Saturday, June 24, 2023

ছাতারেও এক নারীর গল্প -- শ্যামল কুমার মিশ্র

 ছাতারেও এক নারীর গল্প 
 শ্যামল কুমার মিশ্র
 ২৩-০৬-২০২৩
গল্প লিখতে গিয়ে এলোমেলো ভাবনাগুলো যেন আর পিছু  ছাড়ছে না অনিমেষের। সকালবেলার নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে পড়ার টেবিলে। পেয়ারের ডালে বসে সাত ভাই ছাতারেরা খুনসুটি করে চলেছে। কেউ লাফিয়ে উপরের ডালে উঠে দোল খাচ্ছে। কেউ বা নিচে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। সে  সব দেখতে দেখতে কখন যেন অনিমেষ হারিয়ে যায়। 
সেদিনটা ছিল এমনি এক বৈশাখের সকাল। নরম রোদ্দুর এসে পড়েছিল যুবক অনিমেষের টেবিলে। সদ্য স্কুলের চাকরিতে যোগদান করেছে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে উত্তর ২৪ পরগণার এক প্রান্তিক অঞ্চলে। স্কুল থেকে একটু দূরে ইছামতি বইছে। সকাল বিকেল কত মানুষের আনাগোনা। ভাষা আর সংস্কৃতির ভিন্নতা অনিমেষকে আকৃষ্ট করে। দিনের শেষে সূর্য যখন অস্ত যায় তখন ইছামতির বুকে এক অপরূপ রঙের খেলা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন আঁধার নেমে আসে।টেরই পায়না অনিমেষ। ঐ ইছামতির তীরে শৈবাল ভট্টাচার্যের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকে অনিমেষ। শৈবালবাবু খুব সজ্জন ব্যক্তি। । পেশায় উকিল। পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ। সামনে সুন্দর বাগান। বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতি। অনিমেষের ঘরের জানালা দিয়ে ইছামতিকে দেখা যায়। ভাটিয়ালী গাইতে গাইতে পালতোলা নৌকা ভেসে চলেছে। দেখতে দেখতে কখন যেন সময় পেরিয়ে যায়। প্রথম প্রথম কলকাতার জন্য মন কেমন করলেও এখন ইছামতি যেন সব দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়েছে। সময় পেলেই কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়। আজ সকাল থেকে লিখতে বসেই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু লিখছে, তারপর সামনে রাখা ওয়েস্ট পেপার বক্সে দলা পাকিয়ে কাগজগুলো ছুঁড়ে ফেলছে। কিছুতেই যেন গল্পটা দাঁড়াচ্ছে না। এমন সময়ে রোশনী এসে দাঁড়ায় চৌকাঠে। 'কি করেছেন ঘরটার'?  কিছু কাগজ ডাস্টবিনে কিছু কাগজ মাটিতে তখন গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনুমতির পরোয়া না করেই ঘরে ঢুকে পড়ল রোশনী। রোশনী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। শৈবালবাবুর একমাত্র মেয়ে। বসিরহাট কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ে। খুব বেশি সাক্ষাৎ না হলেও পরস্পরকে খুব ভালোভাবেই চেনে ওরা। ফর্সা সুন্দর গড়ন। চোখে মুখে এক প্রাণোচ্ছলতা সবসময় অটুট। খুব মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। 'এই যে মশাই, বাবা মা যে শ্রীমান অনিমেষের জন্য চায়ের টেবিলে অপেক্ষমান'। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই হেসে ফেলে। বুঝতে বাকি রইল না চায়ের বার্তাটি দিতে এসেছিল রোশনী।  এসেই ঘরের এই অবস্থা দেখে ওড়নাটা কোমরে বেঁধে মেঝেতেই বসে পড়ে। তারপর এক একটা টুকরো তুলে নেয়। অনিমেষ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আপন মনে পড়তে থাকে রোশনী। 

টুকরো ১: গঙ্গার তীর ধরে এগিয়ে চলেছে ওরা-- সন্দীপন আর সুপর্ণা। অপরাহ্ণের লাল আলোয় আকাশ ভরে উঠেছে। সেই আলো এসে পড়েছে নদীর জলে। অপরূপ এক রঙের খেলা। গঙ্গা তীরে সবুজ ঘাসে ওরা বসে। হাতে হাত রেখে নীল জলের অতলান্ত গভীরে যেন ওরা ডুব দেয়... 

টুকরো ২:  সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আঁধার নেমে আসছে। গঙ্গার দুই তীরে আলো ঝলমল করছে। দূরে জুট মিলের ভেপু বেজে উঠলো। গঙ্গার দুপাড়ে তখন মিলে ছিল প্রাণের জোয়ার। মিলকে ঘিরে প্রেম, বিরহ, হিংসা...। ক্রিং, ক্রিং শব্দ করে সার সার সাইকেল এগিয়ে চলেছে। 

টুকরো ৩: আঁধারের আলোতে ওরা বসে থাকে। মেয়েটি ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে। ছেলেটির চোখে মুখে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। প্রথানুগ বিয়েতে ও রাজি নয়। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই মানুষের বেঁচে থাকার দায়িত্ব নেবে। মানুষ তার সাধ্যমত শ্রম দেবে। শ্রম এবং পুঁজির অসম বন্টনে একদল গরীব থেকে আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে। বলতে বলতে সন্দীপনের চোখ দুটো যেন জ্বল জ্বল করে ওঠে। ভয় পেয়ে যায় সুপর্ণা। অজানা আশঙ্কায় সন্দীপনকে জড়িয়ে ধরে। 

টুকরো ৪: রাতের অন্ধকারে পুলিশ এলো। পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলল। বৃদ্ধা মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুলে নিয়ে গেল সন্দীপনকে। হাজার একটা অভিযোগ দিল। কারান্তরালে হারিয়ে গেল সন্দীপন। সুপর্ণা অপেক্ষায়...

টুকরো ৫: মাটির দাওয়ায় বসে থাকে এক নারী। শব্দ যেন হারিয়ে গেছে ওর জগতে। জানালা দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত এক শূন্যতা। চমকে ওঠে মেয়েটি। একটা দল ছাড়া ছাতারে রক্তাক্ত অবস্থায় এসে পড়ে সাদা গোলাপের উপর। গোলাপের সাদা পাপড়ি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। চিলটা তখন দূর আকাশে। অস্থির হয়েও ওঠে সুপর্ণা। 

আর টুকরোগুলো তুলতে পারে না রোশনী। দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রোশনী যেন দেখতে পাচ্ছে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ছাতারে দুবার যেন কাকে ডাকল। তারপর চিরস্তব্ধ হয়ে গেল। অনিমেষ ধীরে ধীরে উঠে এসে রোশনীর মাথায় হাত রাখে। রোশনী হারিয়ে যায় অনিমেষের বুকে। জানালার  ওপারে বাগানে ছাতারে দম্পতি তখন খুনসুটি করে চলেছে।

No comments: