Sunday, December 30, 2018

গৌরচন্দ্রিকা - অন্তিম পর্ব

গৌরচন্দ্রিকা - অন্তিম পর্ব

অনিমেষ কোনো জবাব দিল না । মুখ নীচু করে একটা আমপাতা নখ দিয়ে চিরতে লাগল । 
          - এভাবে যদি বিচার কর তবে বলত অনিমেষদা আমাদের কার চরিত্র ভালো ?
     অনিমেষ জিজ্ঞাসু চোখে শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে আছে । কি বলতে চায় মেয়েটা । শাশ্বতী বলে চলেছে ।
          - এই যে আমি এই দুপুর বেলা তোমার সাথে এই বাগানে বসে নির্জনে কথা বলছি । এখন তোমার মত কেউ যদি দেখে তবে তো আমার চরিত্র নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে । 
          - আহা তা কেন ।
অনিমেষের কথা হয়ত শাশ্বতীর কানেই পৌছয়নি ।
          - আমিও তো আমাদের অর্গানাইজেশনের কাজে কত ছেলেদের সাথে রাত নেই , দিন নেই ঘুরে বেড়াই । নানা কথা নিয়ে ওদের সাথে হাসি - তামাসা করি । আমার ব্যপারেও তোমরা এমনি ভাবো নিশ্চয় ।

শাশ্বতীর মনে পড়ে তার পিসতুতো দাদার কথা । গতকাল রাতে সিনেমাটা শেষ হলে সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন এরকম একটা কথা উঠেছিল নায়িকার চরিত্র নিয়ে । দাদা বলেছিল , দেখ সতী , আমাদের চরিত্রটা আসলে আপেক্ষিক । একপেষে দৃষ্টি নিয়ে আমরা চরিত্রের বিচার করি । একটা মানুষের সবটুকু আমরা দেখতে পাই না বা দেখি না । বলতে গেলে দেখার চেষ্টাও করি না । আর এজন্যই যত রাজ্যের কুৎসা , বদনামের সৃষ্টি করি । তুই নিজেকে দিয়ে বিচার কর দেখবি সেটা পরিস্কার হয়ে গেছে । সবকিছুর পিছনেই কারণ থাকে । মনে কর তোকে আদালতের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে । তোর চরিত্রের বিচার হচ্ছে । তুই তোর সপক্ষে  নিশ্চয় কারণ দেখাবি । এবং এটাই স্বাভাবিক । আর কার্য-কারন সম্পর্কের ভিত্তিতে তর্ক শেষপর্যন্ত যুক্তিতে উত্তীর্ণ হয় । আসলে আমাদের মধ্যে কিছু লোক আছে অন্যের খুঁত বের করাই এদের কাজ । নিজেদের খুঁত ধরে দাও , দেখবে নিজেকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করার কত কারণ দেখাবে । অথচ অন্যের ব্যপার ' বুঝব না ' বলে চুপ করে থাকে ।
শাশ্বতীর ধ্যানভঙ্গ হল অনিমেষের কথার আওয়াজে --- আসলে শুধু তাই নয় । আশেপাশের বাড়ির লোকেরাও তাই বলল ।
        - পাশের বাড়ি ! অনিমেষদা , তুমি এতদিন ধরে যাকে দেখছ , ভালোবেসেছ তার সম্পর্কে শেষপর্যন্ত তোমার এই ধারনা । এত ঠুনকো তোমার প্রেম । আচ্ছা , কেউ যদি এসে বলে ভাই চিল তোমার কানটা নিয়ে গেল । তুমি কি চিলের পেছনে ছুটবে নাকি নিজের কানে হাত দিয়ে দেখবে কানটা স্বস্থানে আছে কিনা ।
            - কিন্তু সতী , অনেকের কথা যেখানে আছে , মানে অনেকে যেখানে বলছে ---
           - দেখ দাদা , সবার কথা আমি জানি না । সবাই তার কোন আচরণ দেখে তাকে চরিত্রহীনা বলছে আমি জানি না । তাদের কথা বাদ দাও । আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করছি তুমি নিজে কতখানি সৎ বুকে হাত দিয়ে বলত । যদি একটি ছেলের সাথে কথা বললেই একটা মেয়ে খারাপ হয়ে যায় তবে তুমি বলতো তুমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে কথা বলনি ? রাস্তাঘাটে কোনো মেয়েকে টোয়েন্টিং করনি ?

অনিমেষ কখন উঠে বসেছে । অনিমেষ অনিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শাশ্বতীর দিকে । শাশ্বতী আজ ক্ষেপে উঠেছে । প্রতিবাদের প্রখর ঝড় তার চোখেমুখে। একোন শাশ্বতীকে দেখছে অনিমেষ । ছোট্ট মিষ্টি শান্ত যে মেয়েটির হাতে সে ছ-মাস আগে ভাইফোঁটা পড়ে গেছে  এ কি সে ! শাশ্বতীর মুখের সেই লাজুক ভাব যা সবসময় অনিমেষকে ছোট্ট বোন বলে মনে করিয়ে দিত এতো তা নয় ।
শাশ্বতীর কথা শুনে আজ অনিমেষের ক্লাশ সেভেনের ইতিহাসের দিদিমনির কথা মনে হচ্ছিল । তনিমা মিত্র ক্লাশে ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গিয়ে এরকমভাবেই কথা বলতেন । এরকমভাবেই তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে যেতেন । মুখে ফুটে উঠত করুণ বেদনা ।
শাশ্বতী কিন্তু নিজের কথাতেই মগ্ন - দেখ অনিমেষদা , তুমি যদি সত্যি ওকে ভালোবাস তবে ওর সাথে কথা বলো । ওকে বোঝার চেষ্টা করো । আশা করি তাহলে ওকে বুঝতে পারবে । তারপর যদি ওকে তেমন মনে হয় তুমি ব্যবস্থা নাও ।
আজ অনিমেষের আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে । সত্যি , মেয়েটা আজ অনিমেষকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করছে । 
          - কিরে দুজনে চুপচাপ করে বসে আছিস কেন । সরি , আমার একটু দেরি হয়ে গেল । 

প্রিয়তোষের কথায় প্রকৃতিস্থ হল দু'জনে । প্রিয়তোষ পকেট থেকে দুটো চকলেট বের করে ছুড়ে দিল মাদুরের ওপর  --- নে খা ।

কোকিলটা এখন আর ডাকছে না । হয়ত ওর সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে । কিংবা এখানে ওর সঙ্গী নেই বিবেচনা করে অন্য কোথাও চলে গেছে । বাগানের সামনের পুকুরটার দিকে চোখ গেল অনিমেষের । সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আছে জলে । একটু পড়েই সূর্য ডুবে যাবে । অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । তারপর আগামীকালের প্রতীক্ষা । তারপর আবার চারদিক আলো করে সূর্য উঠবে । শুরু হবে একটি নতুন দিনের ।

No comments: