--- তুমি কে ? -- আমি অষ্ফুটে জানতে চাইলাম ।
---- আপনি তো এই স্কুলে নতুন এসেছেন তাই আপনি আমাকে চেনেন না । আমার নাম রামশরণ । ছেলেরা ঐ নামেই আমাকে ডাকত । গেটে চৌকিদারির কাজ করতাম । ঐ যে এখন যেখানে মিড ডে মিলের ঘর হয়েছে সেখানে আগে ছিল আমার বাস । চব্বিশ বছর বয়সে একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছিলাম ইস্কুলের সামনে । কোনো কাজ-কামের আশায় । তখনকার দ্বিজেনমাষ্টার দেবতা ছিলেন । গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাকে সব জিজ্ঞাসা করলেন । তারপর আমাকে একটা চাকরি দিলেন । থাকার জায়গাও দিলেন ইস্কুলের ভিতর । কাজের মধ্যে রাতদিন ইস্কুল পাহাড়া দেওয়া । সকালে ইস্কুল শুরু হওয়ার আগে দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে খেয়ে নিতাম । আর সেই রাতে একবার ।
----- তোমার বাড়ি কোথায় ছিল রামশরণ । --- কৌতুহলে জানতে চাইলাম ।
----- সে তো ছিল বিহারে । কত ছোটোবেলায় মা মারা যাবার পর বাপটা আমাকে নিয়ে গা-ঘর সব ছেড়ে চলে এল কলকাতায় । বাপ শিয়ালদায় কুলিগিরি করত । আমি প্ল্যাটফর্মের একটা কোনে বসে থাকতাম । ট্রেন আসা-যাওয়ার ফাঁকে বাপ আমার কাছে আসত আর দু-পাঁচটাকা করে দিয়ে যেত । আমি খাবার কিনে খেতাম । তারপর বাপটাও একদিন মরে গেল । না-খাওয়া পেটে অত ভারি ভারি মালপত্র টানতে পারছিল না আর । একদিন এক বাবুর মাল মাথায় নিয়ে যেতে গিয়ে প্ল্যাটফর্মেই পড়ে গেল । আর উঠল না । আমি এবার কি করব । অন্যান্যো কুলিকাকারা প্রথম প্রথম দু-তিনটাকা করে দিত । কিন্তু তাতে আমার পেট ভরত না । খিদের জ্বালায় চুরি করতে শুরু করলাম । এভাবে বেশ হাত পাকিয়েও ফেললাম । তখন একটু বড়ো হয়েছি । একদিন এক মহিলার সোনার চেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম । পুলিশ ধরে নিয়ে গেল ।খোঁজ করার মত আমার তো কেউ ছিলনা । তাই পনেরো দিন জেলেই রইলাম । নাবালক বলে তেমন কোনো সাজা হল না । কিন্তু জেলের যে বড়বাবু ছিল সে একদিন আমায় ডেকে আমার সব কথা শুনল । কি জানি হয়ত আমার ওপর তার মায়া হয়েছিল । একদিন আমায় ডেকে জিজ্ঞাসা করল -- তুই জেল থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবি ।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । কি বলব । আমার তো কোনো ঘরবাড়ি বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন কোথাও কেউ নেই । আবার অনির্দেশের পথে আমাকে কামড়াকামড়ি করে বাঁচতে হবে । বুক ফেটে কান্না আসছিল তখন । কেবল বাপের কথা মনে হচ্ছিল । বড়বাবু আমার মাথায় হাত রেখে বলল --- আমার সাথে যাবি ? আমার ঘরবাড়ি দেখাশুনা করবি , বাগান দেখবি আর আমার ঘরে থাকবি । কি বলব সেদিন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । একমুঠো নিশ্চিন্তের ভাতের আশায় চোখদুটো চকচক করে উঠেছিল ।
রামশরণ তার পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়ে একটু থামল । আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম --- বড়বাবুর বাড়িতে তুমি গেলে ?
--- হ্যাঁ , আবার বলতে শুরু করল রামশরণ । ছাড়া পেয়ে সেইদিন আমি জেলের বাইরে বসেছিলাম । তারপর বড়বাবুর ডিউটি শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন । কি বলব মাষ্টারমশাই এমন ভালো মানুষ যে পৃথিবীতে আছে তা তার সঙ্গে না গেলে বুঝতেই পারতাম না । উনি আমার জন্য যা করেছেন তা অনেক বাবা তার ছেলের জন্যও করে না । নামেই তার বাড়ির কাজের লোক ছিলাম । সে আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দিল , থাকার জায়গা দিল , দিনকয়েক পড়ে আমাকে ইস্কুলেও ভর্তি করে দিল । আমি খাইদাই পড়াশুনা করি আর বড়বাবুর বাগানে বাড়িতে যতটা সম্ভব কাজ করি । এভাবে মাধ্যমিকটা পাশ করেছিলাম । একদিন হল কি দিব্বি ভালো মানুষ খেয়েদেয়ে জেলে গেলেন । সন্ধ্যার সময় প্রচুর গাড়ির ভীড় সামনে । কি ব্যাপার বাবু তো জেলে গেছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি গেটের দিকে । একটা মড়াবাহী গাড়ি ঢুকল গেট দিয়ে । ছুটে গেলাম । আমার বড়বাবু শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে । একবারো তাকিয়ে দেখল না ।
কঙ্কাল বোধহয় নিজের কষ্টকে দমন করতে কিছুক্ষণ থামল । আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল । ভালো মানুষরা বোধহয় বেশিদিন আয়ুকাল নিয়ে পৃথিবীতে আসে না ।
---- তারপর কি হল রামশরণ ? --- রামশরণের জীবনকাহিনী আমাকে চুম্বকের মত টানতে লাগল আরো জানার জন্য ।
পরের পর্ব আগামীকাল ...........
No comments:
Post a Comment