Thursday, November 29, 2018

গল্প - অপরাধ

অপরাধ

খবরটা ছড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি যতটা সময় লেগেছিল ঘটনাটা ঘটতে ।
বোনের ডাকে ধরফর করে উঠে বসে স্বপন । দুপুরের ভাতঘুমে স্বপ্নের আলপনাটুকু তখনও রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে । প্রথমটা বুঝে উঠতে না পারলেও দুর্ঘটনার বিদ্যুৎপ্রবাহ মুহুর্তে তাকে সচকিত করে তোলে । ঘুমভাঙা চোখ রগরাতে রগরাতে সে বাইরে এসে দাঁড়ায় । ইতিমধ্যেই বিশাল জনতার ছোট্ট ছোট্ট জটলা এখানে - সেখানে ।
- বয়সমাত্র চৈদ্দ - পনের । ক্লাশ নাইন । এখনি কি এমন ঘটল যে এমন কাজ করল ।
- বেশ শান্ত শিষ্টই তো । কখনো আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতেও দেখিনি ।
- পড়া পারেনি স্যারের কাছে । বাবার ভয়ে এমন কাজ করেছে ।
- আরে রাখো । ওপরে ওপরে ভদ্র । ভেতরে ভেতরে কি ছিল তা কে জানে ।
স্বপন কিছুই জানে না । শুধু জানে মানুষের মন বোঝা বড় দায় । কে যে কখন কোন কথায় আঘাত পেয়ে যায় বলা মুস্কিল । পাকা বয়সের দুর্দান্ত ছেলে হলে তবু কথা ছিল । কিন্তু এমন ভদ্র ছেলেটি ! কৌশিকের মায়ের কথা ভেবে স্বপনের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে । দীর্ঘদিনের পরিচিত সে ওদের বাড়ির সঙ্গে । ওদের দুটি ভাইকেই ও খুব ভালোবাসে । এখনও যেন ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারছেনা স্বপন ।
                #                #                #
সকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করছে কৌশিক । আর বেশিদিন মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারছেনা ও । আলেয়ার গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করতে গিয়ে বুকের মধ্যে যে ধুকপুকুনি শুরু হয় .....। আলেয়াকে বলা প্রয়োজন । কিন্তু কিভাবে বলবে সে । আলেয়া ক্লাশ ইলেভেন । সে ক্লাশ নাইন । জীবনের প্রথম প্রেম যে এমন অদ্ভুতভাবে আসবে তা কি সে জানত । কৌশিক জানে বাবা কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নেবেনা । হয়ত আলেয়াও ' পাগল ' বলে হেসে উড়িয়ে দেবে । নিজেকে কিছুতেই দমন করতে পারছে না কৌশিক । গতকাল রাহার্সালের পর আলেয়া যখন ওর কাছে এসে দাঁড়াল ' সাবাস ' বলে পিঠ চাপড়ে দিল কৌশিকের মনে হল কে যেন এক বালতি বরফ-জল তার গায়ে ঢেলে দিল ।
সন্ধ্যেবেলা পড়তে গিয়েও মনের মধ্যে এই হীমশীতল স্পর্শটুকু অনুভব করছিল কৌশিক । স্যার যখন ' নিউরণ ' বোঝাচ্ছেন তখন সে একমনে আলেয়ার খুশি - উজ্জ্বল মুখটা ভেবে যাচ্ছে । ভাবতেও কত সুখ । হঠাৎ গোকুলের ধাক্কায় তার চৈতন্য ফিরে আসে । স্যারের শ্যেণদৃষ্টির সামনে মুহুর্তে আলেয়ার মুখটা বিলীন হয়ে যায় । অবশ্য স্যার তেমন কিছু বলেননি ।তাঁর না বলা চোখে অনেক কিছু পড়ে ফেলেছে কৌশিক । মুহুর্তে সচেতন হয়েছে সে ।
তবু দ্বিতীয় ও মারাত্মক ভুলটা এর পড়েই করে বসেছিল কৌশিক । কাজ করতে দিয়ে স্যার বাইরে গেছেন । সবই জানা প্রশ্ন । অসুবিধা নেই । আনন্দে আবার আলেয়ার মুখটা মনে পড়ল কৌশিকের । হাতের কলমটা খাতা ছেড়ে বেঞ্চের ওপর দাগ কাটছে তখন । স্যার ফিরে এসেছেন । সবার খাতা একে একে জমা নিয়ে কৌশিকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন । কৌশিকের কোনো খেয়াল নেই । বেঞ্চের ওপর তখন লাল কালিতে একটা নাম স্পষ্ট ফুটে উঠেছে -- আলেয়া ।
একটা সজোর চপেটাঘাতে সম্বিত ফেরে কৌশিকের । এতক্ষণে ঘটনার গুরুত্ব সে উপলব্ধি করতে পেরেছে । ততক্ষণে কৌশিকের বই খাতা হাতে তুলে নিয়েছেন স্যার । এখন শুধু আঙুল তুলে দরজাটা দেখিয়ে বললেন -- বেরিয়ে যাও ।
কৌশিক জানে স্যারের কাছে আজকের ভুলের কোনো ক্ষমা নেই । কয়েকদিন ধরেই ওর অন্যমনষ্কভাব স্যার ঠিক লক্ষ্য করেছেন ।
মনের মধ্যে তুমুল ঝড় নিয়ে আবার স্যারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় কৌশিক - আর কখনো হবে না স্যার ।
- তোমার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলতে চাই না । তোমার বাবাকে আমার সাথে কথা বলতে বলবে ।
সারারাতের অনিদ্রায় কালিপড়া বসে যাওয়া চোখ নিয়ে ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়েছিল কৌশিক ।আজ কোনো এক রাজনৈতিক দলের আহ্বানে চব্বিশ ঘন্টার বাংলা বন্ধ । বাবা বাড়িতে থাকবে । বাজারে যাবে । কৌশিকের পড়াশুনার খবর জানতে যদি স্যারের বাড়িও যায় । কোথায় পালাবে কৌশিক । পৃথিবীটা বড্ড ছোট বলে মনে হয় তার ।
সামনের মাঠে কয়েকজন নাড়ীপুরুষ মর্ণিংওয়াক করছে । অবশিষ্ট পৃথিবী এখনো শেষরাতের নিদ্রাসুখটুকু উপভোগ করছে । কৌশিকের জগৎ শুধু একঘরে । এখানে ক্ষমা নেই । ভালোবাসা নেই । আর ভাবতে পারছে না কৌশিক । এই চৌদ্দ - পনের বয়সেই সে যেন পৃথিবীর প্রাচীনতম সদস্য হয়ে উঠেছে । চোখের উপর দিকটা অসম্ভব যন্ত্রনা হচ্ছে । মাথার মধ্যে শিরা উপশিরার তান্ডব চলছে যেন । এক্ষুনি হয়ত একটা পটাশ করে ছিড়ে যাবে হয়ত । এক্ষুনি যদি একটা ভয়ানক বাজ পড়ে কিংবা প্রবল ভূমিকম্পে ওদের বাড়িটা মিলিয়ে যায় মাটির নীচে -- কৌশিক যেন বেঁচে যায় ।
দুঘন্টা কেটে গেল । তেমন কোনো অঘটন ঘটল না । বাবা সকালের কাজ সেরে চায়ের কাপ হাতে টিভিতে খবর শুনছে । মা গৃহস্থালীর কাজে ব্যস্ত । দাদু-ঠাকুমা , কাকা-কাকীমা কারো কোনোদিকে নজর নেই । সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত । আজ আর ভায়ের কাছে গিয়ে খুনশুটি করল না কৌ‌শিক । গামছা নিয়ে নিজের শীর্ণ মুখটা লুকোতেই হয়ত এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে । মা ভাবছে ছেলে আজ কত ভোরে উঠে পড়া করে নিয়েছে । সত্যি ! সন্তান ভাগ্য তার ।

