Friday, September 20, 2019

বালুকার'পরে কালের বেলায়

 বালুকার'পরে কালের বেলায়

    জানালার গ্রীলটা ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে রোদ আর বৃষ্টির খেলা দেখছিলাম । রোদ আর বৃষ্টির মধ্যে যেন শক্তিপরীক্ষা চলছে । রোদের প্রচন্ড তেজ , অথচ মুষলধারে বৃষ্টি । পাশের বাড়ির কাকীমা জামাকাপড় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন । একবার রোদে দেন আর একবার তোলেন । সেইসঙ্গে চলছিল বৃষ্টির প্রতি অবিরাম গালি বর্ষণ । আমার কিন্তু বেশ মজা লাগছিল । রোদের মনেও বোধহয় কিছুটা কৌতুকের ছাপ ছিল । তাই বৃষ্টিকে পরাজিত করার আনন্দে তার তেজ আরো বেড়ে যাচ্ছিল । আর অসহায় বৃষ্টি করুন শুষ্ক মুখে আবার নতুন করে বর্ষণ শুরু করলেও পৃথিবীর বুকের ওপর রোদের মত তার অধিকার যেন আর নেই । অনেক প্রত্যাশা নিয়েও বৃষ্টি কিছুতেই পৃথিবীর বুকে মুখ লুকিয়ে প্রাণভরে হাসতে পারছে না । প্রত্যেকবারই দুষ্টু রোদ পৃথিবীর কোল দখল করে নিচ্ছে ।
                আমাদের এক আত্মীয়ের কথা মনে পড়ল । আমার দূর সম্পর্কের কাকা হন । পাশাপাশি বাস করার ফলে সম্পর্কটা পুরানো হলেও হৃদ্যতার ঘাটতি ছিল না । কাকার বড় মেয়ে আমার চাইতে বছর কয়েকের ছোটো । তার যখন নয় বছর বয়স তখন তার একটি ফুটফুটে ভাইয়ের আবির্ভাব ঘটে । মায়ের মুখে শুনেছি দেবতার কাছে অনেক মানত , পুজো আর্চনা করে নাকি তারা এই বংশধরকে পেয়েছেন ।
              আমার ঐ কাকাতো বোনটি বেশ মেধাবী । স্কুলে সে বরাবর প্রথম হত । সকলেই তাকে ভালোবাসত । সারাদিন সে নিজের মনেই মগ্ন । নিজের বইখাতা , পুতুলের বাক্স নিয়েই তার দিন কাটে । তবে ভাইকে সে ভালোবাসত না তা নয় । খেলাঘরের একটি জ্যান্ত পুতুল মনে হত তার এই একরতি ভাইটিকে । যেন একটা কথা-বলা , হাত-পা নাড়া পুতুল । অনেকদিন ধরে বায়না করেও যা সে পায় নি ।
                 তবে সাধের এই ভাইকে সে কাছে পেত খুবই কম । কেননা তার মায়ের মনে হত ভাইকে দেখাশোনা করার মত বয়স তার হয়নি । মা কেমন করে জানবেন খেলাঘরের প্রতিটি পুতুলের সে বড়দিদি । তাদের নিয়ে আদরে বকুনিতে তার কত সময় কেটে যায় ।
                কথা-বলা , হাত -পা নাড়া পুতুলের অভাব পূর্ণ হত তার ভাই ঘুমোবার পর । তখন সে আপন ইচ্ছানুসারে কখনো ভাইকে পাউডার মাখিয়ে সাহেব বানাবার চেষ্টা করত , কখনো কপালে চন্দনের ফোটা দিয়ে বর সাজাতো । আবার কখনো নিজের হাতের চুরিগুলি ভায়ের হাতে পরিয়ে , চুপি চুপি পুতুলের বাক্স থেকে একটা টিপ নিয়ে পরিয়ে দিয়ে ভাবত --- আহা , ভাইকে যদি বৌ সাজানো যায় তো বেশ হয় ।কোনোদিন নিজের এই ভাবনার মাঝে শিশুর অচেতন মুখের হাসির রেখা ফুটে উঠত । আর ভাইয়ের সাথে নিজেকে মিলিয়ে সেও হাসতে থাকত । তার হাসির শব্দে এইসময় হয়ত ঘরে ঢুকতেন তার মা । আর ছেলের কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাবার প্রয়াসে মেয়েকে বকাঝকা করে সারা হতেন । মেয়ের কল্পরাজ্যের ঘরকন্নায় এটুকু পুঁচকে ছেলেটার অবদান কতখানি তা তো তাঁর জানবার কথা নয় ।
                 গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে মাঠের ঐপাড়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা ছেলের ক্রিকেট খেলা দেখে আমার ছোটোবেলার একটা দিনের কথা মনে পড়ল । অনেক বছর আগে , আমি তখন বেশ ছোটো । এমনি এক বর্ষার দিনেই বাবার সাথে বেড়াতে গিয়েছিলাম তাঁর কাকার বাড়ি । আমার বাবার কাকা অর্থাৎ আমার দাদুর বাড়িটা তাঁতিপাড়া আর চাষিপাড়ার সন্ধিস্থলে । এখানে তাঁতিবাড়ির ছেলেমেয়েরা যেমন চাষীবাড়ির তকতকে ঝকঝকে করে লেপা শক্ত বুক টান করা উঠোনে খেলা করে , তেমনি চাষিবাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাঁতিবাড়ির তখনকার মত বাহুল্য হিসেবে পড়ে থাকা চরকা , টেকো , সুতো সহযোগে খেলা করে ।
     সেদিন আমি এদের সঙ্গে খেলা করতে গিয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এদের মধ্যে যেন দুটো আলাদা দল দেখতে পাচ্ছিলাম । একপাড়ার ছেলেমেয়েরা আর এক পাড়ায় এলে আগন্তুক ছেলেমেয়েদের অধিকার কিছুটা খর্ব হয় দেখেছিলাম । এর কারণ পাড়াগত ব্যবধান না জীবিকাগত  ব্যবধান তা বোঝার সাধ্য তখন আমার ছিল না ।
                

         এমনি একদিন খেলতে খেলতে প্রচন্ড রোদের পাশাপাশি ঝমঝম বৃষ্টির ছোয়া পেয়ে আমি দৌড়ে উঠে গিয়েছিলাম বারান্দায় । সেখান থেকে দেখছিলাম ছেলেমেয়েগুলো আনন্দে হাততালি দিয়ে নাচছে আর ছড়া কাটছে ---- রোদ উঠেছে বৃষ্টি পড়ে / শেয়াল পন্ডিত বিয়ে করে ।

            সত্যিই এমন দিনে শেয়াল পন্ডিত বিয়ে করে কিনা তা আমার দেখা হয়নি কখনো । শুধু এই রোদভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ছবি আমার চোখে ভেসে উঠেছিল । মাথায় টোপর পড়া শেয়াল পন্ডিত হাতে ধুতির কোঁচা ধরে লেজ দুলিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে । কিন্তু কার সঙ্গে যে বিয়ে হচ্ছে সেটা জিজ্ঞাসা করার আগেই সরমা নামে একটি মেয়ে আমার হাত ধরে টেনে ওদের মাঝখানে নিয়ে গেল ----- ' এমা তুমি ওখানে কেন । এ বৃষ্টি বুঝি গায়ে লাগে ? '
           আমি কোনো উত্তর দেবার আগেই পাশের একটি ছেলে বলে উঠল ---- ' তুমি বুঝি বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসো না ? '

     

            আমি কিছু একটা বলতে যাব তখনি শুনতে পেলাম ধেনোর বাবা আর চরকির বাবার আলাপ । ধেনোর বাবা আনন্দে গদগদ কন্ঠে চরকির বাবাকে বলছে , ---- ' এবারে ধান ভালো হবে দাদা । বৃষ্টিটা ঠিক সময়েই হচ্ছে । ' আর চরকির বাবার নিষ্প্রদীপ জবাব ---- ' তা ভাই তোমাদের তো এই বৃষ্টিটা ভালো । কিন্তু আমাদের সুতো কাপড় কিছুই যে শুকোয় না । হ্যারিকেনের তাপে , উনুনের আঁচে সেঁকে কি আর রোদে শুকোনোর মত শক্ত কাপড় পাওয়া যায় । '
             রোদ আর বৃষ্টির প্রেক্ষাপটে পর পর তিনটি দৃশ্য আমার চোখে ভেসে উঠল । একদিকে ধেনোর বাবার আনন্দে আপ্লুত মুখ , তার বিপরীতে চরকির বাবার উদাস বিরক্ত মুখ । আর খেলুড়ে ছেলেমেয়ের দল ।
             রোদের তেজ এখন কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে । ওর শক্তি যেন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে । নাকি মায়ের স্নেহ কচি বুকটাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে এরই মধ্যে । তাই পরিপূর্ণ হৃদয়ে এখন সে অন্য কোনো খেলার স্বাদ নিতে চাইছে ।
            দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো । বৃষ্টিটাও বেশ জাকিয়ে উঠেছে । এতক্ষণে খেয়াল হলো জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে আমার টেবিলের ওপর সযত্নে ভাঁজ করে রাখা শাড়িটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে । আমি তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করে শাড়িটা খাটের ওপর ছড়িয়ে দিলাম ।
           নীচে বাবার গলার স্বর শুনতে পেলাম ----- ' এমন বর্ষার দিনে আর বাইরে বেরোব না , বেশ করে পেঁয়াজের ফুলুরি করো দেখি । গরম গরম । মুড়ি দিয়ে খাই । '

           ------ ' ওমা , মুড়ির কথা তো তোমাকে সকালেই বললাম । সকালে বাজার করে আনলে   মুড়ি এনেছো কি ?
            উত্তরে বাবা কি বললেন তা আর কানে এলো না ।

      আমার ঘরের দেওয়ালের ছবিটার দিকে চোখ গেলো । গত বছর রথের মেলা থেকে কিনেছিলাম । ছবিটাতে শিল্পীর নিপুন হাতে আঁকা কোনো এক অদৃশ্য শক্তির হাতে ঝুলন্ত একটা দাঁড়িপাল্লার একদিকে রয়েছে একজন নারী আর অপর দিকে রয়েছে একজন পুরুষ । হয়ত শিল্পীর মনে কখনো প্রশ্ন জেগেছিলো এই সংসারে নারী বড় না পুরুষ বড় ।
         আজ এই বর্ষার দিনে নির্জন ঘরে বসে আমার মনে হচ্ছে সংসারে নারী-পুরুষের স্থান অনেকটা চাঁদ-সূর্যের মত । রাতের নিবিড় অন্ধকার ছাড়া যেমন চাঁদের গুরুত্ব বোঝা যায় না ,তেমনি কয়েকদিনের অবিরাম বর্ষণে ক্লান্ত শ্রান্ত টলটলে জলেভরা পৃথিবীর গাম্ভীর্য যখন অসহ্য মনে হয় তখনি সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা সমস্ত প্রাণীকুলকে ব্যাকুল করে তোলে ।তবে মাঝে মাঝে এদের লুকোচুরি নতুন স্বাদের জন্ম দেয় ----- এটাই সত্য ।
             

No comments: