কঙ্কাল
আমার কথায় রামশরণ যেন বাস্তবে ফিরে আসে আবার ।
--- তারপর আর কি মাষ্টারমশাই । বড়বাবুর চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার নিশ্চিন্ত জীবনেরও ইতি ঘটে গেল । আবার বেড়িয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের পথে । কিন্তু যে পাক থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম বড়বাবুর স্নেহের শাসনে সে পথে আর পা বাড়াইনি । কতদিন কত দোকানে কাজ করলাম --- চায়ের দোকানে , মুদির দোকানে , হোটেলে । কিন্তু এই কয় বছরে বড়বাবুর কাছে থেকে আমার রুচিরও পরিবর্তন ঘটে গেছে । ওদের গালাগালি , খিস্তি - খেউরগুলো আর ভালো লাগত না । বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম । একদিন এক বইয়ের দোকানে কাজ পেলাম । বেশ বড় দোকান । কত বই । সারাদিন বই পড়ার এমন সুযোগ পড়ার নেশাটাকে আরো বাড়িয়ে দিল । দোকানে বিক্রিও হত মন্দ না । মালিককাকার একটামাত্র মেয়ে ছিল । একদিন কাকা এসে বলল , ক'দিন দোকান বন্ধ থাকবে । তার মেয়ের বিয়ে । দোকানের বদলে এই কয়দিন তার বাড়িতে কাজ করতে হবে । গেলাম তার বাড়ি । লোকজন বলতে তেমন কেউ নেই । কাকা কাকীমা আর দিদি । ফলে দোকানবাজারের অনেক কাজই আমি পেলাম । করলাম আনন্দের সাথে ।কি বলব মাষ্টারমশাই এই প্রথম যেন কোনো পরিবারের অংশ বলে মনে হল নিজেকে । দিদি বিয়ে হয়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোর । আমি দোকান বাড়ি দুটোই সামলাতে থাকলাম । কাকীমাও আমাকে নিজের ছেলের মত ই ভালোবাসতেন ।
কিন্তু এ সুখও সইল না । কাকীমার হঠাৎ খুব কঠিন রোগ ধরা পড়ল । এখানে চিকিৎসা হবে না । দিদি কাকা-কাকীমাকে নিয়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোর । দোকানটা হয়ে গেল বন্ধ । আমি আবার বেকার ।
পুরানো কথায় ডুবে গেছে রামশরণ । একইসাথে সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যকে দেখা , অনুভব করা ঘটেছে তার জীবনে বারবার । জীবনের কত উত্থান-পতন যে মানুষকে কোথায় কোথায় নিয়ে যায় ।
---- তা তুমি এখানে এলে কি করে ?
----- সে তো আরো বড় ইতিহাস মাষ্টারমশাই । কিছুদিন একাজ- ওকাজ কত কাজই না করলাম । কিন্তু কিছুতেই মন বসে না । একদিন ট্রেনে চেপে বসে রইলাম । হাতে টাকাপয়সা প্রায় নেই । জামাকাপড় অত্যন্ত মলিন । স্নান হয়নি কয়দিন । অবসন্ন শরীরে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুম ভাঙল ধাক্কায় । ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি সামনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে । আর কালো কোট পড়া একজন লোক সবার টিকিট চেক করছে । পেটে খাবার নেই তো টিকিট কাটব কি করে । আমার কাছে টিকিট চাইলে আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । টিকিট না পেয়ে আমাকে পাগল ভেবে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দিল । শিয়ালদা থেকে কত দূরে আছি , কোথায় যাব কিছুই জানি না । প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম সারাদিন । খিদে তেষ্টার অনুভূতিও আর নেই । বিকেল হয় হয় । একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম । দুটো বিস্কুট আর চা খেলাম । তারপর ওয়েটিং রুমে গয়ে বসলাম । সারারাত সেখানেই পড়ে রইলাম । বড়বাবু আর কাকা-কাকীমার কথা খুব মনে পড়ছিল । দিদির ফোন নম্বর দিয়েছিল আমাকে । খুব ইচ্ছে করছিল ফোন করে ওদের খবর নিতে । কিন্তু পয়সা কোথায় ফোন করার ।
---- তারপর ? যতই শুনছি কঙ্কালের কথা শোনার আগ্রহ আরো বেড়ে যাচ্ছে ।
----- তারপর সকাল হল । একের পর এক ট্রেন যাচ্ছে আসছে । একসময় দেখলাম একদল স্কুলের ছেলে দলবেধে কলরব করতে করতে যাচ্ছে । কি ভেবে ওদের পিছু নিলাম । হাটতে হাটতে এই স্কুলটার সামনে এলাম । ওরা ভেতরে ঢুকে গেল । আমি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম । আর ওদের দেখতে লাগলাম ।