নিজের ঘরে টেবিলে বই নিয়ে বসেছে কৌশিক । বাবা বাজারের ব্যাগটা খুঁজছে । ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে টেনে এনে ঘরের মধ্যে আটকে রাখে ।মুখটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল কৌশিক -- আজ তো বাজারও বন্ধ্ বাবা ।
--যাই । টুকটাক কি আর খোলা থাকবে না । তাছাড়া বাজারের একটু হালহাকিকৎও জানা যাবে ।
যদি স্যারও এইমুহুর্তে বাজারের হালহাকিকৎ জানতে আসেন ! মুহুর্তে ছুটে যায় মার কাছে । মার এখন যে মরারও সময় নেই । ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না মা । কি করবে এখন কৌশিক । একবার দাদুর ঘরে গেল । দাদু এখনো বিছানায় । দাদুর কাছে গিয়ে একটু দাঁড়াল কৌশিক । ওষুধের অ্যাকশন শেষ হতে এখনো আধ ঘন্টা বাকি । এখন দাদুর ঘুম ভাঙ্গানো বারণ । গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় কৌশিক । বাবা এখনো তো আসছে না । তবে কি ....
একটা গোটা মুরগি নিয়ে ফিরে এসেছে বাবা । নাহ্ । মুখটা দেখে বেশ ভালোই মনে হচ্ছে কৌশিকের । কিছুক্ষণ পর বাবার ডাকে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে কৌশিক । না ! এ স্বরে কোনো ভয় নেই । স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল কৌশিক ।

