Saturday, July 10, 2021

সন্ধ্যার মেঘমালা

সন্ধ্যার মেঘমালা


আমার দুঃখগুলো ঢেকে রেখো রাতের আকাশ
হাসিটাকে ছড়িয়ে দিও উদাসী বাতাস 
স্বপ্নগুলোর আঁকিবুকি  ,
হাজার তারার ঝিকিমিকি 
মনের ঘরে সিধ কেটে যাক সোনালী আভাস। 

দাঁড়িয়ে আছি আপন মনে রূদ্ধ ঘরের কোনে 
অলস সময়,  হতাশ জীবন  , উদাস , শূণ্য মনে  ।
যেদিকে তাকাই অসহায় মুখ ,
অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু বুক
এক আকাশ ভাবনা জাগে রাতের সঙ্গোপনে  ।

আমার গোপন কান্না যত বালিশ ভেজায় ,
নোনাজলের ঢেউ তুলে যায় শিরায় শিরায় 
হঠাৎ আসা ঘূর্ণিঝড়ে 
বুকের তটে ঝাপটা মারে 
এক পৃথিবী হাহাকারে  মনকে কাঁদায়  ।

কাঁদায়  -- শুধু কাঁদায়  , আমায় ব্যস্ত করে 
ওঠায় - নামায়,  হাসায় - কাঁদায়  , খেলা করে 
সম্মোহনী মায়ার বশে ,
জীবনজুড়ে রঙ্গে রসে
দোদুল দোলায়  , আপন ভেলায় মগ্ন করে  ।

জীবন যখন পূর্ণ আমার হতাশ্বাসে ,
কানায় কানায় পূর্ণ কলস  , নিয়তি হাসে 
এত বড় নিষ্ঠুরতা ,
শুধুই কালো  , মেদুরতা ,
দিন -রাতের বিবাদ আমার চোখে ভাসে। 

Friday, July 2, 2021

গৌতম তরফদার

নতুন অধ্যায় 
গৌতম তরফদার 

               বিভিন্ন অনলাইন সাহিত্য সংস্থায় লেখালেখির কারণে পাঠক মহলে বিপ্রতীপ তালুকদারের পরিচিতি অনেকটাই বেড়েছে। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। বিপত্নীক।
বছর দুয়েক আগে পাহাড়ের কোলে বেড়াতে গিয়ে আকস্মিক হড়কা বানে স্ত্রী আর আট বছরের একমাত্র কন্যাকে হারিয়েছে। সেই থেকে বিপ্রতীপ পুরোপুরি একা। মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দিদি তার আপন পরিবার নিয়ে আসামের গোয়ালপাড়ায় থাকে। বিপ্রতীপ অফিস আর লেখালেখির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
      
              ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিন বেশকিছু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। বিপ্রতীপের বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর তেমন আগ্রহই নেই। একদিন কেতকী মজুমদার নামের একজনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। প্রোফাইল পিকচারে একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হুবহু যেন তার হারানো মেয়ের মুখ। স্মৃতির জোয়ারে ভেসে যায় বিপ্রতীপ। আর কিছু দেখতে পায় না প্রোফাইল লক থাকার কারণে। আনমনেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে নেয়। 

             বন্ধুত্ব শুরু। কেতকীর স্বামী রাজশেখর বছর কয়েক আগে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। অভিশপ্ত জলন্ত কামরায় ওরা তিন জনই ছিল কাশ্মীর টুর থেকে ফেরার পথে। কেতকী তার মেয়ে পল্লবীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও ভীষণ রকম জখম হয়। অবশেষে মা-বেটি সুস্থ হয় কিন্তু রাজশেখরকে বাঁচানো যায় নি। স্বামীর পেনশন আর ঘর ভাড়ায় টাকায় মা-বেটির সংসার চলে। 

              বিপ্রতীপের কবিতা আর গল্পের অসম্ভব ভক্ত। লাইন ধরে ধরে বলে দিতে পারে। নিজেও অল্পবিস্তর লেখালেখি করে। সেই সূত্রেই খোঁজ, যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব। ফেসবুক,  ম্যাসেঞ্জার আর হোয়াটস্অ্যাপে নীরব কথা আর অনুভূতির বিনিময়ে দ্রুত ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

             দু'জনেই কোলকাতার বাসিন্দা।  বিপ্রতীপ থাকে বেহালা আর কেতকী দমদমে। সম্পর্কের গভীরতা যত বাড়তে থাকে বিপ্রতীপ দেখা করার জন্য বারংবার অনুরোধ জানাতে থাকে। কিন্তু কেতকী প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। বলে," এভাবেই এগিয়ে চলুক আমাদের সম্পর্ক। দু'জনের জীবনেই চরম দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আজ আমরা পরস্পরকে মানসিক ভাবে পেয়েছি। সামনাসামনি দেখা আর আমার সান্নিধ্যের ছোঁয়া যদি তোমার অপছন্দ হয়, তখন ?  বাস্তবের জটিলতায় যদি আবার তোমাকে হারাই, সইতে পারবো না আমি।" 

           কিন্তু বিপ্রতীপ নাছোড়বান্দা। দেখা করার অভিলাষে মেয়ের দিব্বি দিয়ে বসে। দু'জনেকেই আসতে বলে। কেতকী কথা রাখে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে মিলেনিয়াম পার্কে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্রতীপের সামনে দাঁড়ায়। চমকে ওঠে বিপ্রতীপ। কেতকীর ডান গাল জুড়ে বিচ্ছিরি পোড়া দাগ। চামড়া কুঁচকে আছে।
  
        --- "আমি তোমায় অনেকবার বলেছিলাম আমায় দেখতে চেয়ো না। অশরীরী সম্পর্ক থাক দুই হৃদয়ে।" 

        -- " দূর পাগলি! এই জন্যই তুমি এড়িয়ে যাচ্ছিলে? যে হৃদয় জয় করে, সে কি আটকে যাবে নশ্বর শরীরে! তোমাকে আর বেটিকে নিজের করে নিতে চাই।  তুমি রাজি তো ? "

অঞ্জন চক্রবর্তী

পিতৃদিবস
অঞ্জন চক্রবর্তী
============
      অতনু একটি মার্কেন্টাইল ফার্মের কর্ণধার, দম ফেলবার সময় নেই, আরও আরও ওপরে উঠতে হবে, সীমাহীন প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, নিজের কেরিয়ার ছাড়া কিছু বোঝে না l অতনুর বাবা তার সর্বস্ব নিয়োগ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন l ছেলে আজ এক ঈর্ষণীয় জায়গায় পৌঁছেছে l নিজের সংসার করেছে, যেখানে বাবা বেমানান হওয়াতে বাবাকে অতনু রেখে এসেছে দামি বৃদ্ধাশ্রমে l বাবা আপনমনে ভাবেন ফেলে আসা দিনের কথা l পিতৃদিবসের দিন সকালবেলায় অতনু হন্তদন্ত হয়ে হাজির বৃদ্ধাশ্রমে, বাবাকে বললো শিগগিরই গেঞ্জি ছেড়ে ভাল পাঞ্জাবী পর একটা, বৃদ্ধ উদ্বেলিত, ভাবেন হয়তো ছেলের মনের হয়েছে বদল, আবার তাঁর জায়গা হবে সংসারে l বৃদ্ধ পাঞ্জাবী পরে এসে দাঁড়ালেন,  ছেলে বলল এসে আমার পাশে দাঁড়াও ঠিক এইভাবে, বৃদ্ধ দাঁড়ালেন, ছেলে নিজেকে বাবার গলা জড়িয়ে ফটো তুললো, বললো
     বাবা, আমার সময় নেই আসি, মনে মনে বললো এই ফটোটা পোস্ট করবো ফেসবুকে
    আজ পিতৃদিবসের দিনে, কমেন্টে ভেসে যাবে, কেউ জানবেও না, অতনুর বাবা পরে আছে বৃদ্ধাশ্রমে l

সঞ্জীব রায়

পুত্ৰং দেহি 
ডঃ সঞ্জীব রায় 


    তড়িঘড়ি করে মধ্যমগ্রামে চারমাথা মোড়ের দোতলা বাড়িটা জলের দরে বেচে দিলেন সঞ্জয় সেনের ছেলে অনুব্রত। হাতে সময় নেই, দশ দিনের ছুটিতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা। কি দামে বিক্রি হলো সঞ্জয় বাবু সেটাও জানতে পারেননি। সঞ্জয় সেনের আপত্তি ছিল, কিন্তু গিন্নি শুনলে তো। নাতি হয়েছে, তাঁর ফুর্তি ধরে না যে। ছেলে পাসপোর্ট আগেই করে রেখেছিল। সঞ্জয়বাবু জানতেন যে আমেরিকার ভিসা করতে ন্যূনতম দুদিন সশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়। কিন্তু ছেলে বললো এখন সবই নাকি অনলাইনে হয়ে যায়। তালেবর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আর ইচ্ছা করেনি।

    বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে পাসপোর্ট পরীক্ষা হওয়ার সময় কেমন যেন সন্দেহ হল সঞ্জয়বাবুর। তিনি দেখলেন একপাশে গেটম্যানকে টেনে নিয়ে গিয়ে অনুব্রত তার হাতে একগাদা ৫০০ টাকার নোট গুঁজে দিল। বিমানবন্দরের ভেতরে গেলেন স্বামী-স্ত্রী। একটু উত্তেজনা হচ্ছে। দীর্ঘ বিমানযাত্রা বলে কথা। ঘন্টা কয়েক বাদে ছেলেই জানায় প্লেন লেট আছে। চিন্তার কিছু নেই। ও ভেতরে যাচ্ছে, কিছু কাগজপত্র দেখানো, সই-সাবুদ বাকি।

     মাঝরাত পার হয়ে প্রায় শেষ প্রহর। ঠান্ডা লাগছে। সোয়েটার চাদর গায়ে দিয়ে অভুক্ত রয়েছেন দুজনে। না পাচ্ছেন ছেলের দেখা, না পাচ্ছেন কোনো খবর। হাতে টাকা-পয়সা, পাসপোর্ট, টিকিট কিছুই নেই। এয়ারলাইন্সের এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে এলেন। সব শুনে তিনি তো তাজ্জব। বললেন রাত ১টা ২০ মিনিটে ওয়াশিংটন যাওয়ার প্লেন উড়ে গেছে এবং ছেলে তাতে বোর্ডিং করেছে। এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধ দম্পতির পাঁজর থেকে।

    তারপরের দীর্ঘ টানাপোড়েন ইতিহাস। বর্তমানে তাঁদের ঠিকানা ঠাকুরপুকুরের এক বৃদ্ধাশ্রম 'অমলকান্তি'। সেখানে একতলার এক স্যাঁতস্যাঁতে ১০/১০ ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন। বিনা পয়সায় আর কিই বা জুটবে? কোন অভিযোগ নেই। ঈশ্বর ধন্য, এটুকু দিয়েছেন।

   একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, সঞ্জয়বাবু পরে জানতে পেরেছিলেন বাড়িটা ৭৮ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।


শ্যামল মিশ্র

রোমন্থন
শ্যামল কুমার মিশ্র

    ঝুলবারান্দায় মুখোমুখি বসে শোভন আর রুমান্না। সকালের নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে। বাতাসে অল্প অল্প শীতের আমেজ। সামনের বাগানে শিউলিগুলো ঝরে পড়েছে। সবুজ ডালের আড়ালে কাজল পাখি গান গেয়ে চলেছে। সকালের এই সময়টা বড় ভালো লাগে শোভনের। রুমান্না এসে আলতো করে মাফলারটা জড়িয়ে দিয়ে শুরু করে ফেলে আসা জীবনের নানা কথা। 

   দেখতে দেখতে শোভন আর রুমান্নার দাম্পত্য জীবনের সিলভার জুবলি পেরিয়ে গেছে। রুমা বলে ওঠে---''জীবনটা বড় তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল তাই না? মনে পড়ে এই সেদিন যেন আমরা ঘর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মধ্যমগ্রাম বারাসাত এমনকি কলকাতাতেও অনেকে ঘর দিতে চায়নি। যখনই শুনেছে আমি 'রুমান্না খাতুন' তখনই দূরে সরে গেছে। তাদের 'গোপালে'র কথা মনে হয়েছে''। মৃদু হাসি খেলে যায় শোভনের মুখে। 'আসলে বড় অদ্ভুত এই দেশ।এদেশ বুদ্ধ, মুহাম্মদের দেশ। এদেশ শ্রীচৈতন্যের দেশ যার পরমভক্ত যবন হরিদাস। যিনি একজন মুসলমান। এঁরা তো সেই গোপালেরই ভক্ত। এটা খানিকটা সংস্কারের মতো মিশে রয়েছে। কার্যকারণ ব্যাখ্যা হয়তোএদের কাছেও নেই'।

   বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে রুমার।  আপনমনে সকালের খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় এসে থমকে যায় রুমা। দৃষ্টি আকর্ষণ করে শোভনের। অতিমারিতে মৃত এক হিন্দু যুবককে পোড়াতে নিয়ে চলেছে চার মুসলমান যুবক। প্রতিবেশীরা কেউই আসেনি। রুমান্নার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

    শোভন বলে চলে---'বুঝলে জীবনের  সার সত্যটা কেউই বুঝলো না।  মানুষই সত্য। ধর্ম,জাত সবই মিথ্যা। এগুলো শুধু জীবনের এক একটা আভরণ। দর্পীর অহং। আভরণ খুললেই দেখবে জীবনের শাশ্বত সত্য রূপ'।

    রুমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা জীবনের নানা ছবি। নতুন সংসারী দুই যুবক যুবতী ঘর খুঁজে ফেরে। জীবনতরী এগিয়ে চলে এমনি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অবশেষে ঘর মেলে।সংসারেরও শুরু হয়।...

   তারপর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পৌঁছে মনে হয় শোভনের জীবনের সবটাই অসুন্দর নয়। গোলাপের সৌন্দর্য নিতে গেলে কাঁটার আঁচড় ও যে খেতে হয়। ততক্ষণে রুমান্না গান ধরেছে--- 'আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ'...। 
     গানটা কখন থেমে গেছে মুখোমুখি বসে দুই প্রৌঢ় দম্পতি। পাশে রাখা মুঠোফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একমাত্র ছেলের নাম। ধীরে ধীরে হাতটা বাড়ায় রুমান্না... 

(শব্দ সংখ্যা:৩১২)

সুতপা ব্যানার্জি

আসমান জমিন
সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়)
     ছটু সিং এক সওদাগরী অফিসে দ্বারোয়ানের কাজ করে। বাবা-মা আর নিজের পরিবার নিয়ে একটা খুপরি ভাড়ার বাসায় থাকে। ভাড়াটা একটু কম হবে বলে সবচেয়ে ওপরে চারতলায় ওদের বাস। সিঁড়ি ভেঙেই যাতায়াত। সেদিন অফিস থেকে ফিরে শুনল-"মায়ের শরীরটা গরমে আজ ভীষণ খারাপ হয়েছে।গরমি জ্বর এসে গেছে"-কথা কটা বলে বউ সরলা রান্না ঘরে লেবু জল আনতে গেল। ছেলে বাবুল-"বাবা দুপুরে গরমে ঘরে টেকা যাচ্ছে না, আমরা বাসা বদল করতে পারি না?" ছটু-"এত কম ভাড়ায় কোথায় ঘর পাব বেটা, গরম কমলে সব ঠিক হয়ে যাবে।" ছোট মেয়ে শামলি বাবার হাত ধরে বায়না করে-"তাহলে বাবা আনো না একটা কুলার কিনে, দাদিও আরাম পাবে আর আমরাও একটু ঠান্ডা পাব।" সরলা স্বামীকে লেবু জল দিতে এসে মেয়ের আবদার শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে-" ভাত কী করে জুটবে জানা নেই আবার কুলারের হাওয়া খাচ্ছে, যা ভাগ,নিজের বই খুলে বস।" ছটু-"শামলি কথাটা খারাপ বলে নি, চার-পাঁচ হাজার টাকায় হয়েও যাবে, দেখি অফিসে সাহেবের থেকে লোন পেলে মাসে মাসে কাটিয়ে নেব।" বাবার কথায় বাবুল আর শামলি খুব খুশী হল।

    পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমে বড়বাবুর কাছে গেল-"রায় বাবু আমার চার-পাঁচহাজারটাকা লোন লাগবে,আপনি একটু সাহেবকে বলুন না।" বড়বাবু-"কেন? আমি বলব কেন? তুমি সাহেবকে নিজের কথা নিজে বল।" ছটু কাজটা জটিল হয়ে যাওয়ায় দোনামোনায় পড়ে গেল, তবে বাড়ির পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সাহস সঞ্চয় করে পায়ে পায়ে সাহেবের কেবিনের দরজায় দাঁড়াল। পর্দাটা কাঁপা হাতে সরিয়ে-"একবার ভেতরে আসব স‍্যার?" ফাইলের দিকে চোখ রেখেই অফিসের মালিক ঝুনঝুনওয়ালা-"কী বলবে, দের কিঁউ, জলদি বোলো।" ছটু-"আজ্ঞে স‍্যার বাড়ির প্রয়োজনে আমার পাঁচহাজার টাকা লাগবে। আপনি মাসে মাসে কেটে নেবেন।" ঝুনঝুনওয়ালা-"অফিসের এখন অবস্থা ভাল না, আভি নেহি।" ছটু কাচুমাচু হয়ে-"গরমে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, একটা কুলার কিনতাম স‍্যার।" ঝুনঝুনওয়ালা হাসিতে ফেটে পড়ে
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে-" সবলোগ শুনো.. আমাদের ছটুর কুলার কেনার জন‍্য টাকা লাগবে...হা হা হা।" আরো কয়েকজন সেই বিদ্রুপের হাসিতে যোগ দিল। ছটুর চোখ ফেটে জল আসছিল। তা সামলে নিজের কাজের জায়গায় গিয়ে বসল। চাকরি বলে কথা, অপমান গায়ে মাখলে তো হবে না। যদিও মনটা খুব খারাপ হয়ে থাকল। পরদিন অফিস ফেরত পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরছে। দেখল রাস্তার উল্টো দিকে একটা এসি মেসিন বিক্রির দোকানে অফিসের সাহেব দাঁড়িয়ে। ছোটা হাতি করে নতুন বাক্সে ওনার বাড়ির এসি চলল। সাহেব চলে যেতে ছটু দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল-"যে এসিটা বিক্রী হল, ওটার দাম কত?" দোকানদার-"কেন আপনি কিনবেন,ষাট হাজার টাকা।" ছটুকে শুনিয়ে শুনিয়ে দোকানদার বলতে থাকে-" ওনার অনেক বড় ব‍্যবসা। ওনার সব ঘরেই এসি আছে। সবই আমাদের দোকান থেকে কেনা। শুধু পোষা কুকুরের ঘরের এসিটা খারাপ হওয়ায় নতুন একটা কিনে নিয়ে গেলেন।" ছটু দোকান থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ডিউটির পর একটা শপিং মলে বা কোন পেট্রল পাম্পে কাজ করে হলেও নিজের পরিবারের কষ্ট দূর করবে, তার মায়ের কষ্ট দূর করবে। সাহেবের দাক্ষিণ‍্যে নয়, নিজের নগদ টাকায় এই গরমেই কুলার কিনবে।

