ করছি । ঘুম আসছে না । দিদিরও দেখি একই অবস্থা । হঠাৎ জানালার দিক থেকে খুট করে একটা শব্দ হল । কিছু বুঝতে পারলাম না । দিদির দিকে তাকালাম । দিদিও দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । কিছু বোঝার আগেই শব্দটা বাড়তে লাগল । মনে হল কেউ জানালার ওপাশ থেকে কিছু দিয়ে জানালাটা খোলার চেষ্টা করছে । শব্দটা ক্রমে বেড়ে চলেছে । @ উঠে যে লাইটটা জ্বালাব সে সাহস হচ্ছে না । দুই বোনে দুজন দুজনকে জাপটে ধরে যেন সাহস সঞ্চয় করছি । বারবার মনে হচ্ছে মৃত ঠাকুমার কথা । দিদির মত আমিও ' রাম রাম ' করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি ।

ঘুম ভাঙল প্রবল ধাক্কায় । তাকিয়ে দেখি দিদি হাসি হাসি মুখ করে হাতদুটো পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । জিজ্ঞাসা করলাম , ' কি হয়েছে ' । হাসতে হাসতে বলল , ' পিসির ছেলে হয়েছে । ' তারপর মিটিমিটি হেসে বলল , ' আরো একটা খবর আছে । ' আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই পিছনের হাতদুটো সামনে এনে বলল , ' এই যে নারকেল । ' অবাক হয়ে দেখলাম নাড়কেলের মালাগুলো । কেউ এমনভাবে এগুলো খেয়েছে যে সেগুলো আর আমাদের খাবার পরিস্থিতি নেই । মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা । দিদি বলল , ' মামী কাল রাতে জানালার কাছে আধঢাকা করে এগুলো রেখেছিল । আর রাতভোর ইঁদুরবাবাজি দলবেঁধে মোচ্ছব করেছে । আর আমরা সারারাত রামনাম জপ করেছি । ' @  

কিছুটা ওর বলার ধরনে আর কিছুটা আমাদের নির্বুদ্ধিতায় দুজনেই হেসে ফেললাম ।

Sunday, December 30, 2018

গৌরচন্দ্রিকা - অন্তিম পর্ব

গৌরচন্দ্রিকা - অন্তিম পর্ব

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না । মুখ নীচু করে একটা আমপাতা নখ দিয়ে চিরতে লাগল । 
          - এভাবে যদি বিচার কর তবে বলত অনিমেষদা আমাদের কার চরিত্র ভালো ?
     অনিমেষ জিজ্ঞাসু চোখে শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে আছে । কি বলতে চায় মেয়েটা । শাশ্বতী বলে চলেছে ।
          - এই যে আমি এই দুপুর বেলা তোমার সাথে এই বাগানে বসে নির্জনে কথা বলছি । এখন তোমার মত কেউ যদি দেখে তবে তো আমার চরিত্র নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে । 
          - আহা তা কেন ।
অনিমেষের কথা হয়ত শাশ্বতীর কানেই পৌছয়নি ।
          - আমিও তো আমাদের অর্গানাইজেশনের কাজে কত ছেলেদের সাথে রাত নেই , দিন নেই ঘুরে বেড়াই । নানা কথা নিয়ে ওদের সাথে হাসি - তামাসা করি । আমার ব্যপারেও তোমরা এমনি ভাবো নিশ্চয় ।

শাশ্বতীর মনে পড়ে তার পিসতুতো দাদার কথা । গতকাল রাতে সিনেমাটা শেষ হলে সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন এরকম একটা কথা উঠেছিল নায়িকার চরিত্র নিয়ে । দাদা বলেছিল , দেখ সতী , আমাদের চরিত্রটা আসলে আপেক্ষিক । একপেষে দৃষ্টি নিয়ে আমরা চরিত্রের বিচার করি । একটা মানুষের সবটুকু আমরা দেখতে পাই না বা দেখি না । বলতে গেলে দেখার চেষ্টাও করি না । আর এজন্যই যত রাজ্যের কুৎসা , বদনামের সৃষ্টি করি । তুই নিজেকে দিয়ে বিচার কর দেখবি সেটা পরিস্কার হয়ে গেছে । সবকিছুর পিছনেই কারণ থাকে । মনে কর তোকে আদালতের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে । তোর চরিত্রের বিচার হচ্ছে । তুই তোর সপক্ষে  নিশ্চয় কারণ দেখাবি । এবং এটাই স্বাভাবিক । আর কার্য-কারন সম্পর্কের ভিত্তিতে তর্ক শেষপর্যন্ত যুক্তিতে উত্তীর্ণ হয় । আসলে আমাদের মধ্যে কিছু লোক আছে অন্যের খুঁত বের করাই এদের কাজ । নিজেদের খুঁত ধরে দাও , দেখবে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার কত কারণ দেখাবে । অথচ অন্যের ব্যপার ' বুঝব না ' বলে চুপ করে থাকে ।
শাশ্বতীর ধ্যানভঙ্গ হল অনিমেষের কথার আওয়াজে --- আসলে শুধু তাই নয় । আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও তাই বলল ।
        - পাশের বাড়ি ! অনিমেষদা , তুমি এতদিন ধরে যাকে দেখছ , ভালোবেসেছ তার সম্পর্কে শেষপর্যন্ত তোমার এই ধারনা । এত ঠুনকো তোমার প্রেম । আচ্ছা , কেউ যদি এসে বলে ভাই চিল তোমার কানটা নিয়ে গেল । তুমি কি চিলের পেছনে ছুটবে নাকি নিজের কানে হাত দিয়ে দেখবে কানটা স্বস্থানে আছে কিনা ।
            - কিন্তু সতী , অনেকের কথা যেখানে আছে , মানে অনেকে যেখানে বলছে ---
           - দেখ দাদা , সবার কথা আমি জানি না । সবাই তার কোন আচরণ দেখে তাকে চরিত্রহীনা বলছে আমি জানি না । তাদের কথা বাদ দাও । আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করছি তুমি নিজে কতখানি সৎ বুকে হাত দিয়ে বলত । যদি একটি ছেলের সাথে কথা বললেই একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায় তবে তুমি বলতো তুমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে কথা বলনি ? রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে টোয়েন্টিং করনি ?

অনিমেষ কখন উঠে বসেছে । অনিমেষ অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শাশ্বতীর দিকে । শাশ্বতী আজ ক্ষেপে উঠেছে । প্রতিবাদের প্রখর ঝড় তার চোখেমুখে। একোন শাশ্বতীকে দেখছে অনিমেষ । ছোট্ট মিষ্টি শান্ত যে মেয়েটির হাতে সে ছ-মাস আগে ভাইফোঁটা পড়ে গেছে  এ কি সে ! শাশ্বতীর মুখের সেই লাজুক ভাব যা সবসময় অনিমেষকে ছোট্ট বোন বলে মনে করিয়ে দিত এতো তা নয় ।
শাশ্বতীর কথা শুনে আজ অনিমেষের ক্লাশ সেভেনের ইতিহাসের দিদিমনির কথা মনে হচ্ছিল । তনিমা মিত্র ক্লাশে ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গিয়ে এরকমভাবেই কথা বলতেন । এরকমভাবেই তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে যেতেন । মুখে ফুটে উঠত করুণ বেদনা ।
শাশ্বতী কিন্তু নিজের কথাতেই মগ্ন - দেখ অনিমেষদা , তুমি যদি সত্যি ওকে ভালোবাস তবে ওর সাথে কথা বলো । ওকে বোঝার চেষ্টা করো । আশা করি তাহলে ওকে বুঝতে পারবে । তারপর যদি ওকে তেমন মনে হয় তুমি ব্যবস্থা নাও ।
আজ অনিমেষের আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে । সত্যি , মেয়েটা আজ অনিমেষকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করছে । 
          - কিরে দুজনে চুপচাপ করে বসে আছিস কেন । সরি , আমার একটু দেরি হয়ে গেল । 

প্রিয়তোষের কথায় প্রকৃতিস্থ হল দু'জনে । প্রিয়তোষ পকেট থেকে দুটো চকলেট বের করে ছুড়ে দিল মাদুরের ওপর  --- নে খা ।

কোকিলটা এখন আর ডাকছে না । হয়ত ওর সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে । কিংবা এখানে ওর সঙ্গী নেই বিবেচনা করে অন্য কোথাও চলে গেছে । বাগানের সামনের পুকুরটার দিকে চোখ গেল অনিমেষের । সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আছে জলে । একটু পড়েই সূর্য ডুবে যাবে । অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । তারপর আগামীকালের প্রতীক্ষা । তারপর আবার চারদিক আলো করে সূর্য উঠবে । শুরু হবে একটি নতুন দিনের ।

Friday, December 28, 2018

গৌরচন্দ্রিকা -- দ্বিতীয় পর্ব

গৌরচন্দ্রিকা -- দ্বিতীয় পর্ব

গতকাল দাদা এসেছিল । সারাদিন বেশ মজায় কেটেছে শাশ্বতীর । একটুকুও পড়া করা হয়নি । কিন্তু আজ যে অনিমেষদা আসছে । আর অনিমেষদা মানেই উৎসব । সকাল সকাল বাবা আজ বাজারে গেছেন । ভালো দেখে বড় দেখে মাছের মাথা আনতে হবে । পাগলটা এতদিন পর আসছে সবাই যেন বেশ খুশি । আজ যেন কারো কথা বলারও সময় নেই । নিঃশ্বাশ বন্ধ করে সব কাজ করে চলেছে । কানগুলো শুধু গেটের দিকে । গেটে শব্দ হলেই সব উৎকর্ণ হয়ে ওঠে ।
অনিমেষ যখন এল তখন শাশ্বতী বাথরুমে । চিৎকার হৈচৈ শুনে শাশ্বতীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল । সাওয়ারটা বন্ধ করে ভালো করে কান পেতে রইল । সকলের সমবেত চিৎকারে সবার কথাই হারিয়ে যাচ্ছে । কারো কথাই পরিস্কার বুঝতে পারা যাচ্ছে না । এই জনসমুদ্রের কূল ছাপিয়ে হঠাৎ শাশ্বতীর বাবার কথা স্পষ্ট হয়ে উঠল । 
            - দাঁড়াও , দাঁড়াও । ছেলেটা মাত্র এল । ওকে একটু বসতে দাও আগে । শাশ্বতীর বুঝতে আর বাকি নেই ।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর অনিমেষ আর প্রিয়তোষ শাশ্বতীর ঘরে গেল । 
               - চল সতী ঘুরে আসি ।
               - এখন ।
               - চল না বাগানে গিয়ে বসব ।
               - বেশ চলো । দাঁড়াও মাদুরটা নিয়ে আসি ।

শাশ্বতী একছুটে সিড়ির কোন থেকে মাদুরটা টেনে নিয়ে এল ।
একটা বড় আম গাছের নিচে মাদুরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল ওরা তিনজন । প্রিয়তোষ আর অনিমেষ নিজেদের ব্যবসার কথা আলোচনা করছিল । হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় ' ওহো আসছি দাঁড়া ' বলে বাড়ির ভেতর ছুটে গেল অনিমেষ ।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ থাকার পর অনিমেষ প্রথম কথা বলল 
             - কিরে তোর এবার কোন ইয়ার হল যেন ?
             - থার্ড ইয়ার ।
             - চাকদা কলেজ না ?
শাশ্বতী ছোট্ট করে একটু ঘাড় ঝাকালো ।
             - তা শুধু পড়াশোনাই করছিস নাকি প্রেমটেমও করছিস ?
শাশ্বতী যে এর কি জবাব দেবে ! 
অনিমেষদাটা যেন কি । একটা ঠান্ডা স্রোত হাওয়ার ঝলক এসে লাগল শাশ্বতীর চোখে মুখে ।একটু চুপ করে থেকে শাশ্বতী বলতে শুরু করল 
                -অনিমেষদা তুমি এবার একটা বিয়ে কর । ঘরে বউ এলে তোমার এই বাউন্ডুলে স্বভাব ঘুচে যাবে।  মাঝে মাঝে আর উধাও হয়ে যেতে পারবে না । 
               - বিয়ে করব , বেশ মেয়ে দেখ । 
               - মেয়ে দেখব কিগো । রমাই তো আছে । ওকে তো আমার বেশ লাগে । 
               - নারে , তা হবার নয় ।
               - হবার নয় , কেন ? ওর বাড়ি থেকে রাজি নয় ?
               - না , তা নয় ।
              - তবে ?
বাগানের কোথায় যেন একটা উদাসী কোকিল অনেকক্ষণ থেকে ডেকে যাচ্ছে । হয়ত ওর সঙ্গীকে খুঁজে পাচ্ছে না । থেকে থেকে হাওয়ায় ভর করে কোকিলের ডাক ওদেরও উদাস করে তুলছিল ।

অনিমেষদার চোখে মুখে একটা ব্যথার ছবি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল শাশ্বতী । মুখ নীচু করে অনিমেষ বলল - ওর চরিত্র ভালো না ।
             - চরিত্র ভালো না !
        
কথাটা গমগম করে শাশ্বতীর কানের মধ্যে বেজে উঠল । যেন সেতারের সাতটা তার একসাথে ছিঁড়ে গেল । শাশ্বতী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অনিমেষের মুখের দিকে ।
               - মানে ?
               - সেদিন রাত প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ আমি যখন ফিরছি তখন দেখি ওদের বাড়ির সামনের স্কুলের কোনাটায় দাঁড়িয়ে ও একটা ছেলের সাথে গল্প করছে । 
              

Thursday, December 27, 2018

গৌরচন্দ্রিকা -- প্রথম পর্ব

গৌরচন্দ্রিকা -- প্রথম পর্ব

ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি । ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা লাগে । আর ঘুমটাও এই সময়ই একটু জাঁকিয়ে আসে । কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও ঘুমোতে পারেনা শাশ্বতী । আজ তার পিসতুতো দাদা আসবে । এই দাদা শাশ্বতীর খুব প্রিয় । এই দাদা মানেই মজার মজার কথা , অনেক অনেক জায়গায় ঘোরা আর দারুন দারুন খাওয়া । তাই দাদার কথা শুনেই তার চোখ জ্বালা কমে যায় । ঘুম পালিয়ে যায় নির্ঘুম দেশে ।
আর কয়েকদিন পরেই দোল । পৃথিবীর বুকে ইতিমধ্যেই কিন্তু রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে । পলাশ শিমূলের বুকে যৌবনের আগুন জ্বলে উঠেছে । আম গাছের ডালে ডালে ফুটেছে মঞ্জরী ।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল - ক্রিং ক্রিং ক্রিং ....। ফোনের আওয়াজে শাশ্বতী আজ বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল । কেন ? রোজ তো কত ফোন আসে । কেউ তার বাবাকে চায় । কেউ পাশের বাড়ির সন্টুদা , রাজুকাকা বা তিতলিকে ডেকে দিতে অনুরোধ করে । আবার কখনো শাশ্বতীর বন্ধুরাও দরকারে ফোন করে । কিন্তু কখনো তো এমন হয়না । তবে কী শাশ্বতী আজ মনে মনে কারো প্রতীক্ষা করছে ?
বেশ কয়েকবার বাজার পর ফোনটা কেটে গেল । শাশ্বতী অপেক্ষা করে থাকে । নিশ্চয় আবায় বাজবে এখনি । ঠিক তাই । শাশ্বতী রিসিভার তুলে নিল - হ্যালো 
        - হ্যালো । আমি অনিমেষ বলছি । 
        - অনিমেষদা !

অনিমেষ শাশ্বতীর কাকাতো দাদা প্রিয়তোষের বন্ধু ।
এক জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রিয়দা ওকে নিয়ে এসেছিল । তখন ওরা বীরনগর না কোথায় থাকত । প্রথম আলাপেই অনিমেষের সাথে শাশ্বতীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল । অনিমেষের কোনো বোন নেই । একবার ভাইফোটার দিন হঠাৎ এসে হাজির । শাশ্বতী তখন তার ভায়েদের ফোটা দেবার ব্যবস্থা করছে । অনিমেষ এসে বসে পড়ল ভাইদের সাথে ।
          - জানি তো আমার জন্য কোনো ব্যবস্থা করিসনি । তাই আমি নিজেই নিয়ে এলাম । এই নে পান মিষ্টি । মা সব দিয়ে দিয়েছে ।
সেদিন সকলে এই সৃষ্টিছাড়া ছেলেটার কান্ড দেখে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল । আনন্দের দৌরাত্মে প্রিয়তোষ মানিব্যাগে যত টাকা ছিল সবটাই তুলে দিয়েছিল শাশ্বতীর ডালায় ।
তারপর সেই যে অনিমেষদা গেল প্রায় ছ-মাস পর আবার এই যোগোযোগ ।
      - কিরে কেমন আছিস ? কথা বলছিস না যে । খুব রাগ করেছিস বল । আচ্ছা আচ্ছা আর রাগ করতে হবে না । আমি কালই যাব বুঝলি ।  কাল সব কথা হবে । মাসীমাকে বলিস মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট রাঁধতে । মুড়িঘন্ট না পেলে কিন্তু তোকে পিটাবো । আচ্ছা রাখছি রে । ভালো থাকিস ।
শাশ্বতী কোনো কথা বলার আগেই ফোনটা খটাস করে রেখে দিল অনিমেষ । খুব রাগ হল শাশ্বতীর ।
অনেকদিন পর যদি ফোন করলে তো আমাকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই নিজের কথাটুকু  বলেই রেখে দিলে । অনিমেষদাটা এইরকমই ।
অভিমানের মধ্যেও শাশ্বতীর আনন্দ হচ্ছিল । কাল অনিমেষদা আসবে । ভারী মজা হবে ।

Thursday, November 29, 2018

গল্প - অপরাধ

অপরাধ

খবরটা ছড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি যতটা সময় লেগেছিল ঘটনাটা ঘটতে ।
বোনের ডাকে ধরফর করে উঠে বসে স্বপন । দুপুরের ভাতঘুমে স্বপ্নের আলপনাটুকু তখনও রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে । প্রথমটা বুঝে উঠতে না পারলেও দুর্ঘটনার বিদ্যুৎপ্রবাহ মুহুর্তে তাকে সচকিত করে তোলে । ঘুমভাঙা চোখ রগরাতে রগরাতে সে বাইরে এসে দাঁড়ায় । ইতিমধ্যেই বিশাল জনতার ছোট্ট ছোট্ট জটলা এখানে - সেখানে ।
- বয়সমাত্র চৈদ্দ - পনের । ক্লাশ নাইন । এখনি কি এমন ঘটল যে এমন কাজ করল ।
- বেশ শান্ত শিষ্টই তো । কখনো আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতেও দেখিনি ।
- পড়া পারেনি স্যারের কাছে । বাবার ভয়ে এমন কাজ করেছে ।
- আরে রাখো । ওপরে ওপরে ভদ্র । ভেতরে ভেতরে কি ছিল তা কে জানে ।
স্বপন কিছুই জানে না । শুধু জানে মানুষের মন বোঝা বড় দায় । কে যে কখন কোন কথায় আঘাত পেয়ে যায় বলা মুস্কিল । পাকা বয়সের দুর্দান্ত ছেলে হলে তবু কথা ছিল । কিন্তু এমন ভদ্র ছেলেটি ! কৌশিকের মায়ের কথা ভেবে স্বপনের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে । দীর্ঘদিনের পরিচিত সে ওদের বাড়ির সঙ্গে । ওদের দুটি ভাইকেই ও খুব ভালোবাসে । এখনও যেন ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছেনা স্বপন ।
                #                #                #
সকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করছে কৌশিক । আর বেশিদিন মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারছেনা ও । আলেয়ার গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতে গিয়ে বুকের মধ্যে যে ধুকপুকুনি শুরু হয় .....। আলেয়াকে বলা প্রয়োজন । কিন্তু কিভাবে বলবে সে । আলেয়া ক্লাশ ইলেভেন । সে ক্লাশ নাইন । জীবনের প্রথম প্রেম যে এমন অদ্ভুতভাবে আসবে তা কি সে জানত । কৌশিক জানে বাবা কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নেবেনা । হয়ত আলেয়াও ' পাগল ' বলে হেসে উড়িয়ে দেবে । নিজেকে কিছুতেই দমন করতে পারছে না কৌশিক । গতকাল রাহার্সালের পর আলেয়া যখন ওর কাছে এসে দাঁড়াল ' সাবাস ' বলে পিঠ চাপড়ে দিল কৌশিকের মনে হল কে যেন এক বালতি বরফ-জল তার গায়ে ঢেলে দিল ।
সন্ধ্যেবেলা পড়তে গিয়েও মনের মধ্যে এই হীমশীতল স্পর্শটুকু অনুভব করছিল কৌশিক । স্যার যখন ' নিউরণ ' বোঝাচ্ছেন তখন সে একমনে আলেয়ার খুশি - উজ্জ্বল মুখটা ভেবে যাচ্ছে । ভাবতেও কত সুখ । হঠাৎ গোকুলের ধাক্কায় তার চৈতন্য ফিরে আসে । স্যারের শ্যেণদৃষ্টির সামনে মুহুর্তে আলেয়ার মুখটা বিলীন হয়ে যায় । অবশ্য স্যার তেমন কিছু বলেননি ।তাঁর না বলা চোখে অনেক কিছু পড়ে ফেলেছে কৌশিক । মুহুর্তে সচেতন হয়েছে সে ।
তবু দ্বিতীয় ও মারাত্মক ভুলটা এর পড়েই করে বসেছিল কৌশিক । কাজ করতে দিয়ে স্যার বাইরে গেছেন । সবই জানা প্রশ্ন । অসুবিধা নেই । আনন্দে আবার আলেয়ার মুখটা মনে পড়ল কৌশিকের । হাতের কলমটা খাতা ছেড়ে বেঞ্চের ওপর দাগ কাটছে তখন । স্যার ফিরে এসেছেন । সবার খাতা একে একে জমা নিয়ে কৌশিকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন । কৌশিকের কোনো খেয়াল নেই । বেঞ্চের ওপর তখন লাল কালিতে একটা নাম স্পষ্ট ফুটে উঠেছে -- আলেয়া ।
একটা সজোর চপেটাঘাতে সম্বিত ফেরে কৌশিকের । এতক্ষণে ঘটনার গুরুত্ব সে উপলব্ধি করতে পেরেছে । ততক্ষণে কৌশিকের বই খাতা হাতে তুলে নিয়েছেন স্যার । এখন শুধু আঙুল তুলে দরজাটা দেখিয়ে বললেন -- বেরিয়ে যাও ।
কৌশিক জানে স্যারের কাছে আজকের ভুলের কোনো ক্ষমা নেই । কয়েকদিন ধরেই ওর অন্যমনষ্কভাব স্যার ঠিক লক্ষ্য করেছেন ।
মনের মধ্যে তুমুল ঝড় নিয়ে আবার স্যারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় কৌশিক - আর কখনো হবে না স্যার ।
- তোমার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলতে চাই না । তোমার বাবাকে আমার সাথে কথা বলতে বলবে ।
সারারাতের অনিদ্রায় কালিপড়া বসে যাওয়া চোখ নিয়ে ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়েছিল কৌশিক ।আজ কোনো এক রাজনৈতিক দলের আহ্বানে চব্বিশ ঘন্টার বাংলা বন্ধ । বাবা বাড়িতে থাকবে । বাজারে যাবে । কৌশিকের পড়াশুনার খবর জানতে যদি স্যারের বাড়িও যায় । কোথায় পালাবে কৌশিক । পৃথিবীটা বড্ড ছোট বলে মনে হয় তার ।
সামনের মাঠে কয়েকজন নাড়ীপুরুষ মর্ণিংওয়াক করছে । অবশিষ্ট পৃথিবী এখনো শেষরাতের নিদ্রাসুখটুকু উপভোগ করছে । কৌশিকের জগৎ শুধু একঘরে । এখানে ক্ষমা নেই । ভালোবাসা নেই । আর ভাবতে পারছে না কৌশিক । এই চৌদ্দ - পনের বয়সেই সে যেন পৃথিবীর প্রাচীনতম সদস্য হয়ে উঠেছে । চোখের উপর দিকটা অসম্ভব যন্ত্রনা হচ্ছে । মাথার মধ্যে শিরা উপশিরার তান্ডব চলছে যেন । এক্ষুনি হয়ত একটা পটাশ করে ছিড়ে যাবে হয়ত । এক্ষুনি যদি একটা ভয়ানক বাজ পড়ে কিংবা প্রবল ভূমিকম্পে ওদের বাড়িটা মিলিয়ে যায় মাটির নীচে -- কৌশিক যেন বেঁচে যায় ।
দুঘন্টা কেটে গেল । তেমন কোনো অঘটন ঘটল না । বাবা সকালের কাজ সেরে চায়ের কাপ হাতে টিভিতে খবর শুনছে । মা গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত । দাদু-ঠাকুমা , কাকা-কাকীমা কারো কোনোদিকে নজর নেই । সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত । আজ আর ভায়ের কাছে গিয়ে খুনশুটি করল না কৌ‌শিক । গামছা নিয়ে নিজের শীর্ণ মুখটা লুকোতেই হয়ত এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে । মা ভাবছে ছেলে আজ কত ভোরে উঠে পড়া করে নিয়েছে । সত্যি ! সন্তান ভাগ্য তার ।

নিজের ঘরে টেবিলে বই নিয়ে বসেছে কৌশিক । বাবা বাজারের ব্যাগটা খুঁজছে । ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে টেনে এনে ঘরের মধ্যে আটকে রাখে ।মুখটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল কৌশিক -- আজ তো বাজারও বন্ধ্ বাবা ।
--যাই । টুকটাক কি আর খোলা থাকবে না । তাছাড়া বাজারের একটু হালহাকিকৎও জানা যাবে ।
যদি স্যারও এইমুহুর্তে বাজারের হালহাকিকৎ জানতে আসেন ! মুহুর্তে ছুটে যায় মার কাছে । মার এখন যে মরারও সময় নেই । ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না মা । কি করবে এখন কৌশিক । একবার দাদুর ঘরে গেল । দাদু এখনো বিছানায় । দাদুর কাছে গিয়ে একটু দাঁড়াল কৌশিক । ওষুধের অ্যাকশন শেষ হতে এখনো আধ ঘন্টা বাকি । এখন দাদুর ঘুম ভাঙ্গানো বারণ । গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় কৌশিক । বাবা এখনো তো আসছে না । তবে কি ....
একটা গোটা মুরগি নিয়ে ফিরে এসেছে বাবা । নাহ্ । মুখটা দেখে বেশ ভালোই মনে হচ্ছে কৌশিকের । কিছুক্ষণ পর বাবার ডাকে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে কৌশিক । না ! এ স্বরে কোনো ভয় নেই । স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল কৌশিক ।

দুপুরে মুরগির ঝোলটা খুব ভালো রান্না করেছিল মা । তবু বাবার পাশে বসে গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইছিল না কৌশিকের ।
মুরগির গলাটা নিয়ে ভাই বলছিল , দেখ দাদা , আমাদের গলাটাও এমনি , না ? গলায় হাত বোলায় কৌশিক । মুখ দিয়ে স্বর বের হয় না । ছোট্ট করে মাথাটা ঝাঁকায় শুধু ।
খাওয়া দাওয়ার পর একবার বের হয় কৌশিক । বন্ধুদের সাথে একটু কথা বললে যদি ভালো লাগে । রমেশ , সমর , সৌগত ,সমরেশ একে একে সবার সাথে দেখা হয় । না । ওরা বোধহয় এ ব্যাপারে কিছু জানে না । একটু হাল্কা লাগে মনটা । কৌশিক বাড়ি ফেরে ।
বাড়িতে ঢোকার মুহুর্তে গোকুলের সাথে দেখা । -- 
একটু এদিকে আয় কৌশিক ।

-- কি হয়েছে ? বুকের মধ্যে দুমদুম দামামাটা আবার বেজে ওঠে ।
-- স্যার বিকেলে হয়ত তোদের বাড়ি আসবেন ।
কৌশিকের ফর্সামুখটা মুহুর্তে ছাইবর্ণ হয়ে যায় । বাবার মুখটা একবার মনে পড়ে । আর উপায় নেই । গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায় কৌশিক ।
মন্থর পায়ে ঘরে ঢোকে কৌশিক । ভালো করে খেয়াল করলে ওর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে তার আঁচটা হয়ত বোঝা যেত । কিন্তু কে বুঝবে । মা ভাইকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে । বাবা কোথায় কে জানে । প্রাণপনে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে কৌশিক । মার পাশটাতে গিয়ে শোয় -- মা ... ।গলায় জোর পায়না কৌশিক । বাইরের জানালা দিয়ে বাবা টিভি দেখছে ।
মুহুর্তে ডিসিশন নেওয়া হয়ে যায় কৌশিকের । ধীর পায়ে বাইরে আসে ।
-- ভালো সিনেমা হচ্ছে বাবা । যাও না ভেতরে গিয়ে বসে দেখ ।
-- তুইকোথায় যাচ্ছিস ।
-- বাথরুমে ।
একবার পেছন ফিরে দেখে নেয় কৌশিক । না । বাবা নেই । গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠতে থাকে । ছাদে উঠতে যে এতগুলো সিড়ি টপকাতে হয় আজই যেন প্রথম খেয়াল করল কৌশিক ।
ঐতো মায়ের একটা শাড়ি মেলা রয়েছে । কোনার দিকে মইটাও আছে । চিলেকোঠার চালটা সেদিন লাগানো হয়েছে । যথেষ্ট মজবুত । টিনের ফাঁকে একটা মোটা দড়ি অনায়াসে গলে যেতে পারে । দড়ির বাঁধনটাও সে জানে ।
মা যখন ভাইকে নিয়ে ঘুমে কাঁদা , বাবা যখন সিনেমা দেখায় মগ্ন , যখন চারিদিকে দুপুরের নৈঃশব্দ -- কৌশিক তখন সকলের মায়া কাটিয়ে পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে । মুহুর্তে ফুরিয়ে যায় চৌদ্দ - পনের বছর বয়সের তরতাজা জীবনটা ।
চূড়ান্ত অপরাধের সামান্য প্রায়শ্চিত্ত করে যায় কৌশিক ।

Saturday, October 27, 2018

চিঠি - অন্তিম পর্ব

চিঠি - অন্তিম পর্ব

চিঠিটা একটা প্রেমপত্র । জানতে পারলাম দিদির কাকার বাড়ির পাশে এই বিনয়ের বাড়ি । কাজকর্ম ভালোই করে । আর দেখতেও মন্দ নয় । সব মিলিয়ে দিদির কাছে বেশ লাগে । বিনয় অনেকদিন ধরেই দিদিকে আভাসে ইঙ্গিতে ওর মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে । কিন্তু দিদি কখনো সাড়া দেয়নি । যদিও এখন বুঝতে পাচ্ছিলাম দিদি কেন এত ঘন ঘন কাকার বাড়ি যেতে চাইত । কিছুদিন পর দিদি আরেকটা প্রেমপত্র আর একটা ছবি দেখালো । বুঝলাম ছবিটা বিনয়বাবুর ।
এদিকে সুহানীদির মা আমার বাবাকে অনেকদিন ধরেই দিদির বিয়ের ব্যবস্থার কথা বলছিলেন । বাবাও পাত্র খুঁজতে লাগলেন । এই অবস্থায় একদিন আমি স্কুল থেকে ফিরলে দিদি ম্লান মুখে আমার ঘরে এসে দাঁড়াল । বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে । 
- কি হয়েছেরে দিদি । দিদি আমার দিকে তাকিয়েই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল । চোখদুটো বেশ ফোলা । আগেও হয়ত কেঁদেছে । 
- আমায় কাল দেখতে আসবে ।
- কে !
- চাকদা না কোথা থেকে ।
- তো ....
- আমি বিধয়কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না । তুই বল না তোর বাবাকে ।
- আ - আমি !
আমি জানতাম দিদির সাথি হিসাবে আমি যতই বড় হই না কেন বাবার কাছে এধরনের কথা বলা আদৌ সম্ভব নয় ।কিন্তু দিদি এখন কি করবে ।

আমার নিরুত্তর মুখ দেখে দিদি আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেল । তারপর বলতে লাগল - আমার কপালটাই খারাপ । ছোটবেলায় বাবাকে হারালাম ।বাবার ভালোবাসা কি জিনিস জানিনা । বড় হয়ে যাও বা একজনকে ভালোবাসলাম তাও কপালে টিকল না । ..... যাকগে । চল খাবি চল ।
চাবি দেওয়া পুতুলের মত আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম । মনের ভিতর খচখচ করতে লাগল । কিন্তু কি করতে পারি আমি ।
পরদিন আমি যখন স্কুলে যাব তখন দিদি লুকিয়ে আমার হাতে একটা ইনভেলপ খাম দিল - চিঠিটা পোষ্ট করে দিস । দিদির মুখটা খুব শুকনো লাগছিল । চোখদুটো লাল । মাথার চুল উসকো-খুসকো । দিদিকে আশ্বাস দেবার মত ভাষা আমার ছিল না । নীরবে শুধু মাথা নাড়লাম ।
রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম । আর দিদির কথা ভাবছিলাম । কখন যে পোষ্ট অফিস পেড়িয়ে এসেছি খেয়ালই নেই । খেয়াল হল স্কুলের গেটের সামনে এসে । ফেরার সময় পোষ্ট করে দেব ভেবে ব্যাগে মলাট দেবার জন্য যে খবরের কাগজটা আমি বেছে রেখেছিলাম পুরোনো কাগজগুলোর মধ্যে থেকে তার ভিতরে রেখে দিলাম ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মলাট দেবার জন্য সেই খবরের কাগজটা আর ব্যবহার করা হয়নি ।আর চিঠিটাও তার মধ্যেই থেকে গেছে । যদিও দিদিকে যখনই দেখেছি অপরাধবোধে পীড়িত হয়েছি । আর প্রতিজ্ঞা করেছি কালই স্কুলে যাবার সময় চিঠিটা পোষ্ট করে দেব । কিন্তু ঐ পর্যন্তই । চিঠিটা যে আর পোষ্ট করা হয়নি সুদীর্ঘ সাত বছর পর তার সাক্ষ্য মিলল ।
চাকদার সেই ছেলেটির সঙ্গেই সুহানীদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে আজ প্রায় সাত বছর হল । দুই মেয়ে স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছে দিদি । বিনয়কৃষ্ণর কথা ওর মনে আছে কিনা জানিনা । কিন্তু ওর প্রেমের পাখির একটা পালক আমার কাছে গোপনে রয়ে গেছে - এটা সে জানতেও পারল না । জানলে হয়ত আমাকে কখনো ক্ষমা করত না কিংবা হয়ত কিছুই হত না ।

সমাপ্ত 

Thursday, October 25, 2018

চিঠি - তৃতীয় পর্ব

চিঠি - তৃতীয় পর্ব

না , বাবা সেদিন ফিরেছিলেন না । পরদিন দুপুর প্রায় দুটো নাগাদ বাবা ফিরেছিলেন । সেদিনটা কোনো একটা পর্ব উপলক্ষ্যে স্কুল ছুটি ছিল । আমি দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘরেই ছিলাম । বাবর ডাকে একছুটে বাইরে এসে দাঁড়ালাম । কিন্তু বাবার সাথে ঐ মেয়েটি কে ? ইতিমধ্যে বাবা আমার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে । আমিও আনন্দে নাচতে নাচতে ঘরে ঢুকলাম ।
পরে জেনেছিলাম ঐ মেয়েটি আমার বাবার কেমন সম্পর্কের ভাগ্নী হয় ।  আমার থেকে বছর পাঁচ সাতেকের বড় হবে । রঙটা ফর্সার দিকেই । দেখতে খুব সুন্দর না হলেও খারাপ নয় । কয়েকদিনের মধ্যেই ওর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল ।
শান্তিপুরে সুহানীদির এক কাকা থাকতেন । দিদি এখানে আসার পর কাকা প্রায়ই এসে ওকে নিয়ে যেতেন । এভাবে বছর পাঁচ সাত কেটে গেল । এখন দিদি দেখতে আরো সুন্দরী হয়েছে । যৌবনের পরশে তার দেহ মন সতেজ সরস । আমিও তখন কিশোরী লাজুক লতা । কাজেই দিদির সাথে আমার হৃদ্যতা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে ।
আগেই বলেছি শান্তিপুরে দিদির কাকার বাড়িতে দিদি মাঝে মাঝেই বেড়াতে যেত । ইদানিং দিদি দুদিন পরপরই আমাকে কাকার বাড়ির কথা বলতে লাগল ।
এরকম বেশ কিছুদিন চলার পর একদিন কাকার বাড়ি থেকে ঘুরে এসে দিদি আমার কানে কানে বলল - একটা জিনিস দেখবি ?
- কি জিনিস ?
- এদিকে আয় । আমার হাত ধরে টানতে টানতেআমার পড়ার ঘরে নিয়ে গেল । হাতে ওর পার্সটা । ঘরে ঢুকে প্রথমে দরজার পর্দাটা ভালো করে টেনে দিল । মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে পার্সটা খুলে আমার হাতে ভাজ করা একটা কাগজ দিয়ে রহস্যজনকভাবে হাসতে লাগল । 
- কি এ ?
- খুলে দেখনা ।

আগ্রহের আতিশয্যে ভাঁজ খুলে ফেললাম । একটা চিঠি । দিদির নামে । ইতি - বিনয় । 
- বিনয় কে ?
-  আঃ পড়ে দেখনা ।

আমি রূদ্ধশ্বাসে চিঠিটা পড়তে লাগলাম । দিদি তখন আমার টেবিলক্লথের কোনাটা আঙুলে জড়াচ্ছে আর খুলছে । মুখটা ভারী অদ্ভুত । দিদির এরকম মুখ আমি আগে কখনো দেখিনি ।

চিঠি - দ্বিতীয় পর্ব

চিঠি - দ্বিতীয় পর্ব


আজো সবই ঠিক ছিল ।শুধু বাবা তার জায়গাটিতে নেই দেখে বাবার কথা মনে পড়ল সারাদিন পর ।
- মা , বাবা কখন আসবে ?
- দেখ - এই ট্রেনে হয়ত আসতে পারে ।
- এই ট্রেন কটায় মা ?
- সাড়ে সাতটা মনে হয় ।
- এখন কটা বাজে মা ?
- সাতটা দশ । সারে সাতটা বাজতে আর কুড়ি মিনিট বাকি আছে ।
- ওঃ কুড়ি মিনিট কতক্ষণে হবে ।
- জানিনা - যা - শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন ।

অগত্যা মার ধমক খেয়ে আবার স্বস্থানে ফিরে এলাম । আর অপেক্ষা করতে লাগলাম সাড়ে সাতটা বাজার ।
...... কতক্ষণ হয়ে গেল । এখনো কি সাড়ে সাতটা বাজে নি । বাব্বা সাড়ে সাতটা বাজতে এতক্ষণ লাগে । আমার মনে হচ্ছিল সেদিন সাড়ে সাতটা বাজতে যে সময় লেগেছিল ততক্ষণে বোধহয় পৃথিবীটা ধীরে সুস্থে এক পাক ঘুরে আসতে পারবে ।
যাই হোক সেদিন ঘড়ির নিয়মেই সাড়ে সাতটার ঘন্টা পড়ল । মনটা ছটফটিয়ে উঠল । পড়ায় মন বসছে না । বাবা আমার জন্য কি কি আনতে পারে মনে মনে তার একটা লিষ্ট করতে লাগলাম । বারবার মনে হচ্ছে বাবা বোধহয় এক্ষুনি এসে পড়বে । কিন্তু না । অনেকক্ষণ হয়ে গেল বাবা এল না । আমি ভয়ে ভয়ে মার কাছে গেলাম ।
- কৈ সাড়ে সাতটা তো বেজে গেল ।
- কি জানি হয়ত এই ট্রেনে আসে নি ।

মনটা খারাপ হয়ে গেল । বইয়ের সামনে এসে বসলাম । বইয়ের দিকে যে তাকাতে ইচ্ছে করছিল না সেটা বলাই বাহুল্য ।
কি আর করব । স্কুলের কিছু কাজ ছিল সেগুলো সেরে শুয়ে পড়লাম । মাকে বললাম বাবা এলে একসাথে খাব ।
ঘুমিয়ে পড়লে কোনোদিনই মার ডাকে জেগে উঠে আমি রাতের খাবার খাইনি ।বাবাই আদর করে তুলে খাওয়াতো ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে পেটে বেশ ক্ষিদে অনুভব করলাম ।বুঝলাম রাতে খাওয়া হয়নি । তবে কি বাবা রাতে ফেরেনি ?

Wednesday, October 24, 2018

চিঠি - প্রথম পর্ব

চিঠি - প্রথম পর্ব

পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি আছে ....
পুরনো বই খাতা বিক্রি ......

এই যে বই খাতা বিক্রি .... এদিকে এস ....
বই খাতা নয় । গত বছরের পুরনো খবরের কাগজগুলো জমে আছে । গতকাল ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে সেগুলো সব বার করা হয়েছে । এখন শুধু বিক্রির অপেক্ষা ।
কাগজগুলো আনতে গিয়ে নীচের কাগজটা হাত থেকে পড়ে গেল । বাকিগুলো কাগজওয়ালার কাছে দিয়ে এলাম । পড়ে যাওয়া কাগজটা নিয়ে যাচ্ছি - মাঝখানটা মোটা মোটা লাগল । খুলে দেখি ইনভেলপ খামে লেখা একটা চিঠি । চিঠির মুখটা এখনো খোলা হয়নি । ঠিকানা শান্তিপুরের ।  কোন এক বিনয়কৃষ্ণ মজুমদারের শিরোনামে । প্রেরকের নাম সুহানী কর্মকার - আমার দূর সম্পর্কের এক দিদি ।
আমি তখন বেশ ছোট । একদিন সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসে মনে পড়ল সারাদিন তো বাবাকে দেখিনি । তাই তো । বাবা কোথায় গেছে । ছুটে মার কাছে গেলাম -
         - মা বাবা কোথায় ?
         - কলকাতা গেছে ।
         - কখন ?
         - সকালে ।

মনে পড়ল ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখিনি । সকালে প্রতিদিনই আমাকে পড়তে যেতে হয় বাড়ির সামনের মাঠটা পেড়িয়ে কাজলদিদির কাছে । যথারীতি পড়ে এসে স্নান খাওয়া করে স্কুল । তারপর স্কুল থেকে ফিরতে না ফিরতেই গেটের সামনে অপেক্ষা করে থাকে আমার খেলার সাথিরা । আমিও কোনোরকমে একটু খেয়েই ছুটি মাঠে । মাঠ থেকে ফিরতে  ফিরতে সেই সন্ধ্যা । কাজেই এর মধ্যে কে বাড়িতে আছে না আছে তার দিকে লক্ষ্য থাকে না । পড়তে বসলেই মনে পড়ে । কেননা তখন বইয়ের তুলনায় সারাদিনে ঘটে যাওয়া ছোটবড় ঘটনাগুলো মনের কোনে ভীড় করে বেশি । আর পড়তে বসে এসব কাহিনী উপকাহিনী শোনাবার প্রকৃষ্ট মানুষ হল আমার বাবা । বলাই বাহুল্য পড়ার থেকে আমাদের গল্প হত বেশি । তারপর যখন ঘুমে ঢলে পড়তাম তখন মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলত - সারাদিন এত ধকল কি শরীর নিতে পারে চল চল খেয়ে ঘুমিয়ে পড় ।

Wednesday, October 17, 2018

মেয়েবেলার গল্প

মেয়েবেলার গল্প
একটু যাই না মা । কি হবে গেলে । আমি কি তবে এবার ঠাকুরও দেখতে পাবনা ।
অনুসূয়ার মুখটা গম্ভীর হয়ে ওঠে । অধৈর্য হয়ে বলে , আর কতবার বলব মানু । পুজো হয়ে যাক বাইরে থেকে দেখবি । ঠাকুরের কাছে যাবি না । কাওকে ছুঁবিনা ।
মনটাকে কিছুতেই মানাতে পারেনা টিয়া । ওর বন্ধুরা বারবার ডাকতে আসছে পুজোমন্ডপে যাবার জন্য । কিন্তু মায়ের কড়া নির্দেশ এসব হলে ঠাকুর ঘরে যাওয়া বা যারা ঠাকুরের কাজ করে তাদের ছোঁয়া যাবে না ।
তের বছর বয়স টিয়ার । বড় হয়ে উঠছে সে । মহিলা হয়ে ওঠার প্রথম ধাপে পা দিয়েছে সে । আজ দ্বিতীয় দিন । একটা শারীরিক প্রক্রিয়া তার ছোটোবেলাটাকে এক নিমেষে দূরে সরিয়ে দিয়েছে । প্রতিবছর প্যান্ডেলে বাঁশ ফেলা থেকে খেলা শুরু হয় সেখানে । বাঁশ বাঁধার পর বাঁশের উপরে উঠে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মজাই আলাদা । তারপর একটু একটু করে প্যান্ডেলে কাপড় লাগানো হয় । ঠক ঠক করে পেরেক ঠোকার শব্দ কানে গেলে আর ঘরে থাকা যায় না । স্কুল থেকে ফিরে কখন প্যান্ডেলে যাবে সব সময় সেটাই মন তোলপার করে । স্কুলে গেলেই কি পড়ায় মন থাকে । মন তো পড়ে থাকে প্যান্ডেলে । তারপর ঠাকুর আনা । কত কসরৎ করে বড়োরা সেই ঠাকুর মন্ডপে তোলে । এই ধর ধর , এদিকে একটু কাৎ করে , আরে মাথা বাঁচিয়ে , নীচু কর নীচু কর । ওঃ সে যে কি উত্তেজনা সে আর কাকে বোঝাবে টিয়া । চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে অঝোর ধারে ।
রাগ হচ্ছে খুব । কেন এসব হয় । বন্ধুরা সবাই কত মজা করছে । প্যান্ডেলে পুজোর ঢাক বাজছে । অঞ্জলিও দিতে দেবে না মা । বাবাটাও যেন কেমন হয়ে গেছে । অন্য সময় তো যত অন্যায় ই করি না কেন বাবা ঠিক মার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় । আর আজ সেও মার সাথে এক ই কথা বলছে । দুর্গাঠাকুর তুমি কিছু করতে পার না ।
অনুসূয়ার মনটাওভালো নেই । সত্যি তো । এটা একটা শারীরিক প্রক্রিয়া । এর সাথে পুজো আচারের কি সম্পর্ক । মানুষের মল মূত্র ত্যাগের মত এটাও একটা স্বাভাবিক ঘটনা । যত বাধা শুধু মেয়েদের বেলায় । বিজ্ঞান কত উন্নত হয়েছে । মেয়েরা কি না করছে । চাঁদ সূর্য তারা কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে মেয়েরা । আর আমরা ছাপোষা মানুষগুলো এসব সংস্কারকে আঁকড়ে ধরে বসে আছি ।এত বছর ধরে চলে আসা সংস্কারকে ঠেলে সরাতে পারছি কই । বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে অনুসূয়ার ।
কইরে টিয়া তাড়াতাড়ি রেডি হয়েনে মা । প্যান্ডেলে যাবিনা । হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর এসে ঢোকে টিয়ার বাবা । পিছন পিছন টিয়ার বন্ধুরা । অনুসূয়া টিয়া দুজনেই অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকায় ।
আরে হা করে দাঁড়িয়ে আছে দেখ । প্যান্ডেলে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে কাল থেকে । রিহার্সাল দিতে হবে না । তোর তো অনেক নাচ আর আবৃত্তি তোলা আছে । এদের নিয়ে রিহার্সাল করে নে । তিন দিনে কিভাবে কিভাবে অনুষ্ঠান নামাবি সেটা ঠিক করে নে । রবীনকাকু একটু পড়ে আসবে তোর সাথে কথা বলতে ।
অনুষ্ঠানের কথায় আর বন্ধুদের কাছে পেয়ে টিয়ার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে । সবাইকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যায় টিয়া । একটা জম্পেষ অনুষ্ঠানের ছক কষতে হবে ।
অনুসূয়া মনে মনে ঠাকুরকে প্রণাম জানাল । মেয়েটা মন খারাপ না করে এসব নিয়ে মেতে তো থাকতে পারবে কটা দিন । তবে মনে মনে ঠিক ই বুঝল মেয়ে অন্তপ্রাণ টিয়ার বাবারই কারসাজি এসব । যাতে পুজোর দিনকটা একমাত্র মেয়েটার ম্লান মুখটা না দেখতে হয় ।

Wednesday, July 25, 2018

গল্প - উপান্ত

                       
                                                                           উপান্ত





                 পায়ে পায়ে ওরা শ্মশানের বেশ ভেতরে চলে এসেছে । অবশ্য বিক্ষিপ্ত কিছু চাপা দেওয়া মাটি আর পোড়া কাঠের টুকরো ছাড়া এমুহূর্তে মনে হবার উপায় নেই যে এটা শ্মশান । এখানে ওখানে গেরুয়া কাপড় পরা রক্তচক্ষু সাধুসন্ন্যাসীদের ঘিরে ছেলের দল গঞ্জিকা সেবনের সাথে সাথে সাধন বিষয়ক আলোচনায় ব্যস্ত । কোথাও আবার গৃহকর্তীদের হাতের সিঁদূর আলতায় সন্ন্যাসীদের পা আর ত্রিশূল ধুয়ে যাচ্ছে । এই শ্মশানে নাকি কোনোদিন চিতার আগুন নেভে না ।
                                      পূণ্যার্থীদের পাশ কাটিয়ে নদীর বেশ কাছাকাছি চলে এলো ওরা ।নদীতে এখন উপছে পড়া জল । রঙ্গময়ী আনন্দে নাচতে নাচতে বয়ে চলেছে । আর পথের পাশে যা কিছু নজরে আসছে তাকে একবার করে স্পর্শ না করলে যেন তার হচ্ছে না । আ-বাঁধানো নদী । জল যখন কম থাকে তখন স্নানের সুবিধার জন্য পাড় কেটে নেয় লোকেরা । আবার গ্রীষ্মকালে নদীতে প্রায় জলই থাকেনা । এর ওপর দিয়ে তখন হেটেই পার হওয়া যায় ।
                                          জনকোলাহল এখানে বেশ স্তিমিত । পায়ের নীচে নদীর কলকল শব্দ । একটা নুয়ে পড়া গাছের গুড়ির ওপরে গিয়ে বসল আশিষ । সূর্যের তেজ একটু একটু করে বাড়ছে । কম্পিত জলের ওপর সূর্যের আলো পড়েছে ।আর ঠিক জলের ওপরে থাকার কারনেই আলো ছায়ার এই খেলা প্রতিফলিত হচ্ছে আশিষের মুখে । অন্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে তাকে ।
                                            অনেকক্ষণ পর প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করে আশিষ প্রথম কথা বলল , ' বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে ঘটনাটা ঘটাইনি । ' স্বগতোক্তির মত কথাগুলি বলে গেল আশিষ । শেষের দিকটায় যেন গলাটা একটু কেঁপে উঠল ।
                                           দেবু হাস্যরসিক মানুষ । অনেকক্ষণ ধরে এই থমথমে ভাব ভালো লাগছিল না তার । ঝাঁঝিয়ে উঠল দেবু , ' তোর সবটাতেই বাড়াবাড়ি । অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতেই পারে । এতে অত চিন্তার কি আছে । আমাদের তো আর কেউ দেখেনি । '
                                             কথাগুলি আশিষের কানে গেল কিনা বোঝা গেল না । কেননা তার মুখ আরো বেশি করুণ বলে মনে হল চয়নের ।
                                               চয়নের চোখের সামনে ভেসে উঠল বীভত্স সেই ছবিটা ।গাড়ী যে খুব বেশি জোড়ে চলছিল তা নয় ।কিন্তু কিভাবে বা কোথা থেকে যে মহিলাটি গাড়ীর সামনে চলে এল আর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশের জঙ্গলে ! আর তার কোল থেকে একটা পোটলা ছিটকে এসে পড়ল তাদের গাড়ীর চাকার একদম সামনে ।মুহূর্তে গাড়ীর চাকা একেবারে থেতলে পিষে ফেলল সেটাকে মাটির সাথে ।
                                             গাড়ী থামিয়ে ছুটে গিয়েই আশিষ চীত্কার করে উঠল । ওরা তিনজন ততক্ষনে চল এসেছে । গাড়ীর ডান চাকার নীচে একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে মাস কয়েকের একটা শিশু । মুখটুকু দিব্যি অবিকৃত । চাকা রয়েছে বুকের ওপর ।
                                                চয়ন তাকিয়ে আছে জলের দিকে । পারের কাছাকাছি এক - একটা ঘূর্ণি দেখা যাচ্ছে ।বেশিক্ষণ থাকছেনা ঘূর্ণিটা । একসময় তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে জলের মধ্যেই মিশে যাচ্ছে । নদীর গতি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছেনা ।

Tuesday, July 24, 2018

গল্প - উপান্ত

                                                                                 উপান্ত
                                                     
                                                                                       
ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি। বন্ধুদের চাপে পড়ে তারাপীঠে বেড়াতে এসেছে চয়ন । প্রত্যুষে নদীতে স্নান করতে একটু শীত শীত করছিল । পরে একটা অপূর্ব প্রশান্তিতে বেশ ঝরঝরে বোধ হতে লাগল তার । গত রাত্রের সমস্ত ক্লান্তি যেন পবিত্র গঙ্গার স্পর্শে একমুহূর্তই ধুয়ে গেল । স্নান সেরে উপকরণ নিয়ে মন্দিরে পৌছে চয়ন হতবাক । এখনো সমস্ত আকাশ জুড়ে ম্রিয়মান তারাদের দেখা যাচ্ছে , এখনো ভোরের পাখিরা শুরু করেনি তাদের উদ্বোধন সংগীত । কিন্তু এরই মধ্যে মন্দির প্রাঙ্গনে ভক্ত মানুষের সেকি মস্ত লাইন । আশিষের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল চয়ন । কিছুটা ক্লান্ত , কিছুটা বিরক্ত , কিছুটা চিন্তান্বিত মনে হলো আশিষকে । দেবু , নীলের মুখও ভোরের তারাদের মত ম্রিয়মান । প্রত্যেকের মনের কোনে যে এখনও গত রাত্রির অন্ধকার লেগে আছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে ।
                              নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে চয়ন প্রথম কথা বলল , ' মনে হয় পুজো দিতে সাতটা বেজে যাবে ।' দেবু আর নীল ঝুকে লাইনটাকে একবার দেখার চেষ্টা করল । আর আশিষের জবাব এল ঠোটের সামান্য বিভঙ্গে ।
                                 দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তবে পুজো দেবার সুযোগ এলো ওদের । 'এও কিন্তু একপ্রকার সাধনা , কি বলিস ' দেবুর এই হাল্কা রসিরতায় চয়নের মনেও একটু হাল্কা ভাব এল ।
                                   ' এবার কোথায় যাবি ' আশিষের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল নীল । আশিষের চোখ সামনের দিকে নিবদ্ধ ।বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরে জনসমাগমও বেড়ে চলেছে । মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায় ।ভক্তজনেরা তাদের মনোষ্কামনা পূরণ করতে কত দূর দূর থেকে এসেছে মায়ের প্রসাদি ফুল পাবার আশায় । একদল অল্প বয়সি ছেলে , কপালে সিঁদূরের তিলক , ' জয় মা তারা ' ধ্বনিতে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল ।চা - মিষ্টির দোকানগুলিতে বেশ ভীড় । বাতাসে গরম জিলিপি ভাজার গন্ধ ।
                                      দেবুর একটু চা তেষ্টা পাচ্ছিল । কিন্তু আশিষের মুখের দিকে তাকিয়ে সে চুপ করে গেল । গত রাত্রির ঘটনাটা সে  ভুলতে পারছে না । দেবু নিজেও কি সেই বীভত্সতা ভুলতে পারছে ।কিন্তু সে ভুলে যেতে চাইছে ।কত মানুষের জীবনেই তো এমন কত ঘটনা ঘটে যা তার সমস্ত সত্বাকে বিপর্যস্ত করে তোলে   আর এটা তো সামান্য একটা ঘটনা । প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে এ ঘটনা ঘটেই চলেছে । তাদের  ভাগ্য ভালো যে এ ঘটনার কোনো সাক্ষ্যী নেই । নয়ত এতক্ষণে গনধোলাই এর সাথে সাথে জেল জরিমানা এসব উপরি পাওনাও জুটত । ............ক্রমশ

Friday, July 6, 2018

গল্প - ভূত না ভৌতিক

  
গল্প - ভূত না ভৌতিক


     


কদিন ধরেই ভাবছি একটা গল্প লিখব । বেশ কতগুলি প্লট মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে । সেদিন আষাঢ়ের বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় সহধর্মিনীর হাতের সুস্বাদু তেলেভাজার সঙ্গে সুপেয় চা পান করে যেইমাত্র খাতাকলম গুছিয়ে বসেছি অমনি আমার সাত বছরের কন্যারত্নটি কোথা থেকে ছুটে এসে বলল , ' কি করবে , বাপি , খাতাকলম দিয়ে ? ' আমি ওর গালটা আস্তে করে টিপে দিয়ে বললাম , ' গল্প লিখব মাগো । ' 'কিসের গল্প বাপি ? ভূতের ? ' এইটুকু মেয়ের মাথায় ভূতের প্রসঙ্গ কিকরে এল জানি না । তবে আমি মনে মনে ভাবলাম আজকের এই আবহাওয়া ভূতের গল্প লেখা ও শোনার  জন্য  সত্যিই খুব উপযোগী বটে । 

             কিন্তু দুপাতা ইংরেজি পড়া এবং একটি নামজাদা প্রাইভেট কোম্পানীর উচ্চপদে কর্মরত অফিসার হয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কিকরে আমি ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি । তাই হেসে বললাম , ' না মা , ভূতের গল্প নয় , আর ভূত বলে কিছু আছে নাকি ? ' যেই না বলা আর অমনি কোথা থেকে খুক খুকে কাসির আওয়াজ হল আর সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার অফ হয়ে গেল । সেই নিকষ কালো অন্ধকারে মনে হল কেউ যেন আমার গালটা আলতো করে ছুয়ে গেল । মাত্র একটা মুহূর্ত । এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় আমাকে যেন কাঁপিয়ে গিয়ে গেল । ভাবলাম হয়ত মেয়ের মা অন্ধকারে হাতরে হাতরে এদিকে আসতে  গিয়ে আমার গালে ছোয়া লেগে গেছে। মোবাইলটাও খুঁজে পাচ্ছিনা যে জ্বেলে কিছুটা অন্ধকার তাড়াবো । কিন্তু গিন্নীর কোনো সাড়া না পেয়ে উচ্চস্বরে ডেকেই ফেললাম । আর তক্ষুনি পাওয়ার চলে এল । দেখি গিন্নীও রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে আসছে ।  কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললাম , ' এইতো এদিকে এলে আবার কখন রান্নাঘরে গেলে । 'সে অবাক হয়ে বলল , ' আমি আবার কখন এদিকে এলাম ? সেই  থেকে তো রান্না ঘরেই ছিলাম । ভর সন্ধ্যেবেলা ভূত দেখেছ বোধহয় ।' ' অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালাম । সেও দেখি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে । কিছু একটা হয়েছে ভেবে জানতে চাইল , ' কি হয়েছে বাপি ? ' আমি এ কথার কোনো জবাব দিতে পারলাম না । কেননা অনুভূতিটা তখন আমার মেরুদন্ড বেয়ে নামতে শুরু করেছে ।