দুপুরে মুরগির ঝোলটা খুব ভালো রান্না করেছিল মা । তবু বাবার পাশে বসে গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইছিল না কৌশিকের ।
মুরগির গলাটা নিয়ে ভাই বলছিল , দেখ দাদা , আমাদের গলাটাও এমনি , না ? গলায় হাত বোলায় কৌশিক । মুখ দিয়ে স্বর বের হয় না । ছোট্ট করে মাথাটা ঝাঁকায় শুধু ।
খাওয়া দাওয়ার পর একবার বের হয় কৌশিক । বন্ধুদের সাথে একটু কথা বললে যদি ভালো লাগে । রমেশ , সমর , সৌগত ,সমরেশ একে একে সবার সাথে দেখা হয় । না । ওরা বোধহয় এ ব্যাপারে কিছু জানে না । একটু হাল্কা লাগে মনটা । কৌশিক বাড়ি ফেরে ।
বাড়িতে ঢোকার মুহুর্তে গোকুলের সাথে দেখা । -- 
একটু এদিকে আয় কৌশিক ।

-- কি হয়েছে ? বুকের মধ্যে দুমদুম দামামাটা আবার বেজে ওঠে ।
-- স্যার বিকেলে হয়ত তোদের বাড়ি আসবেন ।
কৌশিকের ফর্সামুখটা মুহুর্তে ছাইবর্ণ হয়ে যায় । বাবার মুখটা একবার মনে পড়ে । আর উপায় নেই । গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায় কৌশিক ।
মন্থর পায়ে ঘরে ঢোকে কৌশিক । ভালো করে খেয়াল করলে ওর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছে তার আঁচটা হয়ত বোঝা যেত । কিন্তু কে বুঝবে । মা ভাইকে নিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে । বাবা কোথায় কে জানে । প্রাণপনে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে কৌশিক । মার পাশটাতে গিয়ে শোয় -- মা ... ।গলায় জোর পায়না কৌশিক । বাইরের জানালা দিয়ে বাবা টিভি দেখছে ।
মুহুর্তে ডিসিশন নেওয়া হয়ে যায় কৌশিকের । ধীর পায়ে বাইরে আসে ।
-- ভালো সিনেমা হচ্ছে বাবা । যাও না ভেতরে গিয়ে বসে দেখ ।
-- তুইকোথায় যাচ্ছিস ।
-- বাথরুমে ।
একবার পেছন ফিরে দেখে নেয় কৌশিক । না । বাবা নেই । গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠতে থাকে । ছাদে উঠতে যে এতগুলো সিড়ি টপকাতে হয় আজই যেন প্রথম খেয়াল করল কৌশিক ।
ঐতো মায়ের একটা শাড়ি মেলা রয়েছে । কোনার দিকে মইটাও আছে । চিলেকোঠার চালটা সেদিন লাগানো হয়েছে । যথেষ্ট মজবুত । টিনের ফাঁকে একটা মোটা দড়ি অনায়াসে গলে যেতে পারে । দড়ির বাঁধনটাও সে জানে ।
মা যখন ভাইকে নিয়ে ঘুমে কাঁদা , বাবা যখন সিনেমা দেখায় মগ্ন , যখন চারিদিকে দুপুরের নৈঃশব্দ -- কৌশিক তখন সকলের মায়া কাটিয়ে পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে । মুহুর্তে ফুরিয়ে যায় চৌদ্দ - পনের বছর বয়সের তরতাজা জীবনটা ।
চূড়ান্ত অপরাধের সামান্য প্রায়শ্চিত্ত করে যায় কৌশিক ।