উমা মুখার্জি


ডাক্তার বাবু
 উমা মুখার্জী

       অনেকদিন আগের ঘটনা। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন ডাক্তার। খুবই সৎ ও দয়ালু ছিলেন। যত দুর্যোগ আর যত রাত - ই হোক, রুগীর বাড়ি থেকে ফোন এলে তিঁনি তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে পড়তেন, রুগী দেখার উদ্দেশ্যে।

      সেদিন ছিলো শ্রাবন মাসের সন্ধ্যা। অবিরাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠাকুরদাদা ভাবলেন, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন। শুয়েও পড়েছিলেন। হঠাৎ, দরজার কড়া নাড়ার শব্দ। রাত্রি তখন বারোটা। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। একটি লোক সঙ্গে ছাতা, আঁধারে মুখ দেখা যাচ্ছেনা, বলে ডাক্তার বাবু আপনি আসুন, নাহলে বাবু বাঁচবেনা।

      কথায় জানতে পারলেন, শহর থেকে একটু দূরে যেতে হবে। দেরী না করে, লোকটিকে নিয়ে গাড়ি করে চললেন রুগী দেখতে। এতো জল গাড়ি অনেকটা এসে আর স্টার্ট নিচ্ছেনা। লোকটি বলে, চিন্তা করবেন না, ছাতা এনেছি, চলুন, অল্প হাঁটা পথ। অগত্যা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, লোক টি ছাতা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, টর্চ জ্বেলে কিছু বোঝাও যাচ্ছেনা। বিদ্যুতের আলোয় শুধু একবার লোকটির মুখ দেখা গেলো, চোখ দুটি কোটরাগত, গালে মাংস বলে কিছু নেই।

      অল্প হাঁটার পর এলো রুগীর বাড়ি, আগেকার দিনের দোতালা বাড়ি। লোকটি গেট ঠেলে বললো আপনি সোজা চলে যান, প্রদীপ জ্বলছে ঐ ঘরে রুগী, বলেই অদৃশ্য।

     ঠাকুরদাদা এগিয়ে গিয়ে দেখেন খাটে মুখ চাপা দিয়ে একজন শুয়ে, শুধু একটা কোথা থেকে চেয়ার এগিয়ে এলো। রুগীর গলা খনখনে, বলে বসুন আপনি, আগে আমার কথা সব শুনুন, তারপর আমায় দেখবেন।

     কোণের দিকে দেখুন লাল বাক্স, ওতে আমার উইল আছে। আমার আর বাঁচা হবেনা। সময় হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলের ঠিকানা ওতে আছে, ত্যাজ্য পুত্র করেছিলাম। ওটা তাকে পৌঁছে দেবেন শুধু এই অনুরোধ টুকু রাখুন।

     এর পর মুখের চাপা গেল খুলে, আর অন্ধকারে ঠাকুরদার হাত তার হাতে ধরা বরফ শীতল এক কঙ্কাল শুয়ে বিছানায়।

    এক লাফে দৌড়ে ঠাকুরদা গাড়ির কাছে আসেন যখন, গাড়ি নিজেই ঠিক হয়ে গেছে, ঝড়, জল থেমে গেছে। বাড়ি পৌঁছে ভাবছেন কি করে হয়।

     সকাল হতেই আবার যান। দেখেন লাল রঙের বাড়ি, তালা দেওয়া। স্থানীয় লোকেরা আসে ভিড় করে, জানায় ছয় মাস হলো উনি মারা গেছেন।
তালা ভেঙে দেখা গেলো খাট নেই, চেয়ার নেই, তবে ঘরে একটা লাল বাক্স আছে কোণের দিকে, আর তার ভেতরে দলিল ও ছেলের ঠিকানা আর চিঠি।

   ঠাকুরদা সেটি নেন ও লোক মারফত নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন।

   শেষ দিন অবধি এই রহস্যের কিনারা তিঁনি করে উঠতে পারেননি। ভুত কি তবে সত্যি আছে?

সমাপ্ত।।