জানেন মাষ্টারমশাই , আমি আগের জন্মে অনেক পাপ করলেও কিছু কিছু পুণ্য কাজও করেছিলাম । তাই একসময় নজরে পড়লাম ঐ দ্বিজেনমাষ্টারের । তিনি অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করে একসময় কাছে এগিয়ে এলেন । আমার নাম-ধাম-ঠিকানা সব জিজ্ঞাসা করলেন । এমন ভালো মনের মানুষদের কাছে মন আপনাআপনি আত্মসমর্পণ করে জানেন তো মাষ্টারমশাই । আমিও আমার জীবনের পিছনে ফেলে আসা সব ঘটনা মাষ্টারমশাইকে বলে চললাম । মাষ্টারমশাই আমাকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে গেল । ঐ যে আমগাছের বেদিটা দেখছেন সেখানে আমাকে বসতে বলে ভেতরে গেল । তারপর কিছুক্ষণ পর হাসিমুখে এসে বলল যে আমার চাকরি হয়ে গেছে । আমি মাষ্টারমশাইয়ের পা ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম মাষ্টারমশাই । তিনি আমাকে তুলে নিয়ে ঐ ঘরটাতে থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন । তার উপর দিলেন মাইনে । আমিও প্রাণ দিয়ে স্কুলটাকে ভালোবেসে ফেললাম । সারাদিন ছোটোবড় কত ছেলেদের আনাগোনা । ছোটাছুটি , চীৎকার , চেঁচামিচি । একসময় ওদের সাথে ভাব হয়ে গেল । ওরা কতরকম দুষ্টুমি করত । আমার হয়ত একটু ঘুমের ঢুল এসেছে । ওমনি পেছন দিয়ে এসে আমার টিকির সাথে দড়ি বেঁধে দিত । কখনো প্লাষ্টিকের সাপ সামনে ফেলে দিয়ে ' সাপ ' ' সাপ ' বলে ভয় দেখাতো । আমিও ওদের মজা দেবার জন্য ভয় পেয়ে লাফাতাম । কখনো আমার জুতো লুকিয়ে রাখত । তবে ওরা শুধু দুষ্টুমিই করত না ওদের জন্মদিনের কেক লজেন্সটাও আমার জন্য নিয়ে আসত । ওদের ভালোবাসায় আবার আমার জীবনটা ভরে উঠল । আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে লাগল ।ষাট পেরিয়ে পয়ষট্টি - সত্তর । আমি যেন এই স্কুলেই একটা অঙ্গ হয়ে উঠলাম । তারপর একদিন ওপরয়ালার ডাক এল । এই ঘরেই আমার জীবনের শেষ হল । আমার তো কেউ ছিল না । মাষ্টারমশাইরা আমাকে গোর দিল ।
---- আচ্ছা , তাহলে তুমি এখানে এলে কি করে । ---- শেষ কৌতুহলটা আর চাপতে পারলাম না ।
----- ওদের ভালোবাসা আমাকে ওখানে শান্তি দিল না মাষ্টারমশাই । আমি ইস্কুল আসার জন্য অস্থির হতে লাগলাম । একদিন সুযোগ এল ।
----- ইস্কুলের কয়েকজন মাষ্টারমশাই আমার গোরের পাশ দিয়ে কোনো অনুষ্ঠানবাড়ি থেকে সেদিন রাতে বাড়ি ফিরছিল । অনেক রাত । গোরে শুয়েও আমার তো সবসময় এই স্কুলের দিকেই মনটা পড়ে থাকত । তাই স্কুলের কোনো মাষ্টারমশাই বা ছাত্রদের কথা শুনলেই উৎগ্রীব হয়ে উঠতাম । সেদিনও মাষ্টারমশাইদের কথা শুনছিলাম । বিজ্ঞানের মাষ্টার অভীকবাবু হেডমাষ্টারমশাইকে বলছিল যদি স্কুলের জন্য একটা আসল কঙ্কাল পাওয়া যায় তবে খুব ভালো হয় । এমনি তাদের কথাবার্তা চলছিল । হঠাৎ মুখঢাকা দুজন অস্ত্রধারি লোক মাষ্টারমশাইদের সামনে এসে দাঁড়াল । যা আছে দিয়ে দিতে বলল । নয়ত প্রাণে মারবে বলে হুমকি দিতে লাগল । আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না । ছোকরাদুটোর কাছে গিয়ে নানারকম কায়দা করতে লাগলাম । ভয়ে সেদুজনের সেকি পড়িমড়ি দৌড় । হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনা । মাষ্টারমশাইদের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদেরও একি অবস্থা । শুধু অভীকবাবু আর হেডমাষ্টারমশাই দাঁড়িয়ে আছে । আমি আস্তে আস্তে তাদের বললাম --- ভয় পাবেন না মাষ্টারমশাই । আমি রামশরণ । অভীকবাবু আমাকে অনেকদিন ধরে দেখেছে এই স্কুলে । তাই নির্ভয়ে হেসে বলল --- এখনো কিসের টানে রামশরণ । আমি বললাম ---- আজ্ঞে মাষ্টারমশাই । আমাকে স্কুলেই একটু জায়গা দিন । ছেলেদের কলকল না শুনে আমি থাকতে পারিনা । অভীকবাবু বলল ---- ঠিক আছে দেখছি তোমার জন্য কি করতে পারি । তার কিছুদিন পর মাষ্টারমশাইরা আমাকে ওখান থেকে তুলে পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন করে স্নান- টান করিয়ে এখানে রেখেছে । আমিও খুব খুশিতে আছি এখন ।
নিজের অজান্তে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল আমার বুক চিরে । আমিও হারিয়ে যেতে থাকলাম অনেক অনেক দূরে যেখানে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছেলেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রামশরণকে । আর রামশরণ হাত - পা নেড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছে ।
####সমাপ্ত ####
No comments:
Post a Comment