কঙ্কাল
ক্লাশ টুয়েলভের টেষ্ট পরীক্ষা শেষ । ফাইনালের জন্য ল্যাবটা পরিষ্কার করাচ্ছিলাম কয়েকটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে । এক্সটারনাল এগজামিনার আসবেন । একটু গোছগাছ না করলে কেমন দেখায় ।
গোছানো শেষে একটু আগে ছেলেরা চলে গেছে । আমি তখনো চেয়ারে বসে ওদের প্রজেক্টের খাতাপত্রগুলো ঘাটাঘাটি করছিলাম । সাড়ে তিনটে বাজে । চারটে নাগাদ বেরোবার ইচ্ছে । একটি ছেলের খাতায় চোখটা আটকে গেছে । কভারটা তো সুন্দরই । খাতার ভিতরটাও এত সুন্দর পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন যে চোখ আপনা-আপনি পরপর পৃষ্ঠাগুলো পড়তে বাধ্য করছিল । এমন সময় কে যেন ডাকল ---- ' শুনছেন ' । আমি দরজার দিকে তাকালাম । কেউ নেই । হয়ত আমার মনের ভুল অথবা নীচে থেকে আওয়াজ আসছে ভেবে আবার খাতায় মনোনিবেশ করলাম ।
দ্বিতীয় ডাকটা একটু পরে আরো স্পষ্ট করে উচ্চারিত হল ---- ' মাটারমশাই , শুনছেন । '
এবারও আমি দরজা-জানালাসহ সমস্ত ঘরটাতে একবার চোখ ঘুড়িয়ে নিলাম । এই স্কুলে আমি জয়েন করেছি আট মাস হল । এর মধ্যে শুধু ক্লাশটুকু করা ছাড়া ল্যাবে খুব বেশি সময় কাটেনি আমার । উপরন্তু ল্যাবরেটরিটা তিনতলায় সারি সারি চারটে ঘরের একদম শেষ ঘরটায় । বাকি ঘরগুলোও বন্ধ । তাই এমন নির্জন পরিবেশে গাটা ছমছম করে উঠল । হঠাৎ চোখ পড়ল আলমারির ভেতরে রাখা কঙ্কালটার দিকে ।
--- হ্যাঁ , হ্যাঁ , আমি বলছি । আলমারির পাল্লাটা একটু খুলুন না । '
আলমারের পাল্লা খুলব কি মুহূর্তে আমার সারা শরীর কেমন অবশ মনে হল । হাত-পাগুলো এত ভারি যে আমার নড়বার ক্ষমতা নেই । মাথার মধ্যে কোনো বোধও কাজ করছে না ।
--- ' আলমারির পাল্লাটা একটু খুলুন না । আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে । খুব কষ্ট হচ্ছে বিশ্বাস করুন । '
এই করুণ আর্তিতে আস্তে আস্তে সম্বিত ফেরে আমার । একুশ শতকে ভুত ! তাও আবার আমার ল্যাবে ! আমার বিজ্ঞানমনষ্ক মন জেগে উঠতে থাকে । কৌতুহল হয় । যা শুনছি সেটা কি ঠিক । চেয়ার ছেড়ে উঠে আলমারির চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম । আজকাল স্যার - ম্যাডামদের বিপাকে ফেলার জন্য ছেলেরা অনেক রকম দুষ্টুমি করে । আমাকে ভয় দেখাবার জন্য সেরকম কিছু করে রাখেনি তো । এখন তো সবার হাতেই এন্ড্রয়েড ফোন । ভালো করে ল্যাবের সর্বত্র খুঁজে দেখতে লাগলাম । না । সন্দেহ করার মতো কোনো বাক্স বা স্পীকার কোথাও নেই । বাইরে বেড়িয়ে কড়িডোরটা একবার দেখলাম । নীচের দিকে ঝুঁকে দেখলাম । সব ফাঁকা । এবার আস্তে আস্তে আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । কঙ্কালটাকে ভালো করে লক্ষ্য করছি । খুব বেশি পুরনো তো নয়ই , জিনিষটাও আসল বলেই মনে হচ্ছে । পর্যবেক্ষণ করছি , এমন সময় কঙ্কালের মুখটা যেন সত্যিই নড়ে উঠল ।
--- মাষ্টারমশাই , পাল্লাটা একটু খুলবেন ।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে আবার একই কথা বলল । আমি এবার আস্তে করে পাল্লার একটুখানি খুললাম ।
--- ব্যাস , ব্যাস , ওতেই হবে মাষ্টারমশাই । অনেক ধন্যবাদ । ছেলেগুলো একেবারে আটকে দিয়ে গেছে ।
আমার নির্বাক মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলতে থাকে --- প্রায় ন'মাস ধরে আমি এখানে আছি । কি করব বলুন সারা জীবন যাদের মাঝে কাটিয়ে দিলাম মড়েও যে তাদের ছেড়ে থাকতে পারিনা । বাচ্চাদের কলরব না শুনতে পারলে আমার ভালো লাগে না মাষ্টারমশাই ।
---- তুমি কে ? --- আমি অষ্ফুটে জানতে চাইলাম ।
ক্রমশ : ......
No comments:
Post a Comment