Saturday, November 17, 2018

স্পর্শ

স্পর্শ

রাত্রির নির্জনতা ভেদ করে

একটি স্পর্শ
মাঝে মাঝে চমকে দেয় আমায়
লোভাতুর আমি
উদ্ভ্রান্ত
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটি
আকাশে বাতাসে
আমার সেই ছোট্ট ঘরে
সেই বিছানায়
যেখানে কেটেছে বেলা
আশায় স্বপনে ।

Wednesday, November 14, 2018

সেইক্ষণে

সেইক্ষণে

আকাশটা যখন , নিশ্চিন্তে
পৃথিবীর মুখের ওপর মুখ রেখে
চুম্বনরস পান করছিল
তখন তোমায় দেখেছিলাম

তুমিও চুম্বন প্রত্যাশি ছিলে না ?
শিমূল ফুলের সমস্ত রঙ চুরি করে
গায়ে মেখেছিলে সেদিন
রক্তরাগ শরীর থেকে
ঠিকরে বেরচ্ছিল
রঙ বেরঙের প্রজাপতি
সমুদ্রের ঢেউ
তটের উপর আছরে পড়ে
সে কি আকুলি বিকুলি প্রেম !

আশ্লেষ করতে চেয়েছিলে তুমিও
মাটির সঙ্গে ঘাসের মত ।

Monday, November 5, 2018

অভিলাষ

অভিলাষ

বুড়ো সূর্যটা যখন
পুকুরপারের গাছের ছায়ায় বসে
একটু বিশ্রাম করে ,
যখন কোকিলগুলো
গানে গানে ভরিয়ে দেয় প্রাণ , 
যখন নাড়কেলের পাতাগুলো
তিরতির করে কাঁপতে থাকে , আর
গাছের হলুদ পাতাগুলো
একটি একটি করে
পুকুরের জলে পড়ে খসে

....ভাসে আর ভাসে ....
মনে হয় এমনি ভেসে ভেসে
কোথাও হারিয়ে গেলে বেশ হয়

আবার যখন পৃথিবীর কপালে
রাজটীকার মত
ভোরের সূর্য উদ্ভাসিত হয়
মনে হয় বৃহৎ সংসারের কপালে
রাজটীকা না হলেও
ছোট্ট কাজলের ফোটা হলেই বা মন্দ কি ....

ক্রন্দন

ক্রন্দন

মনের গোপনে লালিত
যে কথা বহুযুগ ধরে
হল না প্রকাশ কোনোদিন ,
অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল একটি ভ্রুণ
পেলনা অনুকূল পরিবেশ
ছন্দে গন্ধে সৌরভে গৌরবে
হল না প্রস্ফুটিত ,

তবে কি আজ বুনো হাসের মাঝে
খুঁজে পেয়েছে তার আত্মা ?

নিরালম্ব শরীরটা
শ্মশানে হয়েছে পুরে ক্ষয়
তবুও তো -
এক অতৃপ্ত আত্মার ক্রন্দন ধ্বনি
মাঝরাতে গোঙায় শুধু
এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় ।