পারফিউম
বিজয়া মিশ্র
২৯.০৩.২০২৩
বৃষ্টিতে বাইরে থাকলেই তৃষার চোখে ভাসে সেদিনের কথা। সেদিন ও ছিল সারাদিন মেঘের ঘনঘটা।বৃষ্টি হবো হবো ক'রেও হচ্ছিল না। এভাবেই চলছিল আগের দুদিন।সেদিনের সকালটা কখনো মেঘ কখনো রোদ্দুর। তৃষা সেদিন একটু সকাল সকাল অফিস থেকে বেরোবে ভেবে রেখেছিল। ঠিক চারটে নাগাদ শুরু হল বৃষ্টি। ঐতিহ্য অপেক্ষা করবে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল তৃষা। ছাতাটাও ছিলনা সঙ্গে।
সব প্ল্যান মাটি করে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছিল। ফোনে ম্যাসেজ চলছিল দুজনের মধ্যে। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে ঐতিহ্য গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল অফিসের সামনে। ড্রাইভার থাকলে তৃষা ওদের গাড়ি এড়িয়ে চলে। অগত্যা ঐতিহ্য ড্রাইভার ছেড়ে দিয়ে নিজেই ড্রাইভ ক'রে এসেছিল। সেদিন তৃষা গেট পর্যন্ত আসতে আসতেই কাক ভেজা। কিছুটা দূরের মার্কেটিং কমপ্লেক্স থেকে ছাতা এবং তৃষার পছন্দমতো একসেট পোশাক কিনে চেঞ্জ ক'রে ওরা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে টেবিলে বসলো।বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশঃ। খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে যাবে এমন সময় শুনলো রাস্তা জলে জলময়। গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। ছাতা খুলতেই উড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ বাদে ঝড়বৃষ্টির দাপট কমলেই বেরোবে ভেবে রেস্টুরেন্টেই
অপেক্ষা করছিল ওরা। অনেকদিন পর ওদের দেখা হয়েছে।কত কী প্ল্যান করেছিল । সব মাটি। এফ এম চালিয়ে কিছু কিছু খবর শোনা যাচ্ছিল। রাত্রি ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ির লোকজন উদ্বিগ্ন।বারবার ফোন করছে। এখন বেরোনোর উপায় নেই। রেষ্টুরেন্ট থেকে একটু দূরের জমা জলে বিদ্যুতের শক লেগে একটি কম বয়সী ছেলে মারা গেছে। এলাকা বিদ্যুৎ বিহীন ।
ট্রাফিক পুলিশ রাস্তার বিবরণ এবং যানচলাচলের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে চলেছে। রেষ্টুরেন্টের মালিক
নিজে কাউকে চলে যেতে বলতে না পারলেও রেষ্টুরেন্ট বন্ধের তোড়জোড় করছিলেন। ভাগ্যিস ঐতিহ্য সঙ্গে আছে, নইলে...। তৃষা উদ্বিগ্ন। সমস্ত দিনের আবেগোচ্ছ্বল সুন্দর ভাবনাগুলো এলোমেলো লাগছে। রেষ্টুরেন্টের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকটা দেখতে চাইছিল তৃষা। বৃষ্টির ছাট এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ঘষা কাঁচের গায়ে। নিঃশব্দে ঐতিহ্য এসে দাঁড়িয়েছে গা ঘেঁষে। তৃষা চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ। বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছিল না শুধু কিছু দূরের গাছের শাখাগুলোর প্রবল আন্দোলন আর বন্ধ জানালার কাঁচে প্রথম বৃষ্টির পরশে যেন তারই হৃদয়ের কথা ব্যক্ত ক'রে চলছিল সেই বর্ষনশিক্ত রাতে। সমস্ত নিষধাজ্ঞা উড়িয়ে দিয়ে প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার সময় একটি গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল গাড়ির উপর। ব্যাস। মাথায় চোট পেয়ে ঐতিহ্য চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারায়। তৃষাও গুরুতর আহত হয়েছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত সেরে উঠেছিল।
সেদিনের পর ঐতিহ্যের বাড়ির লোকজন তৃষা কে পুত্রবধূ হিসেবে গ্ৰহণ করতে চায়নি। তৃষা দায় এড়ায়নি। ঐতিহ্য নিজেও চায়নি তৃষার অনিশ্চিত,কষ্টকর জীবন। নাছোড় তৃষা দুই বাড়ির অমতেও নিজে ঐতিহ্যের দায়িত্ব নিয়ে সংসার বেঁধেছে, ভালো রাখতে অনেক শ্রম করে। শুধু প্রথম বৃষ্টি জানলার কাঁচে আছড়ে পড়ে ধারাপাতের নিরন্তর আল্পনা আঁকা সময়ে ঐতিহ্য তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালে আজও তৃষা যেন সেই পারফিউমের টাটকা গন্ধে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পায়, পূর্ণতা অনুভব করে।
No comments:
Post a Comment